—প্রতীকী চিত্র।
এ বারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮.২৫ লক্ষ। মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়ে ১.২০ লাখেরও বেশি। কিন্তু মেয়েদের সাক্ষরতার হার আজও ছেলেদের তুলনায় যথেষ্টই কম। এই সে দিন পর্যন্ত উন্নয়ন অনুশীলনকারীরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন মেয়েদের তুলনামূলক ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে বোঝাতে হত যে, মেয়েদের লেখাপড়া জানাটা সমাজের সামগ্ৰিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিছু দিন থেকেই লক্ষ করছি, চিত্রটা বদলে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় বর্তমানে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় যোগদান করছে। তবে সেটা যত না মেয়েরা বেশি সংখ্যায় উচ্চশিক্ষায় যোগদান করছে বলে ঘটছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জোরালো কারণ হল, ছেলেরা স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গে যে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটছে তা নয়। ২০২১-২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গড়ে ১০০ জন ছাত্রী-প্রতি ছাত্রের সংখ্যা ১০৬.৬। এই হার সবচেয়ে বেশি রাজস্থানে (১২২.৩) এবং উত্তরপ্রদেশে (১২১.৪)। আর সবচেয়ে কম পশ্চিমবঙ্গে (৭৯.২), এর পরে ছত্তীসগঢ় (৮৮.৩)। কেরলে এই সংখ্যা ৯৬.৮, তামিলনাড়ুতে ৯৫.২। এই পরিসংখ্যান দেখে মনে হল, বোধ হয় ছেলেরা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ছেলেরা, মাধ্যমিক পাশ করে খুবই বেশি সংখ্যায় স্কিল ডেভলপমেন্ট বা দক্ষতা উন্নয়নের দিকে ঝুঁকছে। ভর্তি হচ্ছে পলিটেকনিকে, বা এই ধরনের কোনও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়। তা হলে তো ভালই।
কৌতূহলবশত অন্যান্য শ্রেণিরও পরিসংখ্যান দেখতে শুরু করলাম। উচ্চ প্রাথমিকে (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) ১০০ জন ছাত্রী-প্রতি ছাত্রের সংখ্যা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ১০৬.৯, আমাদের রাজ্যে ১০০.৯। কিন্তু নবম-দশম শ্রেণিতে তা কমে ৯২.৯-তে দাঁড়াচ্ছে, যদিও সর্বভারতীয় গড় ১০৮.৮— অর্থাৎ, আমাদের রাজ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সংখ্যায় অষ্টম শ্রেণির পর স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে।
জেলাভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেল, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১০০ জন ছাত্রী-পিছু ছাত্রের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কালিম্পং জেলায় (৯৬.০), এর পরে যথাক্রমে দার্জিলিং (৯৪.০), ঝাড়গ্রাম (৯৩.৬) ও কলকাতায় (৯০.৫)। মাঝামাঝি স্তরে থাকা বড় জেলাগুলি যথাক্রমে পূর্ব মেদিনীপুর (৮৭.৩), উত্তর চব্বিশ পরগনা (৮৬ .৩), দক্ষিণ দিনাজপুর (৮০.২), হুগলি (৭৯.০), দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা (৭৭.৮) ও পূর্ব বর্ধমান (৭৭ .৪)। আর ছাত্রের সংখ্যা সবচেয়ে কম উত্তর দিনাজপুর (৬০.৫), মুর্শিদাবাদ (৬১.৪) আর মালদহে (৭১.৪)। এমনকি মাধ্যমিক স্তরেও (নবম-দশম শ্রেণিতে) ১০০ জন ছাত্রী-প্রতি ছাত্রের সংখ্যা উত্তর দিনাজপুরে ৭৩.৯ , মালদহে ৮৪.৩ ও মুর্শিদাবাদে ৮৫.১। অর্থাৎ, অষ্টম শ্রেণির পরেই তুলনামূলক ভাবে উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদে অনেক বেশি সংখ্যায় ছেলেরা স্কুল
ছেড়ে দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে, এরা দল বেঁধে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজে যোগ দিচ্ছে। সমস্যাটার এখানেই শুরু— এই সব অঞ্চলের ছেলেরা যে-হেতু অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে অল্প বয়সেই কাজে যোগ দিচ্ছে মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে, এদের শ্রমিক হিসাবে দক্ষতা অর্জন করে বেশি মজুরির কাজ জোগাড় করা আগামী দিনে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে দারিদ্রের যে দুষ্টচক্র— অদক্ষতা, তার ফলে কম আয়, এবং তার ফলে দারিদ্র, ও তার ফলে অদক্ষতা— এরই ঘূর্ণাবর্তে এরা আবর্তিত হতে থাকছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা না করলে আগামী দিনে ওই জেলাগুলির সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে না। আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়ে যাবে।
এই প্রসঙ্গে তাইল্যান্ডের একটি সামাজিক সমস্যার উল্লেখ খুবই যথাযথ। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই তাইল্যান্ডে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার উপরে বিশেষ জোর দেওয়া শুরু হয়। মেয়েরা ২০১০ সালের মধ্যে ছেলেদের থেকে অনেকটাই বেশি এগিয়ে যায়। যেখানে ১৯৯০ সালে কলেজে স্নাতক স্তরে তিন জন ছাত্র-প্রতি ছাত্রী-সংখ্যা ছিল মাত্র দু’জন, ২০১০ সালে ছাত্রী-সংখ্যা ছাত্রের দ্বিগুণ হয়। সে দেশে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আগেই পড়াশোনার পাট চোকানোর কারণ অনেকটাই অর্থনৈতিক, আর এই অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সামাজিক সমস্যার জন্ম। তাইল্যান্ডের মেয়েদের পক্ষে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমকক্ষ পাত্র জোগাড় করা এখন সত্যিই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে বিবাহ বিলম্বিত হচ্ছে অথবা অবিবাহিত মেয়েদের সংখ্যার লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে যে, ২০১০-১১ সালে আমাদের রাজ্যে স্নাতক স্তরে ১০০ জন ছাত্রী-প্রতি ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১৩৩.৭। আর ২০২০-২১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯২.৯ জন। সর্বভারতীয় গড় ১০৫.৩। ছেলেদের বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই বিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার যে প্রবণতা বিশেষ করে উত্তর দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলায় পরিলক্ষিত হচ্ছে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক কালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দুর্নীতির যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, আর বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যা হাল, তাতে কাউকে তো এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, ভাল করে লেখাপড়া করলে চাকরি একটা হবেই হবে। অতএব, এই সমস্যাকে ঠেকানোর অস্ত্র কোথায়?