ছাত্রছাত্রীদের উত্তরণের পথ দেখিয়ে দিতে পারেন শিক্ষকরাই
school

আরামের অভ্যাসটুকু ছেড়ে

এক দিকে শিক্ষকের অভাব, অন্য দিকে পড়ুয়াদের চলে যাওয়া। এই দুই ভিন্ন গল্পের মধ্যে কোথাও একটা মিল আছে। মিলটা শিক্ষকদের মনোভাবগত।

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:১৪
Share:

ইস্কুলের কথা।

শিক্ষক দিবসের আগে ও পরে কথা বলার অবকাশ হল ইস্কুলের মাস্টারমশাইদের সঙ্গে, দু’টি আলাদা আয়োজনে। সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের বাইরে নানা রকম অসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ছাত্রছাত্রীদের চলে যাওয়া যখন অনিবার্য হয়ে উঠছে, তখন এই মাস্টারমশাইদের কাছে জানতে চাইছিলাম ইস্কুলের কথা। সরকারি ও সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলির সমস্যা কী, তা নিয়ে আমরা অনেক কথা শুনি, অনেক কথা বলিও। সেই শোনা-বলার মধ্যে আমাদের তাৎক্ষণিক কৌতূহল মেটানোর ইচ্ছে বড় হয়ে ওঠে, হতাশা ও রাগ প্রকাশের দুর্নিবার চাহিদা প্রাধান্য পায়। যারা এই সমস্যার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, সেই পড়ুয়াদের কথা আমরা তেমন করে ভাবি না।

Advertisement

দেবব্রত অধিকারী পুরুলিয়ার একটি প্রান্তিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর বিদ্যালয়ের এখন প্রধান সমস্যা কী? বললেন, প্রধান সমস্যা উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান বিষয়ক পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। বিজ্ঞান যে সবাইকে পড়তেই হবে, এমন নয়— ছেলেমেয়েরা নিজের ইচ্ছা ও প্রবণতা অনুযায়ী বিজ্ঞান পড়বে, বা পড়বে না। আমাদের ভদ্রলোক, শিক্ষিত, মোটের উপর অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল পরিবারগুলিতে এখন ‘বিজ্ঞান পড়তেই হবে’ এই সংস্কার থেকে হয়তো কিছুটা বেরিয়ে আসা গিয়েছে। কিন্তু সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কী পড়ব, এই নির্বাচনের অধিকার যদি শিক্ষার্থীর থাকে, এবং পারিবারিক সামর্থ্যের সুবাদে সেই নির্বাচিত পথে সে এগিয়ে যেতে পারে, তা হলে গোল থাকে না। কিন্তু বিজ্ঞান পড়ার সুযোগই যদি নাগালে না থাকে?

এটাই এখন বহু ছেলেমেয়ের কাছে বিরাট সমস্যা। গ্রামে মফস্‌সলে বহু এলাকায় স্কুলপড়ুয়াদের বিজ্ঞান পড়ার সুযোগই নেই। অনেক ক্ষেত্রেই কাছাকাছি সরকারি বা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে, কিন্তু পড়াবার শিক্ষক নেই। সমস্যাটা অনেক দিন ধরেই চলছে, তবে সম্প্রতি তার মাত্রা আরও বেড়েছে। বদলি নীতির সুবিধা নিয়ে শিক্ষকেরা অনেকেই চলে গেছেন তাঁদের বাড়ির কাছাকাছি বিদ্যালয়ে, ফলে গ্রামের ইস্কুলে বিজ্ঞান পড়ার উপায় নেই। প্রধান শিক্ষক দেবব্রতবাবু নিরুপায়— অনেক সময় উপযুক্ত বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাবে তিনি ভিডিয়োতে বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা চালিয়ে দেন। পড়ুয়ারা পর্দায় সেই সব ছবি ও কথা দেখে-শোনে। শিক্ষক থাকলে যেগুলি পরিপূরক বা সহায়ক উপায় হয়ে উঠতে পারত, এখন সেগুলি নিরুপায়ের একমাত্র উপায় হয়ে উঠছে।

