প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অবশেষে দেশের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির বদলের বাতাস বইতে শুরু করল এ রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষায়। কোভিড কালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় অভিযোগ উঠেছিল দেশের ‘আধুনিক’ নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি আত্মনির্ভর শিক্ষার মডেল নয়, বরং সেটা আমেরিকান শিক্ষার অন্ধ ‘কপি পেস্ট’ সংস্করণ! ফলে এ দেশে শিক্ষায় বিশ্বায়নের মডেলকে বিপণনের লক্ষ্যে বহু সংস্কারের কথা সেই নীতিতে সুপারিশ করা হয়েছে দেশের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেই। কিন্তু সেই সংস্কার এ দেশের জলহাওয়ায় কতটা শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর হবে, সেই আশঙ্কা সঙ্গে নিয়েই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে রাজ্যে রাজ্যে।
শিক্ষার নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই যুক্ত শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিকাঠামো এবং বিনিয়োগ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কোঠারি কমিশন থেকে শুরু করে হালের কস্তুরিরঙ্গন কমিশন, শিক্ষায় দেশের জিডিপির ৬% বরাদ্দের কথা বললেও সরকারের অনুদান আজ অবধি তার লক্ষ্যের অর্ধেক মাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষায় নীতি পরিবর্তন যে দোকানের সাইনবোর্ডের বদলের মতো নয়, সেটা রাষ্ট্র বুঝতে অপারগ হলে শিক্ষার সঙ্কট বাড়বে বই কমবে না।
ইতিমধ্যে দেশ জুড়ে এবং রাজ্যে স্নাতক কোর্সের মেয়াদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে সমতা রক্ষার তাড়নায় রাতারাতি তিন থেকে চার বছরে বদলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সেই মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা, ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি এবং আনুষঙ্গিক পরিকাঠামোর বৃদ্ধি বিবেচনা উপেক্ষা করে কোর্সের যান্ত্রিক মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রথম বছরেই এই রাজ্যে কলেজে কলেজে পড়ুয়াদের ভাটার টান দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় এ বার বিদ্যালয় শিক্ষায় পড়ুয়াদের মূল্যায়ন এবং পাঠ্যক্রম বদলের ছুরিকাঁচি চালাতে উদ্যত হয়েছে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা সংসদ। প্রত্যাশিত ভাবেই জাতীয় শিক্ষানীতির টোটকা মেনেই কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সিমেস্টার ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা করেছে সংসদ। ফলে এ বারের মাধ্যমিক পাশ করা পড়ুয়াদের একাদশ শ্রেণি থেকেই চালু হবে নতুন এই সিমেস্টার ব্যবস্থা। ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা হলেও পরিবর্তিত সিমেস্টার ব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু আজ না হোক কাল সেই চূড়ান্ত পাঠ্যসূচি ঘোষিত হলেও সেই পাঠক্রম চালানোর উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে কি না, এই প্রশ্ন ঘিরেই আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে।
কোনও সন্দেহ নেই যে, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ুয়াদের মূল্যায়নের মেয়াদকাল কমানোর ঝোঁক সর্বত্র। সেই কারণেই দ্বিবার্ষিক কিংবা বার্ষিক পরীক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তুলনায় স্বল্প মেয়াদের সিমেস্টার পরীক্ষা ঢের বেশি কার্যকর এবং উন্নত। সিমেস্টার ব্যবস্থায় সাধারণত একটা শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যক্রমকে দু’টি সিমেস্টারে ভাগ করা হয়। এমনকি প্রতিটি সিমেস্টারের মেয়াদের অন্তর্বর্তী সময়ে ‘মিড-টার্ম’ সিমেস্টার পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকে বহু ক্ষেত্রেই, যাতে ছোট ছোট সময়ের ব্যবধানে পড়ুয়াদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা যায়। মূল্যায়নের মেয়াদ কম হয় বলে সেই পরীক্ষায় পড়াশোনা কিংবা পড়া মুখস্থ রাখার চাপ অনেকটাই কম হয়। তাই পড়ুয়াদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সিমেস্টার প্রথা পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত।
কিন্তু এমন উন্নত পরীক্ষাব্যবস্থা অনুন্নত পরিকাঠামোর উপর চেপে বসলে আখেরে সেটা ‘পর্বতের মূষিক প্রসব’ হয়ে উঠবে কি না, বিতর্ক সেখানেই! ইতিপূর্বে এই রাজ্যে প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়েছিল পড়ুয়াদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্যটি ঠিক কি না, সে বিতর্ক অনেক কাল ধরে চলেছে, কিন্তু তাতে আর না ঢুকে অন্তত এটুকু বলাই যায় যে, সেই ব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে পঞ্চম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতির বিশেষ দক্ষতার দরকার ছিল। তার অভাবে মাঠে মারা যায় সেই উদ্দেশ্য। ফের কয়েক দশক পর এ বার স্কুলে স্কুলে তড়িঘড়ি সিমেস্টার প্রথা চালুর ক্ষেত্রে তেমনই সম্ভাবনা দেখছে অনেকেই।
সিমেস্টার প্রথায় সর্বাধিক প্রয়োজন উপযুক্ত সংখ্যায় দক্ষ শিক্ষকের। ফলে রাজ্যের কিংবা দেশের স্কুলগুলিতে এই মুহূর্তে ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত কেমন, তার উপরেই নির্ভর করবে নতুন এই মূল্যায়ন ব্যবস্থার কার্যকারিতা। সাম্প্রতিক কালে লোকসভার প্রশ্নোত্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, এই রাজ্যে সরকারপোষিত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সেই অনুপাত ১:৪১, যেটা দেশের জাতীয় গড়ের থেকে অনেকটাই নীচে। শুধু তাই নয়, দেশের শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী স্কুলে কাঙ্ক্ষিত ছাত্র-শিক্ষকের যে অনুপাত থাকা উচিত, রাজ্যের ৪৯.৫% সরকারপোষিত স্কুলে সেই পরিমাণ শিক্ষক নেই। ফলে এই অবস্থায় বার্ষিক মূল্যায়ন প্রথা তুলে নতুন সিমেস্টার ব্যবস্থা চালু করলে বর্তমান পরীক্ষার আড়াই গুণ বেশি খাতা দেখার ধাক্কা সামলানো হবে কী করে, সেই উত্তর অধরা।
নতুন এই ব্যবস্থায় বোর্ড যে দু’টি পরীক্ষা নেবে, তার একটা হবে ‘এমসিকিউ’ মডেলে, আর অন্যটা হবে বিষয়ভিত্তিক ছোট প্রশ্ন। বোর্ডের এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তরপত্রের মূল্যায়ন হবে প্রযুক্তিনির্ভর ওএমআর শিট ব্যবহার করে যার মূল্যায়ন করবে কোনও এজেন্সি। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে সেই এমসিকিউ বিষয়ের খাতা এজেন্সি দিয়ে নয়, দেখতে হবে স্কুলের শিক্ষকদেরই।
শুধু খাতা দেখাই নয়, সিমেস্টার ব্যবস্থায় স্কুলে আবশ্যিক পাঠ্য বিষয়ের পাশাপাশি বাড়ার কথা ঐচ্ছিক বিষয়ের সংখ্যা। এ রাজ্যে যেমন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সম্প্রতি ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে ডেটা সায়েন্স কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর মতো বিষয় খোলা হলেও সেটি পড়ার সুযোগ শহর-লাগোয়া কিছু স্কুলে ছাড়া জেলার স্কুলগুলিতে অধরা। সরকারি স্তরে শিক্ষকদের বদলি প্রথা চালু হওয়ার পর রাজ্যে জেলা স্কুলগুলিতে শিক্ষকের ঘাটতির প্রভাব সর্বাধিক। পাশাপাশি রাজ্যে শিক্ষক দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে আজ উপযুক্ত সংখ্যায় শিক্ষকের নিয়োগ প্রশ্নের মুখে। এমন অবস্থায় হঠাৎ করে সিমেস্টার ব্যবস্থা চালু হলে লেখাপড়া নতুন করে বিশ বাঁও জলে পড়বে বলেই আশঙ্কা।
নতুন শিক্ষানীতির ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী, দশম শ্রেণির পর থেকে বিজ্ঞান কলা বাণিজ্যের ভেদরেখা তুলে দিতে হবে। ফলে ‘যেমন খুশি চাই’ ঢঙে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিষয় নির্বাচনের সুযোগ পড়ুয়াদের দেওয়ার মতো শিক্ষক আছে কি? মনে রাখা উচিত, শিক্ষকের এই অভাব কেবল এই রাজ্যের স্কুলেই আবদ্ধ নয়, গোটা দেশ জুড়েই সরকারপোষিত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের স্কুলগুলির এক-তৃতীয়াংশেই কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার শিক্ষক অমিল। ফলে এমন ভয়াবহ শিক্ষকের সঙ্কটে পড়ুয়াদের মূল্যায়ন বদলের হাঁকডাকে হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে স্কুলে পঠনপাঠনের দৈন্যদশা।
রাজ্যের তড়িঘড়ি এই সিমেস্টার ব্যবস্থা চালুর পিছনে আরও এক যুক্তি কেন্দ্রীয় বোর্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রাজ্য বোর্ডের সাযুজ্য রক্ষা করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় বোর্ডের বেসরকারি স্কুলগুলিতে দ্বাদশ স্তরে যেখানে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ১:১৮, সেখানে তার অর্ধেকের কম শিক্ষক নিয়ে রাজ্য বোর্ডে সিমেস্টার ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা— খোয়াব দেখার শামিল। এক দেশ এক সিমেস্টার এক মূল্যায়ন তখনই সম্ভব, যখন পরিকাঠামোর মান অভিন্ন হয়ে ওঠে। অন্যথায় নয়।
আসল কথা, সিমেস্টার ব্যবস্থায় বদল কেবল পরীক্ষার সংখ্যায় নয়, বরং পঠনপাঠনের পরিকাঠামোয় বেশি জরুরি। সাম্প্রতিক সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে যে, দেশের শুধুমাত্র ২৪% স্কুলে পঠনপাঠনের মানানসই ইন্টারনেট কিংবা প্রজেক্ট-এর এর মতো পরিকাঠামো রয়েছে। এ রাজ্যেও চেহারাটাও ভিন্ন কিছু নয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি— বিদ্যালয় শিক্ষার পরিকাঠামোর মূল্যায়ন এবং সেই অনুযায়ী সিমেস্টার ব্যবস্থা চালুর সরকারি উদ্যোগ। অন্যথায় উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার মোড়কে (আরও) অবমূল্যায়ন ঘটবে সরকারপোষিত শিক্ষাব্যবস্থার, যার উপরে নির্ভরশীল লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়ারা।