সম্প্রতি জানা গেল, কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে আড়াই লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছে। এর আগে এ বছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষণা করেছিলেন, অচিরেই দু’টি জাতীয় ব্যাঙ্ক ও একটি বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণ হবে। ধরে নেওয়া যায়, ব্যাঙ্ক ও বিমা বেসরকারিকরণ বৃহত্তর পরিকল্পনার একটা অংশ। চারটে ব্যাঙ্কের নাম বাজারে ঘুরছে, যদিও সরকারি ভাবে এখনও বলা হয়নি যে, ঠিক কোন দু’টি ব্যাঙ্ক বিক্রি করার কথা সরকার ভাবছে।
২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলির পরিচালনা কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজনের কাছে কমিটি তার রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ১২ মে, ২০১৪। সেই রিপোর্টে জাতীয় ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে জোরদার সওয়াল করা হয়েছিল। স্মরণ করা যেতে পারে, কমিটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার চোদ্দো দিন পরে, ২০১৪ সালের ২৬ মে, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তার মানে, ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের ভাবনা শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের আমল থেকেই। তবে এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ বিজেপিই করেছে।
পুনর্মূল্যায়ন কমিটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের পক্ষে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে যে যুক্তিগুলো দিয়েছিল, সেগুলো গোড়াতেই উল্লেখ করা দরকার। প্রথমত, কমিটি লক্ষ করেছিল, ধার দেওয়ার নিরিখে বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর গুরুত্ব ক্রমশই বাড়ছে। ২০০০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো ৮০% বাজার দখল করে ছিল, বেসকারি ব্যাঙ্কগুলোর ভাগ ছিল ১২%-এর কিছু বেশি, আর বাজারের বাকিটা ছিল বিদেশি ব্যাঙ্কগুলোর আওতায়। ২০১৩ সালে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর বাজার দখল হয়ে দাঁড়াল যথাক্রমে ৭৩% এবং ২১%। পুনর্মূল্যায়ন কমিটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, এই ভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ নাগাদ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর ব্যবসা ৬৩%-এ নেমে আসবে, আর বেসরকারিদের অংশ বেড়ে হবে ৩২%। কার্যত দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো তার থেকেও খারাপ ফল করেছে। ২০২০ সালেই তাদের দেওয়া ঋণ বাজারে মোট ঋণের ৬০%-এ নেমে এসেছে এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬%। কমিটির বক্তব্য, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর এই ধারাবাহিক ব্যবসা বিস্তার মূলত তাদের আপেক্ষিক দক্ষতা এবং উন্নততর গ্রাহক পরিষেবার জন্যই সম্ভব হয়েছে।
বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি: তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় বেশি লাভজনক। বিনিয়োগ করা সম্পদপ্রতি তাদের লাভ বেশি, কর্মচারীপ্রতি লাভও তাদের বেশি। ঋণের উপর সুদ এবং আমানতের উপর সুদ, এই দুইয়ের মধ্যে তফাতটাও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে বেশি। ফলে আমানত প্রতি লাভের অঙ্কটাও তাদের বেশি।
সব থেকে বড় কথা, বেসরকারি ব্যাঙ্কে অনাদায়ি ঋণের অনুপাত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের তুলনায় অনেক কম। পুনর্মূল্যায়ন কমিটি তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া গোষ্ঠীর অনাদায়ি ঋণ ছিল তাদের দেওয়া মোট ঋণের ৬.২৪%, স্টেট ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সম্মিলিত অনাদায়ি ঋণ ৪.৫৫%। সেখানে নতুন বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর অনাদায়ি ঋণ ১.৯৬%, পুরনো বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর ২.৩৪%। লক্ষণীয় যে, পরবর্তী পাঁচ-ছ’বছরে, অর্থাৎ ২০১৮-১৯’এ পৌঁছে, এই তফাত আরও বেড়েছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯’এ সরকারি ব্যাঙ্কগুলোয় সম্মিলিত ভাবে অনাদায়ি ঋণের অনুপাত ছিল ১১.৬%, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোয় ৫.৩%।
সব মিলিয়ে পুনর্মূল্যায়ন কমিটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারিকরণের সুপারিশ করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, বেসরকারিকরণ না হলে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর বোঝা টানতে টানতে শেষ পর্যন্ত সরকারই দেউলিয়া হয়ে পড়বে।
এই সুপারিশ কি নিরপেক্ষ, না কি একপেশে?
উল্লেখ করা দরকার, চেয়ারম্যান-সহ পুনর্মূল্যায়ন কমিটির আট সদস্যের মধ্যে মাত্র এক জন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন, তাও একেবারে প্রথম সারির সরকারি ব্যাঙ্কে নয়। বাকিদের মধ্যে দু’জন সদস্য সেবি থেকে, অন্যরা সকলেই বেসরকারি ক্ষেত্রের। ফলে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কমিটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো ভাল করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই পেল না। যেন কমিটি গঠনের আগেই একটা সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের মনে তৈরি হয়ে ছিল, সেই সিদ্ধান্তটা কমিটিকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়া হল।
আসলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে যতটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোকে ততটা করতে হয় না। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে তাদের অনেক শাখা খুলতে হয়— যে শাখাগুলি বাণিজ্যিক অর্থে অলাভজনক, কিন্তু সামাজিক অর্থে নয়। ২০১৯ সালের মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির গ্রামীণ শাখা ছিল ৩২%, বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির ২১%। কিন্তু, শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে তফাতটা ধরা যাবে না। দেখতে হবে কতটা প্রত্যন্ত জায়গায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি শাখা খুলেছে। এ ছাড়াও জনস্বার্থে অনেক কাজ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে করতে হয়, যার থেকে লাভ কম। কাজেই বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কদের মুনাফা কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। লাভের প্রশ্ন তুলে যখন ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের কথা বলা হচ্ছে, তখন কি এটাই ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, ব্যাঙ্কগুলোর আর সামাজিক দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন নেই?
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ক্রমবর্ধমান অনাদায়ি ঋণের সাম্প্রতিক খতিয়ান নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কিন্তু, এই প্রসঙ্গে দু’একটা কথা বলার আছে। এটা অনেকেই জানেন যে, অনাদায়ি ঋণের জন্যে বড় কর্পোরেটগুলোই মূলত দায়ী, এবং এই খারাপ ঋণগুলো অনেকটাই উপরমহল থেকে নির্দেশ আসে বলে দেওয়া হয়। এই সব নির্দেশ সাধারণত আসে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে। বড় কর্পোরেটদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের গাঁটছড়া তো সর্বজনবিদিত। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রথমে তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর দফারফা করে দিলেন। এখন ব্যাঙ্কগুলোর গায়ে ‘অলাভজনক’ তকমা লাগিয়ে তাদের বিক্রি করে দিতে চাইছেন। চিরদিন কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনাদায়ি ঋণের অনুপাতে এতটা তফাত ছিল না। ২০০৭-০৮’এ পুরনো বেসরকারি ব্যাঙ্কদের অনাদায়ি ঋণ ছিল তাদের মোট ঋণের ২.৩%, নতুন বেসরকারি ব্যাঙ্কদের ২.৫%, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কদের ২.২%। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫-১৬ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অনাদায়ি ঋণ লাফ দিয়ে বেড়েছে। দায়টা বিজেপি সরকার এড়াতে পারে না।
আরও কয়েকটা গভীর আশঙ্কা আছে। প্রথম আশঙ্কা, এই করোনা এবং মন্দা-আক্রান্ত সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রি করলে ঠিক দাম পাওয়া যাবে তো? না কি বিশেষ কাউকে সস্তায় রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্ক বিক্রির জন্য ঠিক এই সময়টাই বেছে নেওয়া হয়েছে? দ্বিতীয়ত ধরা যাক, একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বিক্রি হয়ে গেল। অত টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কটি কেনার সামর্থ্য খুব বড় কর্পোরেট ছাড়া আর কারও নেই। ব্যাঙ্কটি কেনার পর সেই কর্পোরেট গোষ্ঠী খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের ব্যবসাতেই আমানতকারীদের টাকা খাটাবার চেষ্টা করবে। ফলে ঝুঁকি বাড়বে, একটা ঝুড়িতে সব ডিম রাখলে যে অর্থে ঝুঁকি বাড়ে। সেই ঝুঁকিটা মূলত গিয়ে পড়বে আমানতকারীর ঘাড়ে। কারণ, এফআরডিআই নামক যে ভয়ঙ্কর বিলটি বিজেপি এনেছিল, সেটা এখনও তামাদি হয়ে যায়নি। এই বিল বলছে, ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে গেলেও সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই আমানতকারীকে টাকা ফেরত দেওয়ার। তবু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক হলে সরকারের কিছুটা দায়িত্ব থেকেই যেত, কারণ সরকারই সে সব ব্যাঙ্কের মালিক। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্কে সরকারের কিসের দায়িত্ব?
এ সব সত্ত্বেও একটা কথা জোর দিয়ে বলব। বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলো যে বাজার দখল করে নিচ্ছে তার কারণ তাদের দক্ষতা, গ্রাহক পরিষেবা, প্রযুক্তি, কাজ সংক্রান্ত জ্ঞান। এর সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো কিন্তু ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। এটা সরকারের দোষ নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর অক্ষমতা। এ রকম যাতে না ঘটে তার জন্য এই ব্যাঙ্কগুলোর আমূল সংস্কার প্রয়োজন।