মহাজাগতিক: শিল্পীর কল্পনায় গ্রহাণু ও কৃত্রিম উপগ্রহের সংঘর্ষের চিত্র। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।
বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেলর বেঁচে থাকলে খুশি হতেন খবরটা শুনে। সেই যে বিজ্ঞানী, যিনি প্রথম অ্যাটম বোমা তৈরির প্রকল্প ম্যানহাটান প্রজেক্টের ডিরেক্টর জে রবার্ট ওপেনহাইমার-এর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, এই মানুষটির হাতে আমেরিকা রক্ষার দায়িত্ব না থাকলে আমি খুশি হতাম। ওটা ওপেনহাইমারের কফিনে শেষ পেরেক। এর পর ওপেনহাইমারের সিকিয়োরিটি ক্লিয়ারেন্স বাতিল হয়। ভাবুন, যে মানুষটা আমেরিকাকে অ্যাটম বোমা এনে দিলেন, সে মানুষটার অস্ত্র কারখানায় ঢোকা বারণ। কী অবস্থা! শোনা যায়, সাক্ষ্য দিয়ে বেরোনোর সময় নাকি টেলর হ্যান্ডশেক করতে গিয়েছিলেন ওপেনহাইমারের সঙ্গে। ফিরিয়ে দিয়ে ওপেনহাইমার নাকি বলেছিলেন, আপনি যা বলে এলেন, তার পর এর অর্থ আমি কিছু খুঁজে পাই না। আসলে, টেলরের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল ওপেনহাইমারের উপরে। ম্যানহাটান প্রজেক্টে তাঁকে বড় কাজ দেননি যে ওপেনহাইমার!
ওপেনহাইমার অস্তগামী মানে টেলরের পোয়াবারো। অ্যাটম বোমার পর তার হাজার গুণ বেশি বিধ্বংসী হাইড্রোজেন বোমা বানাতে নামে আমেরিকা। তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয় টেলরকে। অ্যাটম বোমার পরে আবার হাইড্রোজেন বোমা কেন? তখন সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ঠান্ডা লড়াই। সোভিয়েট রাশিয়া অ্যাটম বোমা বানিয়ে ফেলেছে। এগিয়ে থাকতে গেলে আমেরিকার হাতে হাইড্রোজেন বোমা চাই।
আর একটা প্রয়োজন মেটাতে পারে হাইড্রোজেন বোমা, বললেন টেলর। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে ধূমকেতু শুমেকার-লেভি ৯ বৃহস্পতি গ্রহের বুকে আছড়ে পড়ে। পৃথিবীর বুকে এমন ঘটনা ঘটলে কী হত? প্রলয় ঘটত। ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে ধূমকেতু নয়, একটা গ্রহাণু আছড়ে পড়েছিল পৃথিবীর বুকে। ধূলিঝড়ে ঢাকা পড়েছিল এই গ্রহ। সূর্যের আলো না থাকায় মরেছিল গাছপালা। তৃণভোজী আগে মারা গিয়েছিল। তৃণভোজী আর না থাকায়, মরেছিল মাংসাশী প্রাণীরাও। পৃথিবীতে সে এক প্রলয় কাণ্ড। অবশ্য, সে প্রলয় কাণ্ডে মানুষের সুবিধে। প্রলয় কাণ্ডে আগে মারা যায় তৃণভোজী ডাইনোসরেরা। পরে মাংসাশী ডাইনোসরেরা। অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন, এ ভাবে শেষ হয় পুরো ডাইনোসর প্রজাতি। এ ভাবে, না কি অন্য কোনও উপায়ে? কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন, গ্রহাণুর ধাক্কায় নয়, আগ্নেয়গিরি থেকে প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল ডাইনোসরেরা। তা যে কারণেই হোক, মানুষ আসত না এই পৃথিবীতে, যদি না ডাইনোসরেরা নিশ্চিহ্ন হত। ডাইনোসর যুগ শেষ হয়েছিল বলেই, শুরু হতে পেরেছিল স্তন্যপায়ীদের যুগ। আর, সে যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি যে মানুষ, সে কথা তো আর কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। তাই বলছিলাম, বেঁচে থাকলে টেলর খুশি হতেন খবরটা শুনে।
কী খবর? এ বছর ২৬ সেপ্টেম্বর আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে ধাক্কা মেরে গ্রহাণু ডিমরফসের কক্ষপথ পাল্টে দেয়। ইটালিয়ান স্পেস এজেন্সির পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহ লিসিয়াকিউব ক্যামেরায় ওই সংঘর্ষের ছবি তুলেছে। স্বভাবতই নাসা খুশি এই সাফল্যে। এজেন্সির অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ফর সায়েন্স টমাস জারবাখেন বলেছেন, “এটা আমাদের প্রথম সাফল্য মহাজাগতিক বস্তুর পথ পরিবর্তনের ব্যাপারে। এ বার আমরা তাকিয়ে থাকব ভবিষ্যতের দিকে।”
পৃথিবী থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে ছিল ওই গ্রহাণু। নাসা-র যে মিশন এই গ্রহাণুর পথ পাল্টে দিল, তার নাম ডবল অ্যাস্টেরয়েড রিডাইরেকশন টেস্ট (সংক্ষেপে ডার্ট)। ডার্ট মিশন ডিমরফসের কক্ষপথ কতটা পাল্টাল, তা ওই লিসিয়াকিউবের পাঠানো ছবিতে ধোঁয়াধুলো থেকে গণনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। যে কৃত্রিম উপগ্রহটি ধাক্কা দিয়েছে ডিমরফসের বুকে, তার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। ক্যালিফর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি, যেখানে একদা অধিকর্তা ছিলেন টেলর, সেখানকার বিজ্ঞানী মেগান ব্রুক গিয়াল বলেছেন, “কৃত্রিম উপগ্রহটি সংঘর্ষে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।”
নাহ্, ডিমরফস পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছিল না। এটা শুধু পরীক্ষামূলক সংঘর্ষ। টেস্ট ফ্লাইট। বিজ্ঞানে যা হয়ে থাকে আকছার। টিকা প্রস্তুতের আগে যেমন তা পরীক্ষা করা হয় ইঁদুরের উপর। গ্রহাণু, ধূমকেতু কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহের ভাসমান অবশিষ্টাংশ (স্পেস জাঙ্ক) থেকে এই গ্রহের বিপদ কম নয়। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, হাজার হাজার বছরে ও-সব ধেয়ে আসবে না এই গ্রহ লক্ষ্য করে, তা বলা যাচ্ছে না। ১৯৯৪ সালে, যে বছর শুমেকার-লেভি ৯ ধূমকেতু ধাক্কা মেরেছিল বৃহস্পতি গ্রহের বুকে, সে বছর আমেরিকান কংগ্রেস নাসাকে দায়িত্ব দিয়েছিল এক কিলোমিটার ব্যাসের বেশি বিপজ্জনক গ্রহাণুর খোঁজ করতে। ১৬ বছর লেগেছে নাসার সে কাজ করতে। ২০১৬ সালে বেরিয়েছে সে রিপোর্ট। দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিপদ একেবারে শূন্য নয়। নাসার মদতে পুষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহের আয়না ব্যবহার করে ১৪০ মিটারের বেশি ব্যাসের মহাজাগতিক পাথরের খোঁজ করছেন (ডিমরফসের ব্যাস ১৭০ মিটার)। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন ৩০,০০০ পাথর! খোঁজ চলছে, এখন শেষ হয়নি। নানা কৃত্রিম উপগ্রহের আয়না ব্যবহার করা নয়, ওই বিপজ্জনক গ্রহাণু ধূমকেতু বা স্পেস জাঙ্ক খুঁজে বার করার জন্য চাই বিশেষ ভাবে নির্মিত কৃত্রিম উপগ্রহ। সমস্যা অর্থের। এ ব্যাপারে যে নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট সার্ভেয়র-এর কথা বলা হয়েছিল, নাসা তার ব্যয়বরাদ্দ ১৭ কোটি থেকে কমিয়ে ৩ কোটি ডলার করেছে। বরাদ্দ কম মানে কাজে দীর্ঘসূত্রতা। নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট সার্ভেয়র টেলিস্কোপ তো ২০২৬ সালে মহাশূন্যে যাচ্ছেই না, ২০২৮ সালে যাবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না নাসা।
গ্রহাণু যে সব সময় পৃথিবীতে আছড়ে পড়বে, এমন কথা নেই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে টুংগুস্কা-র ঘটনার কথা। সাইবেরিয়ার এই জঙ্গলে ১৯০৮ সালের ৩০ জুন তারিখে আছড়ে পড়েছিল এক গ্রহাণু। পৃথিবীর মাটিতে আঘাত করা নয়, গ্রহাণুটি পৃথিবীর আবহমণ্ডলে ঢুকে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উঁচুতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে যায়। বিস্ফোরণে জঙ্গল পুরে খাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও খাদ তৈরি হয়নি পৃথিবীর বুকে। যেমন খাদ আছে মেক্সিকোর চিকশুলুবে। ওই খাদ দেখেই বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন ডাইনোসর বিলুপ্তির মূলের কারণ গ্রহাণুর পৃথিবীকে ধাক্কা।
স্পেস জাঙ্কের কথায় মনে পড়ছে স্কাইল্যাব মিশনের প্রসঙ্গ। স্কাইল্যাব কক্ষপথ হারিয়ে ভারত মহাসাগরে পড়ে ১৯৭৯ সালের ১১ জুলাই। ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দুই রুশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট— কসমস ২২৫১ এবং ইরিডিয়াম ৩৩— সাইবেরিয়ার ৭৮৯ কিলোমিটার ঊর্ধ্বাকাশে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এমন সংঘর্ষ যে, দুটো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ছিন্নভিন্ন হয়। দুই কৃত্রিম উপগ্রহই কাছাকাছি আসছিল, তার পর সংঘর্ষ। সংঘর্ষ যে হবেই, তা বুঝতে পারেনি কেউ। গণনায় ধরা পড়ছিল না যে, দুটোর মধ্যে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী।
সে কারণে মনে পড়ছে নাসার সাম্প্রতিক সাফল্যের কথা। গ্রহাণু তো মহাকাশে ভাসমান বস্তু। তাকে টার্গেট! এ কি কম গণনা?