Society

জেদ অভিমান, দুই-ই স্বাভাবিক

সনজিদা কাদের জানাচ্ছেন, গত রমজান মাস থেকে তিনি হিজাব পরা শুরু করেছেন। তার আগে তিনি (অন্তত নিয়মিত ভাবে) হিজাব পরতেন না।

Advertisement

আকাশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৪ ০৮:২২
Share:

—প্রতীকী ছবি।

হিজাব পরার অপরাধে চাকরি চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের এক বেসরকারি আইন কলেজের শিক্ষিকা সনজিদা কাদেরের। সম্ভবত খবরটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়াতে হইচই শুরু হওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত পাল্টে সনজিদাকে তাঁর চাকরি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাতেই কি ঘটনাটায় ইতি টানা যায়? একটা ভুল-বোঝাবুঝি, তা-ও মিটিয়ে নেওয়া হয়েছে— অতএব আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই? না কি, এই ঘটনাটি এক বৃহত্তর দুঃসংবাদের দ্যোতক?

Advertisement

সনজিদা কাদের জানাচ্ছেন, গত রমজান মাস থেকে তিনি হিজাব পরা শুরু করেছেন। তার আগে তিনি (অন্তত নিয়মিত ভাবে) হিজাব পরতেন না। বছর দুয়েক আগে কর্নাটকে তৎকালীন বিজেপি সরকার শিক্ষাঙ্গনে হিজাব নিষিদ্ধ করায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কংগ্রেস সরকার হিজাব ফতোয়া তুলে নিলেও সুপ্রিম কোর্টে হিজাব ও ধর্মীয় অনুশাসন বিতর্কের পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়নি। অন্য দিকে, হিজাব পরার বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে ইরানের মহিলাদের আন্দোলনও দেখেছি অনতিঅতীতেই— যেখানে সাধের চুল কেটে ফেলে, হিজাব খুলে ফেলে, এমনকি ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করেও প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন অসংখ্য মুক্তিকামী নরনারী। ২০১০-এ চালু হওয়া শব্দবন্ধ ‘আরব বসন্ত’-এর সেও ছিল এক রকমের পুনরাগমন। সনজিদা কাদেরের বক্তব্যে উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গও। তিনি বলেছেন— “আমি ইরানে মেয়েদের উপরে হিজাব চাপানোর বিরুদ্ধে লড়াইও সমর্থন করি। আবার হিজাব পরে মেয়েরা ক্রিকেট খেলে, সাঁতার কাটে। হিজাব মেয়েদের ক্ষমতায়নে বাধা বলে মানি না।”

প্রশ্ন জাগে, এক জন মুক্তমনা উচ্চশিক্ষিত মানুষ হঠাৎ করে কোনও এক সকালে নিত্যনৈমিত্তিক হিজাব পরিধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন কেন? আপাতভাবে এ প্রশ্ন তুচ্ছ। ধর্মীয় ভাবাবেগকে মান্যতা দিয়ে পোশাক পরিধানের সিদ্ধান্ত একান্ত ব্যক্তিগত এবং তা কখনওই পূর্বনির্ধারিত নয়। কিন্তু শুধুই কি ধর্মীয় আবেগের বহিঃপ্রকাশেই এই সিদ্ধান্ত, না কি কোথাও গায়ের জোরে পরতে না দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা তৈরি করছে পাল্টা পরার জেদ? জোর করে হিজাব পরালে যেমন তা খুলে ফেলার জেদ তৈরি হয়, জোর করে হিজাব খুলতে চাইলেও তৈরি হতে পারে তা পরে থাকার জেদ।

Advertisement

শুধুই কি হিজাব পরার জেদ? শুধুই এক মুসলমান নারীর জেদ? না কি, চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ জেদ ধর্ম, লিঙ্গ বা সময়ের ব্যবধানকেও অতিক্রম করে যায়? বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কথা মনে পড়তে পারে— আমৃত্যু তালতলার চটি পরেছেন তিনি। সেই চটি খুলে ঢুকতে বলায় জাদুঘরে ঢোকেননি। ফিরে এসে আগুন ঝরানো চিঠি লিখেছেন ট্রাস্টির সম্পাদককে। এ বিষয়ে শুধু তাঁর প্রতিবাদপত্রই নয়, আরও অনেক চিঠিচাপাটি চালাচালি হয়েছিল সে সময়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছিলেন: “চটিজুতার প্রতি তাঁহার একটা আত্যন্তিক আসক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যে চটিজুতা ভিন্ন অন্য জুতা পায়ে দিতেন না, এমন নয়। আমরা যে স্বদেশের প্রাচীন চটি ত্যাগ করিয়া বুট ধরিয়াছি, ঠিক তা দেখিয়াই যেন বিদ্যাসাগরের চটির প্রতি অনুরাগ বাড়িয়া গিয়াছিল। বাস্তবিকই এই চটিজুতাকে উপলক্ষ করিয়া একটা অভিমান, একটা দর্প তাঁহার অভ্যন্তর হইতে প্রকাশ পাইত।”

সাদা চোখে মনে হচ্ছে, মুসলিম মহিলাদের মধ্যে শিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত নির্বিশেষে ক্রমশ হিজাব এমনকি বোরখা পরিধানের প্রবণতা বাড়ছে। হতে পারে যে, ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকার কারণে সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি বাড়ছে; অথবা, সেই কারণেই পিতৃতন্ত্র কঠোরতর হচ্ছে। কিন্তু, এমনটাও তো হতে পারে যে, পরিধানের হিজাব বা বোরখাই ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদ, এমনকি প্রতিরোধী মানসিকতার পাল্টা পোস্টার হয়ে উঠছে।

আবার এর পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে, ভিন্নতর একটি সমস্যারও জন্ম দিচ্ছে হিজাব বা বোরখার মতো পোশাক। পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডে ছবি থাকছে হিজাব বা বোরখা পরিধান না করে, অথচ পরীক্ষার ঘরে দেখা যাচ্ছে ব্যতিক্রমী ভাবে হিজাব বা বোরখা পরিধানের প্রবণতা। এমনকি ছবির সঙ্গে পরীক্ষার্থীর মুখ মিলিয়ে দেখার যে আবশ্যিক প্রক্রিয়া; সংখ্যায় নগণ্য হলেও সে ক্ষেত্রেও সহযোগিতা না করার মানসিকতা দেখা যাচ্ছে পরীক্ষা দিতে আসা একাংশের মধ্যে। অনেকের মতে, ইয়ারফোন, চুলের ভিতর বা অন্যত্র গুঁজে রাখা মোবাইল বা টুকলির কাগজ লুকিয়ে রাখার অবলম্বন হতে পারে বোরখা বা হিজাব।

ধর্মানুভূতিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে পরীক্ষক সব বুঝেও অযথা বিতর্কে জড়ানোর ভয়ে মেনে নিতে বাধ্য হন সব কিছু। স্বাভাবিক ভাবেই সেই ঘরে উপস্থিত অন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেমন তৈরি হচ্ছে প্রবল প্রতিক্রিয়া, তেমনই এই ঢেউ আছড়ে পড়ছে টিচার্সরুম থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বত্র। গুটিকয়েক পরীক্ষার্থীর অসৎ আচরণের ফলে প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িকতার পালে এসে লাগছে প্রয়োজনীয় বাতাস। শাঁখের করাতের মতো— আসতেও কাটছে, যেতেও কাটছে। প্রতি দিন অল্প অল্প করে কাটছে বলে আমরা বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে এক দিন আবিষ্কার করছি— কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা থেকে হিজাব বিতর্ক এসে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement