পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পারদ চড়ছে, রাজনীতিবিদরা নিত্যনতুন পসরা মেলে ধরছেন। ফাইল ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পারদ চড়ছে, রাজনীতিবিদরা নিত্যনতুন পসরা মেলে ধরছেন। কী কাজ করলে ভোটারের ঢল নামবে, রাজনৈতিক দলগুলিকে এটাই ভাবাচ্ছে। কাগজের খবর, টিভিতে লড়াই, হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে প্রচার-অপপ্রচার, প্রবল গরমের সঙ্গে ভোটের দামামা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও তা আগ্রহের বিষয়। এক দিকে নিয়োগ-দুর্নীতি, অন্য দিকে ঘোষিত বা অঘোষিত বিরোধী জোটের সম্ভাবনা শাসক শিবিরকে ভাবাচ্ছে। ধর্মীয় ভাবাবেগ, গোষ্ঠী বা এলাকাগত দ্বন্দ্ব শাসক দলের ভাবমূর্তিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, বড় প্রশ্ন। বিরোধীদের ক্রমাগত আক্রমণও কি রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে?সভা-সমাবেশ, মিছিল অন্য পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে?
দুর্নীতি নিয়ে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ, উচ্চ আমলাদের বিরুদ্ধেও ভিজিল্যান্স কেস ঝুলছে শোনা যায়। সাধারণ বাঙালি এ সব কোন চোখে দেখে? তারা কি এ সবের খোঁজ রাখতে চায় না? না কি রাজনীতি-সচেতন বাঙালি বড় দুর্নীতিকে চিনতে চেষ্টা করেছে, তার ফল অনুধাবন করতে শিখেছে?
অনেক সময় দুর্নীতির তদন্ত, আইন-আদালতের জটিলতা বুঝতে অসুবিধা হয় সাধারণ মানুষের। তাই গণমাধ্যম যে দিকে চালিত করে, সে দিকে চলে জনমতও। নতুন, আকর্ষণীয় খবর দিতে গিয়ে দুর্নীতির খবর অনেক সময় ফিকে হয়ে যায় টিভির পর্দায়, বড় নেতা মন্ত্রী আমলাদের শাস্তির কথাও খুব একটা শোনা যায় না। তবে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যা দেখে তা দাগ কাটে, ঘুষ বা কাটমানি দিতে হলে তার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। দীর্ঘ দিন ধরে এ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে কারও মনে হয়, টাকা দিয়ে যদি কাজ হয়, অসুবিধা কোথায়! কিছু দক্ষিণার বদলে কর ফাঁকি দিয়ে, জবরদখল করে, লাইসেন্স না নিয়ে কাজ চালানো গেলে তো ভাল। দক্ষিণ ইটালির মাফিয়া অধ্যুষিত এলাকায় সাধারণ মানুষ কী ভাবে এ ব্যবস্থায় জড়িয়ে গেছেন তা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে।
নিয়োগ-দুর্নীতির গভীরতা তাঁরাই বিশেষ ভাবে অনুধাবন করবেন যাঁরা বঞ্চিত। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে কি অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষ ক্ষোভ উগরে দেয়, না কি পাওয়ার আশায় বুক বাঁধে? কোনটা কেন্দ্রের প্রকল্প, কোনটা রাজ্যের, খুব সচেতন মানুষ ছাড়া বোঝা কঠিন। সরকারি পরিষেবা পেতে বহু মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়, এই সমস্যা নিরসনে সরকারকে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেওয়া একটা সদর্থক পদক্ষেপ। তবে মানুষের চাহিদা কতটা মিটল, বোঝা গেল না তথ্যের অভাবে। ভোটারের মন যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ভোটবাক্সে প্রতিফলন ঘটায় তবে বলতে হবে, প্রণব বর্ধন, দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তিন দশকের বেশি ভোটারদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কাজের কিছু প্রমাণ এখানে পাওয়া গেল।
প্রত্যেক ভোটার কি পূর্বপরিকল্পিত ছকে ভোট দেন? ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র অর্থনীতিবিদ, নোবেলজয়ী রিচার্ড থেলারের গবেষণার সূত্র ধরে বলা যায় যে, ভোটার বিভিন্ন কারণে ভোট দিতে পারেন, এমনকি আবেগেও। পঞ্চায়েত ভোটের পশ্চিমবঙ্গে কি সেই আবেগ আছে? ‘জমি যার লাঙল তার’, ‘গরিবি হটাও’ অতীতে নতুন আশার জন্ম দিয়েছিল, সে সব এখন কোথায়? কেন্দ্র-রাজ্য বঞ্চনা, যুদ্ধ জয়, রাষ্ট্রনেতার মৃত্যু, ধর্মের ধ্বজা ওড়ানোর মতো সাময়িক আবেগ অতীতে ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি আবেগ কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলন বা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই প্রকট হয়। পশ্চিমবঙ্গে জমির আন্দোলন, বিহারে জাতপাতের লড়াই, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ভূমিপুত্র-ভিত্তিক সংঘাত নাগরিকের মন উদ্বেলিত করেছে। সাধারণের জীবনযাত্রাকে তুচ্ছ করে বৃহত্তর স্বার্থে বলিদানের অঙ্গীকার মনে হতে পারে, এমন দীর্ঘমেয়াদি আবেগ চোখে পড়ছে না।
মানুষ বরং প্রযুক্তির ফানুসে উড়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার আধুনিকতা হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছে। কেন্দ্র-রাজ্য যা দেওয়ার দিক, সবটা তো উপরি। একটা বাজার বিড়ম্বনার গল্পও যেন ভেসে ওঠে। যা অর্জন করতে হয় তার জন্য রাষ্ট্র (বা পঞ্চায়েত)-এর কাছে যাব কেন? যা পাব না তার জন্য বার বার দরবার করব। রাস্তা, পানীয় জল, নিকাশিব্যবস্থার পরিবর্তন কি কাম্য? ভোট কি তা হলে গ্রামের পরিকাঠামোর নিরিখে হবে? একটা কথা না বললেই নয়, কোভিড ও কোভিড-উত্তর কালে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের প্রয়োজন হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন। ভ্যাকসিন থেকে রেশনব্যবস্থা দুর্দিনে বাঁচিয়েছে, বাজার অর্থনীতির ধ্বজাধারীরাও রাষ্ট্রের গুণ গেয়েছেন। রাষ্ট্রের এই অবদান কি মানুষের মনে ফিকে হয়ে গিয়েছে, না কি ভোটে সেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার হবে?
এ বারের ভোটে অনেক বিষয়, অনেক মুখ। নানা ঝড়ঝাপটার আড়ালে, নতুন ভোট সমীকরণের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটার কি চেনা ছন্দে ভোটের ময়দানে নামবেন, না নতুন পথে যাত্রার দুঃসাহস দেখাবেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা।