যুদ্ধ? পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন রাজনৈতিক সংঘর্ষের পরে শান্তিরক্ষার চেষ্টা করছে পুলিশবাহিনী। ৮ জুলাই ২০২৩, মালদহ। ছবি: পিটিআই।
পঞ্জাব পুলিশের এক জওয়ানের সাক্ষাৎকার দেখলাম টিভিতে। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ঘটা হিংসার বিষয়ে তিনি বলছেন, “এ রকম কোথাও দেখিনি, ভারতের কোথাও এখন এই জিনিস হয় না।” সাক্ষাৎকারটি দেখে একটু মন খারাপ হয়ে গেল— সত্যিই কি আমরা তা হলে অন্য রাজ্যের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি? শিল্পে পিছিয়ে পড়া, বা কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়া, এ সব নিয়ে অনেক দিন ধরেই অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু মানসিকতায় পিছিয়ে পড়া নিয়ে এত দিন কিছু আশা ছিল, এখন সেটুকুও যাচ্ছে। সংস্কৃতির দিক থেকেও কি তা হলে আমরা পিছিয়ে পড়লাম? গণতন্ত্র তো সংস্কৃতির ব্যাপার, সেটাও ধরে রাখতে পারছি না?
খুব বেশি দিনের কথা নয়, যখন আমরা অন্য কিছু প্রতিবেশী রাজ্যে কেন রাজনৈতিক হিংসা হয় তা নিয়ে আলোচনা করতাম, আর মাঝে-মাঝে শিউরে উঠতাম। একটি ঘটনার কথা বলি। ডিগ্রি গবেষণা শুরু করার কিছু দিন পর প্রথম সেমিনার করতে দিল্লি যাচ্ছি। একটু উত্তেজিত। ট্রেন যখন বিহার দিয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরাতে দু’জন স্থানীয় পুলিশকর্মী উঠলেন, এবং জায়গা আছে দেখে বসে পড়লেন। কিছু ক্ষণ পর খেয়াল করলাম, তাঁরা স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছেন। টানা তিন ঘণ্টা তাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার নির্বাচন, কে কোথায় জিতল, কোথায় কী ঘটেছে, তাই নিয়ে আলোচনা করে গেলেন। তিন ঘণ্টা ধরে ‘চুনাও’ কথাটা প্রায় হাজার বার শুনলাম। কিছুটা বিরক্ত হয়েই ভাবছিলাম, এঁদের কি অন্য কিছু নিয়ে কথা বলার নেই? এত ‘চুনাও, চুনাও’ করার কী আছে, আর রাজনীতি নিয়ে সর্ব ক্ষণ আলোচনা করারই বা কী আছে!
এখন বুঝি যে, আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে বিহারবাসীর জীবনে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গি ভাবেই জড়িত ছিল। এর সঙ্গে বিহারের তখনকার অর্থনৈতিক অবস্থার যোগসূত্র থাকতে পারে। যত অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন, তত সাধারণ মানুষ রাজনীতি নামক প্রতিষ্ঠানটির উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতি সমাজকে প্রভাবিত করে, তাই কোনও অঞ্চলের অর্থনৈতিক স্তর যে সেই অঞ্চলের সামাজিক স্তরকেও প্রভাবিত করবে, সে আর আশ্চর্য কী! তাই তাদের জীবনময় ‘চুনাও’ আর ‘চুনাও’। সে দিন ট্রেনে এই উপলব্ধিতে শিউরে উঠেছিলাম— ভেবেছিলাম, ভাগ্যিস আমাদের রাজ্যে জীবন এমন ‘চুনাও’-ময় নয়। একটু নিশ্চিন্তও লেগেছিল। কিন্তু ভাবতে পারিনি যে, বিধাতা অলক্ষ্যে হাসছেন। সে দিন ছিলাম ‘গোবর’, ‘ঘুঁটে’ হতে বেশি সময় লাগল না।
অর্থনীতির ছাত্র হিসাবে অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন নিয়ে ভাবতেই হয়। অর্থনীতি বিষয়টির একটি মূল লক্ষ্য হল, কী ভাবে অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন ও দারিদ্র দূর করা যায়, কী করে জনসাধারণের জীবনধারণকে উন্নত করা যায়, কোন পথে আর্থসামাজিক অসাম্য দূর করা যায়, তা নির্দেশ করা। এর জন্য কত তত্ত্ব, কত গণিত ও কত সংখ্যাতত্ত্বের চর্চা ও অবতারণা। অনুন্নয়ন কেন থাকে, দারিদ্র দূরীকরণ কেন এত কঠিন, কী করলে মানুষকে দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে বার করে আনা যায়, সেই নিয়ে চর্চা বহু দিনের। আমাদের দেশ বহু দিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল, তারা আমাদের সর্বস্ব শোষণ করে নিয়ে গেছে। তাই স্বাধীনতার পর আমাদের অবস্থা ছিল করুণ। ‘গ্রোথ থিয়োরি’ বা প্রগতি তত্ত্বের পরিভাষায় একে বলে ‘ইনিশিয়াল কন্ডিশন’ বা প্রাথমিক অবস্থা। