প্রহরা: নদিয়ায় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর রুট মার্চ। ২৫ জুন ২০২৩। পিটিআই।
ঢের ঢের নির্বাচন দেখেছি। ভোটে জোর-জুলুম, খুন-জখম, পুলিশ-সিআরপি ইত্যাদি দেখার অভিজ্ঞতাও কম হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে এ রকম একটা ঘেঁটে-যাওয়া পরিস্থিতি আগে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন-পর্বকে সেই কারণেই অভিনব বলা যায়।
এ বার নির্বাচন প্রক্রিয়ার সূচনা থেকে অনেক ঘটনাই ঘটছে চেনা ছকের বাইরে। ভুল-ঠিক, অধিকার-অনধিকার, তথ্য-তত্ত্ব মিলেমিশে একাকার। আর তারই ফলে তৈরি হয়েছে একটা বিচিত্র অবস্থা। কোন ‘অবতার’-এ কে কী করছে বা কোথায় কখন কোন খেলা চলছে, বোঝা ভার!
শুরু রাজীব সিন্হাকে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার করা নিয়ে রাজভবনের টালবাহানা থেকে। তাঁর নিয়োগে বিলম্বিত সম্মতিদানের কিছু দিন পরে হঠাৎ তাঁর যোগদানপত্র ‘গ্রহণ’ করা না হলে তাতে কারও কোনও ‘উদ্দেশ্য’ সফল হয় কি? প্রশ্নটি খুব জরুরি। কারণ, ভোট-প্রক্রিয়া চলাকালীন নির্বাচন কমিশনারের চেয়ার ধরে টানাটানি চললে তার প্রভাব কী হতে পারে, কর্তাব্যক্তিরা সেটা বোঝেন না, তা নয়।
নিয়োগের ফাইলে সই, শপথ পড়ানো এবং যোগদানের চিঠি ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে আইনের মারপ্যাঁচ কী আছে, সেই বিচারে যেতে চাই না। তবে নির্বাচন কমিশনারের সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব নিয়ে যিনি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার ‘অধিকার’ পেলেন, হঠাৎ ক’দিন কাজের পরে তাঁর নিয়োগপত্র না-নেওয়ার ঘোষণা কতটা যুক্তিগ্রাহ্য, এটা জানার আগ্রহ অবশ্যই থাকে। রাজভবন সেই প্রশ্ন জিইয়ে রেখে নজিরবিহীন বিতর্ক উস্কে দিল।
বিষয়টির কী নিষ্পত্তি হল, এখন মানুষ সেটাও জানতে চাইছে। যদি রাজ্যপাল এখনও ওই চিঠি ‘গ্রহণ’ না করে থাকেন, তা হলে নির্বাচন কমিশনার কোথায় দাঁড়িয়ে? আর যদি গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তা হলে রাজভবন থেকে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছিল কেন? এ বার কেউ যদি ভাবেন যে, এটা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ‘চাপে’ রাখার কৌশল, তাঁকেও খুব দোষ দেওয়া যায় কি?
বিধানসভা, লোকসভা বাদ দিলে পঞ্চায়েত ভোট আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বড়, যার বিস্তার আক্ষরিক অর্থে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। ফলে বাঁধুনি আঁটসাঁট করার প্রয়োজনও যথেষ্ট। তার জন্য কিছুটা সময় লাগে। এই বাস্তবতা মানলে পদে বসার পর দিনই রাজীব কিসের ভিত্তিতে এক দিনে ভোট করার কথা ঘোষণা করলেন, তার আগে প্রয়োজনীয় ক’টি বৈঠক করেছিলেন, সে সব প্রশ্নও সামনে এসে পড়ে। বস্তুত, এটা করে তাঁর অতি-তৎপরতা নিয়ে সংশয়ের পরিসর তিনি নিজেই করে দিয়েছেন। সত্যিই, এ জিনিস তো অতীতে হয়নি। নির্ঘণ্ট প্রকাশের আগে সব কিছু জেনে-বুঝে যাচাই করে নিতে ন্যূনতম যেটুকু সময় দরকার, রাজীব তা দিয়েছিলেন কি না, খুব স্পষ্ট নয়।
ইদানীং ‘নিরপেক্ষ’ বলে চিহ্নিত বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগ রাজনৈতিক বিতর্কের উপাদান হয়ে উঠেছে, দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পদও যার বাইরে নয়। সে ক্ষেত্রে নিশানায় থাকে কেন্দ্রের শাসক। তবে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ থেকেই এমন জলঘোলা এ বারেই প্রথম।
ভোট এখনও বাকি। কিন্তু মনোনয়ন-পর্ব থেকে হিংসার বিভিন্ন ঘটনায় রাজীবের ভূমিকা ও দক্ষতার দিকে আদালত এবং রাজ্যপাল ইতিমধ্যে একাধিক বার আঙুল তুলেছেন। কঠোরতম ভাষায় কার্যত তুলোধুনা করা হয়েছে তাঁকে। ‘না পারলে ছেড়ে দিন’ জাতীয় মন্তব্যও শুনতে হয়েছে কমিশনারকে। পদের গরিমা ও দায়িত্বের নিরিখে কমিশনারের উপর এই চাপ নিঃসন্দেহে সাংঘাতিক, যা এই স্তরের পদাধিকারীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ লোকের মনেও সন্দেহ দানা বাঁধে।
বিরোধীরা এতে উল্লসিত হতেই পারেন, যেমন হচ্ছেন। এ ছাড়া কোথাও কোনও স্তরে ভোট আটকে দেওয়ার উদ্যোগ থাকলে তাঁরা নড়েচড়ে বসবেন না, এমনও নয়। ‘সফল’ হবেন কি না, বলা কঠিন। তবে ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ভোট যদি করতে হয়, তা হলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনারকে সরিয়ে সেটা করা কত দূর সম্ভব, সেই সংশয় যথেষ্ট। পদটি সাংবিধানিক। ওটা করতে গেলে বহু কাঠখড় পোড়ানোর দরকার।
রাজ্যের নির্বাচন কমিশনারকে ‘বেছে’ দেয় রাজ্য সরকার। সাংবিধানিক এই পদে বসার পরে তাঁদের ‘নিরপেক্ষ’ বলে ধরে নেওয়াই বিধেয়। বাকিটা অবশ্যই অনুমানসাপেক্ষ। তবে অভিজ্ঞতা বলে, ‘অতি-ভক্তি’র প্রকাশ ঘটাতে গেলে অনেক সময় ‘প্রভু’র গালেই কাদা মাখিয়ে দেয়!
রাজ্যের একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে বিরোধ-বিতর্ক হয়েছে, যার সবচেয়ে বড় দু’টি উদাহরণ মীরা পাণ্ডে এবং সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। তাঁদের দু’জনের সঙ্গেই বিরোধ বেধেছিল রাজ্য সরকারের। এ বার এখনও পর্যন্ত সরকার বা শাসকের সঙ্গে কমিশনারের কোনও সমস্যা হয়েছে বলে জানা নেই। যা কিছু ঘটছে তা রাজভবন, বিরোধী রাজনীতি এবং আদালতের নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ ঘিরে।
ঘটনাচক্রে মীরা পাণ্ডে এই পদে বসেছিলেন বামফ্রন্ট আমলে। নির্বাচন কমিশনার হিসাবে ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী আনার জন্য নিজে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে তিনি নজির তৈরি করেন। সেটাই ছিল তৃণমূল সরকারের প্রথম পঞ্চায়েত ভোট। যদিও নির্মম সত্য এটাই যে, হানাহানি তাতেও রোধ করা যায়নি। সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় ২০১৫ সালে বিধাননগর ও আসানসোলের পুরভোটে যথেচ্ছাচার দেখে বহু জায়গায় পুনর্নির্বাচন করাতে চান এবং তার জন্য শাসকদের বিরাগভাজন হন। তার পরেই ভোটের এক দিন বাদে হঠাৎ তিনি ইস্তফা দেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া তখনও চলছে, ফলপ্রকাশ বাকি। স্বভাবতই সরকারের বিপাক তাতে আরও বাড়ে। গত পঞ্চায়েত ভোটে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার এ কে সিংহকে নিয়েও বিতর্ক উঠেছিল। তবে তা তেমন গুরুতর মাত্রা পায়নি।
আসলে সমস্যার মূল জায়গাটি তো তৈরি হয় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। সেটা মনোনয়নের সময় অশান্তি থেকে ভোট ও ফলপ্রকাশ পর্যন্ত সকল স্তরে প্রযোজ্য। ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশন যদি রাজ্য-প্রশাসনের পরিপূরক হয়ে উঠতে না চায়, তা হলে কমিশনারকে ‘মীরা পাণ্ডে’ হতে হয় অথবা চাপের মুখে পড়ে ‘বাধ্য’ হয়ে পদক্ষেপ করতে হয়। রাজীব সিন্হার ক্ষেত্রে বোধ হয় দ্বিতীয়টিই খাটে বেশি।
রাজনৈতিক যুক্তি যা-ই হোক, এ বার ভোট ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন অশান্তি এবং সব মিলিয়ে অন্তত দশ জনের মৃত্যুর ঘটনাকে ছোট করে দেখার কারণ নেই। আর এর সঙ্গে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন জড়িত বলেই সরকারের পক্ষেও এগুলি গুরুতর সতর্কবার্তা।
কোনও রাজ্য সরকারই খুশি হয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী ডেকে আনে না— তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের ‘অপারগতা’ মেনে নেওয়া হয়। এ বারেও নবান্ন প্রথমে চার রাজ্য থেকে পুলিশ আনার প্রস্তুতি নিয়েছিল। আদালতের কঠোর মনোভাবে ক্রমে চাহিদা বাড়িয়ে নির্বাচন কমিশন তথা রাজ্য আরও ৮০০ কোম্পানি চেয়েছে। কিন্তু সেখানেও কমিশনারের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। যদি বাহিনী আনতেই হয়, তবে প্রথমে জেলা পিছু মাত্র এক কোম্পানি চেয়েছিলেন কোন কাণ্ডজ্ঞানে? কেনই বা সরকারকেও ভর্ৎসনার মুখে ফেলে তিনি ফের দু’দফায় ৩১৫ এবং ৪৮৫ কোম্পানি চাইলেন? এটাই প্রমাণ করে যে, হয় তাঁর কোনও প্রাথমিক মূল্যায়নই ছিল না, নতুবা পরিণাম আঁচ করেননি। ফলে সরকারকেও কার্যত অপদস্থ হতে হল।
মীরা পাণ্ডের সময়েও সর্বমোট বাহিনী কাজে লাগানো হয়েছিল ৮২ হাজার। তবে ভোট হয়েছিল পাঁচ দফায়। অঙ্কটি কি কিছু বুঝিয়ে দেয়?