Advertisement

বিজ্ঞান পড়তে চেয়েও পড়তে না পারা শিক্ষার অধিকার হারানোর শামিল। তার ফলে কেবল ব্যবহারিক জীবনে সামর্থ্য অর্জনের সুযোগই হাতছাড়া হয় না, বৃহত্তর ক্ষতিও হয়। বিজ্ঞান পড়লে কার্যকারণ সূত্রের ও যুক্তির যে জগৎ এক জন পড়ুয়ার সামনে খুলে যায়, তা গ্রামসমাজের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান নিয়ে পরবর্তী কালে পড়ুয়াটি যদি উচ্চতর শিক্ষায় না-ও যায়, যদি অন্য কিছু নিয়েও পড়ে, তা হলেও বিজ্ঞান পড়াটা অকাজের হয় না। বিশেষ করে গ্রামসমাজের ক্ষেত্রে, পুরুলিয়ার মতো প্রান্তিক গ্রামসমাজের ক্ষেত্রে, নিকটবর্তী ইস্কুলে চাইলেও শিক্ষকের অভাবে বিজ্ঞান পড়া যাচ্ছে না, এ খুবই ক্ষতিকর। বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছা ও মন যেটুকু তৈরি হয়েছিল, এর ফলে তা ক্রমে হারিয়ে যাবে।

অন্য স্কুলটি কলকাতার কাছেই। বাংলার শিক্ষক বলছিলেন তাঁর ইস্কুলের কথা। এক সময় হাজার-বারোশো পড়ুয়ায় গমগম করত স্কুলটি। এখন মেরেকেটে পাঁচ-ছ’শো। সংখ্যা ক্রমশই কমছে। মাস্টারমশাইরা ভয় পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন। আগ্রহী ছাত্রছাত্রী কে না চান! কয়েক প্রজন্মের শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতিলালিত পরিবারের ছেলেমেয়েরা তো এই স্কুলগুলিতে পড়তে আসত কিছু দিন আগেও। তাদের পড়ানোর মধ্যে যে আনন্দ পেতেন, যে ভাবে উদ্দীপিত হতেন শিক্ষকরা, এখন সেই আনন্দ আর উদ্দীপনা খুঁজে পান না। যে পাঁচ-ছ’শো পড়ুয়া এখন আসে, তারা খানিক নিরুপায় হয়েই আসে। উপযুক্ত সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত সামর্থ্য আছে যে পরিবারগুলিতে, তাদের অভিভাবকেরা সন্তানদের জন্য এখন আর এই বিদ্যালয়ের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। পড়ে থাকা কিংবা নিরুপায় হয়ে আসা পড়ুয়াদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের নতুন করে নির্মাণ করার পথে এগোতে গিয়ে শিক্ষকেরা হতাশ হন। তাঁদের মনে হয়, আগে যে ভাবে পড়াতেন সেই ‘উচ্চমান’-এর পদ্ধতি তো এই ‘পড়ে থাকা’দের কাজে লাগবে না।

এক দিকে শিক্ষকের অভাব, অন্য দিকে পড়ুয়াদের চলে যাওয়া। এই দুই ভিন্ন গল্পের মধ্যে কোথাও একটা মিল আছে। মিলটা শিক্ষকদের মনোভাবগত। যাঁরা নিজেদের বাড়ির কাছাকাছি চলে গেলেন, তাঁরা উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবেই চলে গেলেন, বাড়ির কাছে পরিবারের কাছে থাকবেন বলেই চলে গেলেন ইস্কুল থেকে। এই আরাম তো আমরা সকলেই চাই। এই আরামের অভ্যাস থেকেই কিন্তু ছাত্রছাত্রী কমে যাওয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। যে শিক্ষিত ভদ্রলোক পরিবারের পড়ুয়াদের একদা পেতেন তাঁরা, তাদের পড়িয়ে আরাম ছিল। তৃপ্তি ছিল, তাঁরা নিজেরা শিক্ষক হিসাবে যা অর্জন করেছিলেন তা দিতে পারার আরাম, আনন্দ। খুবই সঙ্গত সেই আনন্দ। কিন্তু সেই অভ্যস্ত আরাম ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন যখন, তখন হতাশ হয়ে পড়লে তো কষ্ট কমবে না। বরং যারা রইল, যারা আছে, সেই পড়ুয়াদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁরা তো নিজেদের পড়ানোর তার আর এক রকম করে বেঁধে নিতে পারতেন। আগে যে সুরে হত, এখন তার থেকে অন্য সুর লাগাতে হবে। সেই অন্য সুরের সামর্থ্যে পড়ুয়াদের খানিকটা তৈরি করে নিলে তখন আবার দেখা যাবে আগের সুর তাদের কানে ধরানো যায় কি না!