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতকেই ধরছি, কারণ ১৯৪৭-এ আমাদের পুনর্জন্ম। সেই করুণ অবস্থা থেকে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানো। ১৯৯১-এর আর্থিক উদারীকরণের পর উন্নয়ন গতি পায়। আস্তে আস্তে ভারত বদলাতে শুরু করে। এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। কিন্তু এত অনুন্নয়নের মধ্যেও আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ছাড়িনি। ষাট, সত্তর বা আশির দশকে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে একটি ধারণা বহুলপ্রচারিত ছিল যে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, গণতন্ত্র থাকবে না, ছোট ছোট জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে আলাদা হয়ে যাবে ও অবশেষে ভারত ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে। সে রকম কিছু হয়নি এত দারিদ্রের মধ্যেও। বরং গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়েছে, ভারত মজবুততর হয়েছে।
গণতন্ত্রে আমরা যাঁদের নির্বাচন করি, আশা করি যে, তাঁরা আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাবেন। এটাই কাম্য। না পারলে পাঁচ বছর পর তাঁদের ‘চাকরি নট’। এটাই গণতন্ত্রের নির্যাস। কিন্তু অর্থনীতি চর্চা করতে গিয়ে যখন উপলব্ধি করলাম যে, রাজনীতিকরা নিজের স্বার্থে একটি অঞ্চলকে অনুন্নত রাখতে পারেন, মৃদু ধাক্কা খেয়েছিলাম। ‘মৃদু’ বলছি, কারণ এ রকম একটি ধারণা হয়তো আমাদের ছিলই— কিন্তু যখন অর্থনৈতিক ও গাণিতিক তত্ত্ব দিয়ে এর প্রমাণ দেখলাম, তখন ধারণা থাকা সত্ত্বেও ঝাঁকুনি লাগল। যাঁদের ক্ষমতায় আনি দেশের-দশের উন্নতিসাধনের জন্য, তাঁরাই আমাদের অনুন্নত রাখছেন! এতে কোনও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কী লাভ? বুঝতে সময় লাগে না যে, যত বেশি অনুন্নয়ন, যত কম কাজের সুযোগ, জনসাধারণ ততই রাজনৈতিক দলের উপরে নির্ভরশীল। তখন রাজনীতিই হল কাজ, রোজগারের একমাত্র জায়গা। তাই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক— ‘তোমরা আমায় ভোট জোগাড় করে দাও, আমরা তোমায় অর্থ, ক্ষমতা, দান-খয়রাতি ও জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দেব। না হলে দাম চোকাতে হবে।’ তাই প্রাণপাত করে ভোটের দিন মাঠে নামা, রাজনৈতিক দলের কৃপা পেতে ভোট লুট আর নরসংহার।
একটি অঞ্চলের অর্থনীতি যত অনুন্নত, সেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ তত কম। মানুষকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজের উপর নির্ভর করতে হয়। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিজের কাজ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব কোনও রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে। এটি আরও সত্য আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত দেশে। তাই মানুষকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তা হলে অনুন্নয়ন একটি হাতিয়ার হতেই পারে। একটি বৃহৎ অংশের মানুষ তখন রাজনৈতিক দলগুলির উপর নির্ভরশীল, যা রাজনৈতিক দলগুলির জন্য আদর্শ। তাই একটি বৃহৎ ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অনুন্নয়নের একটি মানদণ্ড বলাই যায়। আর যদি মানুষ মনস্তাত্ত্বিক দারিদ্রের মধ্যে ঢুকে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। জনগণের যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকে, তাদের দাবিদাওয়া কম থাকে, তাদের খুশি রাখা সহজ। পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য খুব পরিশ্রমের দরকার নেই। পরজীবীময় সমাজকে শাসন করা, রাজ্যপাট চালানো খুব পরিশ্রমসাধ্য নয়।
পঞ্জাব পুলিশের জওয়ানের কথার সূত্র ধরে মনে হয়, আমাদের দেশের কিছুটা প্রগতি হয়েছে। কিছু রাজ্যে রাজনৈতিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক হিংসার সংস্কৃতির অবসান হয়েছে। অন্য রাজ্যের মানুষ আর রাজনীতির উপর ততটা নির্ভরশীল নয়, যা স্বস্তির কথা। কিন্তু এক সময় সংস্কৃতিগত ভাবে অনেক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন পশ্চাৎপদ, আমরা কেন উল্টো দিকে হাঁটছি, সেটা ভাবার বিষয়। আশা করি রাজনৈতিক ও নির্বাচনকেন্দ্রিক হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমরা যা ভাবছি, দেশ তা কাল ভাববে না। গোপালকৃষ্ণ গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তি এখন ইতিহাস। সেটা যেমন দুঃখের, আবার এক দিক থেকে স্বস্তিরও বটে।