অপেক্ষমাণ: নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে চাকরির দাবিতে গান্ধীমূর্তির নীচে শিক্ষক পদপ্রার্থীদের অবস্থান। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি শিক্ষক নিয়োগ সমস্যার সুষ্ঠু ন্যায়ানুগ সমাধানের উদ্যোগ একেবারেই ত্যাগ করেছে? মধ্যরাতে অনশনরত নিয়োগপ্রার্থীদের উপর পুলিশের আক্রমণ যেন সেই ইঙ্গিত দিল। মনে করিয়ে দিল, ২০১৪-তে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝরাতে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর হামলার কথা। ঠান্ডা মাথা খাটিয়ে সুরাহায় অপারগ হলেই আমরা রাগ বা হিংসার আশ্রয় নিই। যাদের অসন্তোষের সম্মানজনক নিষ্পত্তি করতে চাই, তাদের লাঠিপেটা করি না।
তা বলে অনেকে যে লাঠির বদলে আলাপ-আলোচনার কথা বলছেন, তাও পুরোপুরি সঙ্গত নয়। আলাপ-আলোচনার অর্থ একটা বোঝাপড়ায় আসা, কিছু রাখা কিছু ছাড়া। এ ক্ষেত্রে মনে করার প্রবল কারণ, কিছু পদপ্রার্থী অন্যায় উপায়ে চাকরি পেয়েছে, অনেকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। এতে বোঝাপড়ার অবকাশ কোথায়? তা হবে সেই চোরের গল্পের মতো, যে হাজার টাকা চুরি করে টাকার মালিকের সঙ্গে রফা করে: “ঠিক আছে, তোমার পাঁচশো আমার পাঁচশো।”
২০১৪ বা ২০১৭ থেকে যে প্রার্থীরা নিয়োগের দিন গুনছেন, তাঁদের উদ্দেশে প্রাথমিক পর্ষদের সভাপতি দুটো কথা বলেছেন, দুটোই একদম ঠিক। এক, টেট (বা এসএসসির পরীক্ষা, বা কলেজ শিক্ষকদের নেট ও স্লেট) যোগ্যতার যাচাই মাত্র; চাকরিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া আলাদা। দুই, ২০১৪-র পরীক্ষার্থীরা নিয়োগের দু’দফা সুযোগ পেয়েও সফল হননি। মুশকিল এই, সেই নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে এত গভীর প্রশ্ন উঠেছে যে, অপেক্ষমাণ প্রার্থীদের দাবি বিশেষ ভাবে বিবেচনা না করলেই নয়। যাঁরা বেনিয়মের শিকার হয়েছেন, নিয়মকানুনের ওজর তুলে তাঁদের বিড়ম্বনা বাড়ানো অ-ন্যায়।
আরও অন্যায় ঘটে যদি মাঝপথে নিয়ম বদলের দরুন তাঁরা বরবাদ হয়ে যান। ন্যায় ও নীতি দুই-ই বলে, কোনও পরিস্থিতির বিচার হয় সেই সময়কার বিধি অনুসারে, পরবর্তী বিধির পশ্চাৎমুখী (রেট্রস্পেক্টিভ) প্রয়োগে নয়। ২০১৪-র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ২০১৬-য় প্রণীত বিধি তাই অবান্তর: সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে হলে ২০১৬-র আগেই ব্যাপারটা মিটে যেত। ২০২২-এও যে মেটেনি, তার দায় কর্তৃপক্ষের, প্রার্থীদের নয়। বহু প্রার্থীর বয়স পেরিয়ে গেছে, সেটাও তাঁদের দোষে নয়। এই অবস্থায় একমাত্র ন্যায্য সমাধান বয়সসীমা শিথিল করা।
আরও আছে সরকারপক্ষের এক বিচিত্র অবস্থান। আপাতযোগ্য প্রার্থীদের উৎকণ্ঠা দূর করার চেয়ে কর্তারা যেন বেশি ব্যস্ত ‘ব্যতিক্রমী ভাবে’ নিযুক্ত শিক্ষকদের আশ্বস্ত করতে যে, তাঁদের চাকরি যাবে না, বা যদি যায় তা নেহাত আদালতের নির্দয় বিধানে। ন্যায়-অন্যায়ের কথা ছেড়ে দিলাম। সরকার কি রাজ্যজোড়া ছাত্র-অভিভাবকদের বলতে চায়, তাঁদের বা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার ভার জেনেশুনে এই অযোগ্য শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া হল? তামাম রাজ্যবাসীকে বলতে চায়, মানবসম্পদ এ ভাবে ধ্বংস হতে দেওয়াই সরকারি সিদ্ধান্ত, করদাতা তার অর্থ জোগাবে? যোগ্যতা ভাঁড়িয়ে যদি কেউ হাসপাতালে ডাক্তারের চাকরি পায়, একই যুক্তিতে কি সে মানুষ মেরেই চলবে?
আর একটা কথা। এই অনাচার কায়েম হলে শিক্ষকসমাজে তার বিষময় প্রতিক্রিয়া হবে। অযোগ্যতার গ্লানিতে দেগে দেওয়া হবে সমস্ত শিক্ষককুলকে। ইতিমধ্যেই নানা জায়গায় শিক্ষকরা কটাক্ষ ও অপমানের শিকার হচ্ছেন, পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে পরীক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে ছাত্রেরা মুখের উপর প্রশ্ন তুলছে। নিষ্ঠাবান সম্মাননীয় শিক্ষকরা কত দিন এই নির্যাতন সহ্য করবেন? পাশাপাশি অযোগ্য শিক্ষকরাও বহাল তবিয়তে অধিষ্ঠিত থাকলে শিক্ষকসমাজ বিদ্বেষ ও অসন্তোষে চৌচির হবে। সেই সঙ্গে বার্তা যাবে, চাকরি পাওয়ার ‘ব্যতিক্রমী’ উপায়টাও নিপাতনে সিদ্ধ, নিয়োগের স্বীকৃত পন্থা।
কেউ বলতে পারে, এত দুর্নীতি হয়েছে ভাবছ কেন? উত্তরটা সহজ: আদালতের তত্ত্বাবধানে হাঁড়ির যে ক’টা চাল টেপা হয়েছে, তার ইঙ্গিত আতঙ্কজনক। তাই দরকার একটা সার্বিক তদন্তের— যতই কঠিন, যতই অপ্রিয়, রাজনৈতিক ভাবে যতই বিপজ্জনক হোক না কেন। দুঃখের বিষয়, কর্তৃপক্ষের তরফে তেমন সদিচ্ছার কোনও লক্ষণ নেই— আদালতের গুঁতোয় যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকুই নেহাত অনাগ্রহে টিপে টিপে করা হচ্ছে। পর্ষদের নতুন সভাপতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এখন থেকে সব কিছু স্বচ্ছ ভাবে নিয়ম মেনে হবে। তাঁকে সাধুবাদ। কিন্তু অতীতের জট না ছাড়ালে ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড তার সঙ্গে জড়িয়ে সমস্যা বাড়িয়েই চলবে। সেই জট ছাড়ানোর দায় কেবল পর্ষদের নয়, সমগ্র সরকারের।
ইতিমধ্যে চিন্তার নতুন কারণ দেখা দিয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা আদালতে জানিয়েছে, ডিএলএড কোর্সে ভর্তি ও ফলাফল নিয়ে প্রচুর দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়েছে। ইডির প্রতিবেদন বেদবাক্য না হতে পারে, কিন্তু তা উপেক্ষা করার বিলাসিতা কর্তৃপক্ষের আর সাজে না। এই অনাচার নাকি ২০১৮ থেকে শুরু, অর্থাৎ আগের নিয়োগপর্বে তার ছাপ পড়েনি। এ-বার যাতে না পড়ে, সে-জন্য এখন থেকেই সতর্ক হওয়া জরুরি। নইলে ভবিষ্যৎ নিয়োগের জল আরও কত ঘোলা হবে, কত মামলার বান ডাকবে, ভাবলেও আতঙ্ক হয়।
এমনিতেই কিছু নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। টেট পরীক্ষায় বসার জন্য স্নাতক স্তরের নম্বরসীমা ক্ষেত্রবিশেষে কমানো হয়েছে। যাঁরা এখনও বিএড বা ডিএলএড পাঠরত, তাঁদের আবেদনও গৃহীত হচ্ছে। দুর্বোধ্য সিদ্ধান্ত। এমনিতেই পদপ্রার্থীর সংখ্যা লাখের ঘরে— রাজকন্যা কম পড়া দূরে থাক, কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে। চাপ বাড়া ছাড়াও প্রশ্ন ওঠে: যদি পাঠরত কেউ নির্বাচিত হন, তিনি পাশ করা অবধি কি পদ খালি পড়ে থাকবে? যদি আদৌ পাশ না করেন, তবে?
স্কুলে-স্কুলে শিক্ষকের আকাল চরমে পৌঁছেছে। চাকরিপ্রার্থীদের চেয়েও যাদের কাছে জবাবদিহি জরুরি, তারা ছাত্রকুল এবং তাদের অভিভাবক। উঁচু ক্লাসে বিজ্ঞানশিক্ষা অস্তমান। কোথাও ছাত্রেরা পুরোপুরি কোচিং ক্লাসের পুঁজিতে টেস্ট ও বোর্ড পরীক্ষায় বসছে। কোথাও অভিভাবকেরা স্থানীয় তরুণ বেকারদের (যাঁদের অনেকেই শিক্ষক চাকরিপ্রার্থী) চাঁদা তুলে নিয়োগ করছেন ছেলেমেয়েদের পড়াতে। কোথাও সেটুকুও হচ্ছে না। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে এই ছেলেমেয়েদের জীবনে উন্নতি লাভের যে এত রাস্তা বন্ধ হল, তার জবাব কে দেবে, ক্ষতি কে পূরণ করবে? প্রাথমিকে যে শিক্ষক একা পাঁচটা ক্লাস সামলাচ্ছেন, তিনি কাদের কতটা শেখাবেন?
শিক্ষকের অভাব দুই স্তরে। এক, পদ নেই। দুই, পদ থাকলেও লোক নেই। প্রথমটা ছেড়েই দিলাম, দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান মেলা ভার। সাম্প্রতিক বিতণ্ডায় যে সংখ্যাগুলি উঠে এসেছে, এমনকি আদালতে পেশ হয়েছে, তাতে বিস্তর অসঙ্গতি। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে, তাতে খালি পদের বিশদ জেলাওয়ারি হিসাব আছে। তা যদি সঠিক হয়, বলতে হবে প্রাথমিক পর্ষদ একটা মস্ত উপকার করল। এই তালিকার ভিত্তিতে স্কুলে-স্কুলে নিয়োগ নিশ্চিত করতে আর কত দিন?
শেষে খুব ‘সিনিকাল’ একটা কথা। শিক্ষক নিয়োগে অনাচার আর দুর্নীতি নতুন নয়, পশ্চিমবঙ্গের একচেটিয়াও নয়। বহু (হয়তো অধিকাংশ) রাজ্যে এটা চিরাচরিত প্রথা। শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত বলে খ্যাত একটি রাজ্যের খতিয়ান সম্প্রতি শুনে চমকে উঠলাম। আমাদের জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই দুর্নীতিও প্রণালীভুক্ত, সিস্টেমিক। এতে কাজের গতি ও গুণমান বিপর্যস্ত হলেও রাষ্ট্ররথ এক ভাবে নড়বড়িয়ে চলে, দেশবাসী মেনে নেয় বা ধর্তব্যেই আনে না।
এই পরিস্থিতি অন্যায় ও ক্ষতিকর। তবে দুর্যোগ ঘটে যখন এই ‘দস্তুরি’তে সন্তুষ্ট না হয়ে হাতেগোনা উচ্চাভিলাষী লোক ষড় করে, তাদের ক্ষুদ্র চক্রের একতরফা লাভের স্বার্থে পুরো ব্যবস্থাটা কব্জা করতে। সেই পাপ এক দিন না এক দিন বেআব্রু হয়ে অনর্থ বাধায়। শিক্ষক নিয়োগে এমন ঘটেছে মধ্যপ্রদেশে, হরিয়ানায়। সেই গ্লানিকর তালিকায় বাংলার নাম যোগ হল।
এতে প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা যে মোক্ষম ঘা খেল, তার উপশমের দায় শাসকের। কিন্তু শিক্ষার মতো সর্বগামী ক্ষেত্রে ক্ষতিটা আমাদের সকলের, প্রতিকারের দায়ও তাই সকলের। যাঁদের সন্তানেরা ওই স্কুলে পড়ে কেবল তাঁদের নয় (এই ভুলটা যেন আমরা ত্যাগ করি), রাজ্যবাসী সকলের: রাজ্যটা খরচের খাতায় লিখতে চান না এমন সবার; সন্তানদের মঙ্গলার্থে যাঁরা তাদের ভিন-দেশে নির্বাসনে পাঠাতে চান তাঁদের পর্যন্ত। এড়াবার, পালাবার রাস্তাগুলো বিশ্ব জুড়ে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়