এ চেষ্টা অবশ্য কেউ কেউ করছেন। বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিএড কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে আসা মাস্টারমশাই বললেন, “জানেন, আমি যেখানে পড়াই সেখানে পড়তে আসে যারা, তারা একই সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবার থেকে আসে। বাবারা মদ্যপ। খেটে খায়। পড়তে চায় তারা। আমি চেষ্টা করি।” বুঝতে পারি, সংলগ্ন এলাকার মানুষজন যদি একই রকম আর্থ-সামাজিক পরিবেশের অন্তর্গত হন, তা হলে কাজটি তুলনায় সোজা। পড়ুয়াদের একই রকম ভাবে উদ্দীপ্ত করা যায়। বলা যায়, এই দেখো তোমাদের সামগ্রিক অবস্থা, চাইলে এর বাইরে আসতে পারো। তারা সামূহিক ভাবে সেই আহ্বানে আগ্রহী হতে পারে, সেই চেষ্টার সুফল এক সঙ্গে পেতে পারে। যেখানে পার্শ্ববর্তী এলাকায় নানা রকম মানুষের বসবাস— মূলত কলকাতা-সংলগ্ন অঞ্চলে— সেখানে পড়ুয়াদের মধ্যে এই ভাবে সামূহিক বোধ জাগিয়ে তোলা কঠিন। মাস্টারমশাই বলেন, “জানেন আমার উপর প্রত্যাশার চাপ। ওরা ভাবে তাদের বাবা মদ খাচ্ছে, মারছে— এর থেকে আমি ওদের মুক্তি দিতে পারি।” স্কুলশিক্ষিকা ঈপ্সিতা চৌধুরী বলেছিলেন কোভিড-পরবর্তী অবস্থার কথা। বলেছিলেন, তাঁরা দলবেঁধে খুঁজতে গিয়েছিলেন পড়ুয়াদের। কোভিডের পর অনেকে স্কুলে আসছে না কেন? গিয়ে দেখেন, ছেলেগুলি বাবাদের সঙ্গে গাছতলায় চোলাই বিক্রি করতে বসে পড়েছে।

ইস্কুলের গল্প এক রকম নয়, নানা রকম। মাস্টারমশাইদের ভূমিকাও এক রকম হলে চলবে কেন? প্রতিকূলতার চেহারা-চরিত্র অনুযায়ী তাঁদের কাজের বিধি স্থির করে নিতে হবে। কাজের বিধি তাঁরা স্থির না-ও করতে পারেন। আসলে শিক্ষক হিসাবে আমরা যারা শ্রেণিগত সুবিধে ভোগ করছি, আমরা আমাদের সন্তানদের দুধে-ভাতে থাকার ব্যবস্থা ঠিকই করে নেব। সরকারি ও সরকার পোষিত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। কিন্তু তার বাইরে আছেন যাঁরা, তাঁরা কী করবেন? দেবব্রতবাবু হেডমাস্টারির শত ঝামেলা সামলে সন্ধেবেলায় পিছিয়ে-পড়া পড়ুয়াদের সময় দেন। আমার পুরনো স্কুল রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ পুরুলিয়ার কর্তৃপক্ষের এবং কোনও কোনও শিক্ষকের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে গ্রামের পড়ুয়া মেয়েদের জন্য অবৈতনিক কোচিং সেন্টার। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম গত বছর, সেখানে ছেলেবেলা থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পড়ুয়াদের তৈরি করছেন তাঁরা। আরাম ও অভ্যাসের বাইরে মাস্টারমশাইদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ কিংবা সামাজিক হিতের দায়িত্বগ্রহণকারী সংস্থার উদ্যোগ এখনও বহু ক্ষেত্রে সচল। সচল বলেই, নয়-নয় করেও শিক্ষার চাকা ঘুরছে।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement