নাগরিক: মণিপুরে জাতিগত সংঘর্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। ২১ জুলাই ২০২৩, বেঙ্গালুরু। ছবি: পিটিআই।
বেশ কয়েক বছর আগে ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় অঞ্চলে এক ডোঙ্গরিয়া কন্ধ জনজাতির সরপঞ্চ আমাকে বলেছিলেন, স্বাধীন দেশে বাস করি। কিন্তু আমাদের মনে কোনও আনন্দ নেই। সব সময় যেন মাথার উপরে তরোয়াল ঝুলছে। তখন সু্প্রিম কোর্টের নির্দেশে নিয়মরাজার পাহাড়ে বক্সাইট খননের ব্যাপারে গ্রামসভার সিদ্ধান্ত বলবৎ করা হয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকার চাইছে সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে। ফলে অনিশ্চয়তা, পাহাড়-অরণ্যে উগ্রবাদী সন্দেহে জনজাতি মানুষের গ্রেফতার, রাতে খানাতল্লাশি অব্যাহত। সশস্ত্র বাহিনীর হেফাজতে কারও মৃত্যু হলে তদন্ত হয় না।
আজ সেই কথা মনে পড়ে গেল। সমতল ও শহরবাসী আমি। সর্ব সুবিধা প্রাপ্ত নাগরিক। জীবনের ছ’টি দশক পার করে আজ আমার মনে কোনও আনন্দ নেই। চোখের সামনে দেখছি বহু মানুষের অবদানে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিনাশ, দেখছি রাষ্ট্রের প্রশ্রয় ও সহায়তার গণহিংসার বিস্তার। সাধারণ নাগরিকের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। আমাদেরই নির্বাচিত সরকার কোনও জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়।
সম্প্রতি মণিপুরে কুকি জনজাতির নারীদের উপরে সংগঠিত হিংসার ভয়াবহ ছবি আমাদের সম্মিলিত বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। আরও বিপজ্জনক মনে হয়েছে এতে অন্য সম্প্রদায়ের মেয়েদের যোগদান। মাতৃতান্ত্রিক উত্তর-পূর্বের এক রাজ্যে এমন কী করে ঘটল, তাও অনেককে বিস্মিত করেছে। আমাদের জাগাতে যে এতটা বীভৎসতাই প্রয়োজন, তাতে বোঝা যায় নাগরিক সমাজের সংবেদনশীলতা তলানিতে ঠেকেছে। নারী-হিংসার ভয়াবহতার মাপে মণিপুরের ঘটনার ভিডিয়োটি যতই আমাদের আঘাত করুক, একে কেবল নারীর বিরুদ্ধে আগ্রাসনের ঘটনা হিসাবে দেখলে আমরা সমস্যার পুরো ব্যাপ্তিটি ধরতে পারব না। যুদ্ধপরিস্থিতিতে এমন হয় আমরা দেখেছি। মণিপুরে যা ঘটেছে তা যুদ্ধ নয়, কিন্তু রাষ্ট্রের সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়ে সমতলের অধিবাসীরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে জনজাতি সম্প্রদায়ের উপরে। আক্রান্ত মেয়েরা, হিংসার সহায়ক মেয়েরা, উভয়েই হয়েছেন এই প্রক্রিয়ার কোল্যাটারাল ড্যামেজ। ‘১৪০ কোটি মানুষের জন্য ভয়াবহ লজ্জা’ বলে মণিপুরের ঘটনার উল্লেখ করার জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর লেগেছে আড়াই মাস। এই সময়ের মধ্যে অত্যাচারিত পরিবারের তরফে এফআইআর দায়ের করা হলেও অপরাধীরা তখন গ্রেফতার হয়নি। অপরাধীরা গ্রেফতার হলেই যে মণিপুরে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, তার কোনও ভরসা নেই। কারণ, মণিপুর হিংসার কারণ অনেক গভীরে। নির্বাচিত সরকার সমস্ত নাগরিকের সুরক্ষিত জীবনযাপনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মণিপুরের ক্ষেত্রে সরকার এই দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। দিনের পর দিন চলেছে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও গণহত্যার বীভৎসতা। তার প্রকৃত সংখ্যাও আমাদের জানা নেই। সাধারণ নাগরিক সরকারকে যে দায়ী করবে, সেই পথটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে মণিপুর রাজ্যকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা আর একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ অবনমন— এ দুই অপরাধের দায় নিতে হবে মণিপুর সরকারকে।
নারীদের উপর হিংস্র আক্রমণের যে ভিডিয়োটি আত্মপ্রকাশ করেছে সেই ঘটনার দিন— অর্থাৎ ৪ মে— থেকে মণিপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯ জুলাই ভিডিয়োটি ভাইরাল হওয়ার আগে মণিপুর হাই কোর্ট দীর্ঘ শুনানির পর সীমিত পরিষেবার অনুমোদন দেয়। সরকারের দেওয়া কারণ অনুযায়ী, সমাজবিরোধীদের তৈরি মিথ্যা খবর, গুজব বন্ধ করার জন্যই ইন্টারনেট বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার ঠিক উল্টোটাই— এই সত্তর দিনে অসংখ্য হত্যা, নারীর উপরে আক্রমণ, গৃহদাহের খবর চাপা পড়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এক দুর্বল মুহূর্তে তা স্বীকার করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে লাভ হয়েছে সরকারের, কারণ তাদের কোনও হিংসার জন্য দায়ী করা কঠিন হয়ে পড়বে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অ্যান্ড ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন-এর একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ইন্টারনেট বন্ধ হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক মানুষ, যাঁরা সরকারি সাহায্য ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার উপরে নির্ভর করেন।
মণিপুরের পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে কোন দিকে গড়াবে, বলা যায় না। কিন্তু কয়েকটি অশনিসঙ্কেত এখনই দেখা যাচ্ছে। পূর্ব মণিপুরের জেলাগুলিতে সমীক্ষা করে ভারত সরকারের খনি মন্ত্রক ও জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া পেয়েছে বিরাট পরিমাণ খনিজের সন্ধান। লাইমস্টোন, ক্রোমাইট, তামা, নিকেল, ম্যাগনেটাইট, এমনকি প্লাটিনাম গ্রুপের মৌলও। কেবল লাইমস্টোন ও ক্রোমাইটের পরিমাণই আনুমানিক ২৬ মিলিয়ন টন। অনেক বেসরকারি সংস্থাকে লিজ়ও দেওয়া হয়েছে সেই খনি, খনিজ উত্তোলনের জন্য। জনজাতির বসতি এই জেলাগুলিতে এ বার অরণ্য ও জমি থেকে উৎখাত হবেন আদিবাসীরা। নতুন অরণ্য বিল এসে গেছে সংসদে। আন্তর্জাতিক সীমান্তের ভিতরে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অরণ্যভূমিকে মুক্ত করার পথে কোনও বাধা থাকবে না এই বিল পাশ হলে।
কয়েক বছর ধরেই মণিপুরের অরণ্যভূমি সমীক্ষা করে সংরক্ষিত অরণ্য ঘোষিত করার চেষ্টা হচ্ছে। অরণ্যে চোখ পড়েছে শিল্পগোষ্ঠীগুলির ও সমতলের মানুষের। ২০১৯ থেকে গাঁজা আর মারুহুয়ানা চাষকে আইনসম্মত করার চেষ্টা করছে সরকার। জনজাতিদের অরণ্য থেকে উৎখাত করা সম্ভব হলে এই সব জমির মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে। সমতলের মেইতেইদের যদি জনজাতি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে জঙ্গল-জমির হাতবদল সম্ভব হবে। এ সবই ভবিষ্যতের সঙ্কেত। কিন্তু এই সব কারণ ঘিরে যা ঘটেছে, তা রাষ্ট্রের মদতে জনজাতি বিতাড়ন। তাদের উপরে আক্রমণ। না হলে আক্রমণকারীদের হাতে এত লুট হওয়া বেআইনি অস্ত্র কী ভাবে এল? শোনা যাচ্ছে রিলিফ ক্যাম্পগুলির অবস্থাও ভাল নয়। ঘটনার পরেও সরকার তাদের দায়িত্ব পালনে সহমর্মিতা দেখায়নি এবং পার পেয়ে গেছে। আড়াই মাস ধরে মণিপুরের শরীর থেকে ধোঁয়া উঠছে, আমরা বসে দেখছি।
মণিপুরের সঙ্গে বাংলার তুলনা করব, এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন নই আমি। কিন্তু সম্প্রতি প্রশাসনিক ব্যর্থতার ফলে গণহিংসার যে চেহারা দেখলাম, তাতে কি আমাদের কিছু করণীয় আছে? এই হিংসাও কিন্তু ক্ষমতা ও সম্পদ দখলের। ৫০টি প্রাণের বলি, কয়েকশো মানুষ আহত, ব্যালট বাক্স লুট, পঞ্চায়েত ভোটের দিন পর্যন্ত যথেচ্ছ হিংসা, বোমা ও গুলির ব্যবহারে আমরা দেখলাম একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে কী ভাবে নষ্ট করা হল। কেন এক দিনে রাজ্যে নির্বাচন হল, কেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিয়োজনে কোনও যত্ন নেওয়া হল না, কেন এত গুলি-বোমা-বারুদ আগে থেকে বাজেয়াপ্ত করা গেল না, এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমরা পাব না। হিংসারঞ্জিত এই নির্বাচনের দায় সরকার নেয় না, বরং বলে যে, ২০ বছর আগে আরও বেশি মানুষ মারা গেছিলেন। নির্বাচিত সরকার যদি দায় না নেয়, হিংসাকে প্ররোচনা দেয়, তাকে সমর্থন করে, আর সমালোচনা করলে জানতে চায়, আমরা কি অমুক সময় অমুক হিংসার নিন্দা করেছিলাম— তা হলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবেন? কী করবেন ভোটকর্মীরা, কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা, যাঁরা প্রাণ হাতে করে দায়িত্ব পালন করেছেন? আর সেই শিশুরা, গণহিংসায় যাদের স্কুলঘর নষ্ট হয়ে গেছে? কিন্তু যদি কেন্দ্রে সরকার, রাজ্যে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষই বাতিল হয়ে যায়, দায়িত্ব কার? দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গণতন্ত্রের এই মুখ নিরানন্দ করে তোলে স্বাধীন দেশে বাস।