লীলা মজুমদার। ফাইল ছবি।
সাহিত্য অকাদেমির ভারতীয় সাহিত্যকার পুস্তকমালার জন্য লীলা মজুমদারকে নিয়ে কাজটি যখন শুরু করেছি, তখনও মণীন্দ্র গুপ্ত জীবিত। এক দিন দুঃখ করছিলাম তাঁর কাছে— রুমু-বোগি, সোনা-টিয়া, চাঁদ, ঘোঁতনদের সঙ্গে যারা বাল্য-কৈশোর কাটিয়েছি, তাদের কিন্তু বড় বালাই লীলা মজুমদারের বড়দের জন্য লেখাগুলো! প্রাণের লীলাদিদির লেখা তেমন টানছে না, এটা ভাবতেই তো অস্বস্তি! শুনে মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর স্বাভাবিক অনুত্তেজিত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ওঁর নাবালকদের জন্য লেখাগুলো যতটাই সাবালক, সাবালকদের জন্য লেখা যেন ততটাই নাবালক!
কথাটা আগে শুনিনি, ভাবিওনি। কিন্তু ঝাঁপতাল, আয়না, চীনে লণ্ঠন সবই শেষ পর্যন্ত আধুনিক মেয়েদের পাত্রস্থ হওয়ার আখ্যান! শ্রীমতী তো লেখা শুরুই হয়েছিল এই পূর্বনির্ধারণ মেনে নিয়ে যে, প্রধান চরিত্র হবে আধুনিককালের মেয়েরা, আর শেষটা হবে সুখের। পর পর শ্রীমতী আর জোনাকি লেখার বর্ণনা আছে পাকদণ্ডী-তে; আধুনিক মেয়েদের সমস্যা নিয়ে লেখা, শেষে ভাল ভাল পাত্রের সঙ্গে সক্কলের বিয়ে, পাঠক মহাখুশি! লীলা মজুমদারের নিজের একান্ত প্রিয় উপন্যাস মণিকুন্তলা; এক জন গায়িকা গলার স্বর হারিয়ে নিজেকে খুঁজে পেল জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে।
ছোটদের জন্য নিজের অনাবিল শৈশবখানা উজাড় করে দিতে যিনি গল্পহীনতার ঐশ্বর্যে, ঘটনাবিহীনের আভরণে একশো ভাগ আস্থা রাখেন, ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ থেকে এক দিকে ‘বড়পানি’, অন্য দিকে ‘ঘোঁতন কোথায়’ পর্যন্ত যাঁর সাহিত্যে গল্পহীনতার বিস্তার, সাবালক সাহিত্যে তাঁর প্রয়োজন এত সমাপতনের? চীনে লণ্ঠন-এ উচ্চবিত্ত সামাজিকতার ঘেরাটোপে মানবিক-অমানবিকের, অর্থ-নিরর্থের তির্যক বিন্যাসে মুনশিয়ানা কম নেই। কিন্তু অন্তিমে মেয়েদের সেই ‘পাত্রস্থ’ হওয়াতেই প্রবক্তার সার্থকতা!
লীলা মজুমদার স্পষ্টই বলেছেন, বড়দের জন্য লেখা তাঁর গল্পের জন্ম সচরাচর তাঁর হৃদয়ের মর্মমূলে নয়, তাঁর মস্তিষ্কের উষ্ণ অসহিষ্ণু কোষে কোষে। সত্যিকার সাহিত্য যেমন আপনি জন্ম নেয়, লেখকের অন্তরবাসী কেউ লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেয়, তেমনটা তাঁর ক্ষেত্রে মূলত ঘটে ছোটদের জন্য লেখায়। কথাটা ভাববার বটে; এই যে ঝাঁপতাল-এ হুট করে অলোক অলিমাসিমার রক্তের সম্পর্ক হয়ে লীলাদিদির পাঠকদের পাঠে বিঘ্ন ঘটাল, তেমন তো কই ঘটে না, যখন টংলিং-এ বেরিয়ে পড়ে সেই যোগাযোগ যে কালোমাস্টারই আসলে ভবেশ রায়দের থিয়েটারকে পথে বসিয়ে কেটে পড়া মেক-আপ ম্যান। অথবা মাকু-র শেষে হোটেলওয়ালার ভিতর থেকে হারানো নোটো মাস্টার বেরিয়ে এসে হেসে-কেঁদে অস্থির হয়, জানা যায়, মাকুর মালিক ঘড়িওলা আর স্বর্গের সুরুয়া বানানো হোটেলওয়ালা একই মায়ের দুই ছেলে। তাই সমাপতন বা কাকতালীয়, এ সব কোনও সীমাই আসলে সীমা নয়। মোদ্দা কথাটা বোধ করি হৃদয়ের মর্মমূল আর মস্তিষ্কের কোষের ভিতর দুস্তর ব্যবধানের। তবে চাঁদের দেখাদেখি নিজের পেরিস্তান বানিয়ে যারা বাল্য কাটিয়েছে, কৈশোর কোন কালে পেরিয়ে এসেও যাদের নাকে লেগে আছে কালিয়ার জঙ্গল থেকে ভেসে আসা বুনোফুল আর ধূপ কাঠের গন্ধ, তারা মণিকুন্তলা-শ্রীমতী-জোনাকি’র মুখোমুখি ভাবে, হলই বা মস্তিষ্কের কোষে জন্ম, তবু কেবল বিয়েই হবে, বিয়েই হবে, এ কেমন কথা! বুদ্ধি তো কম নয় তাদের লীলাদিদির। অমন উজ্জ্বল ছাত্রী। যুক্তিরই বা কী শক্তপোক্ত বাঁধুনি, যখন প্রবন্ধ লেখেন, অথবা জীবনী।
যতই পড়া যায় আর কোনখানে বা পাকদণ্ডী, মনে হয়, সাবালকদের জন্য লীলা মজুমদারের লেখাকে যথার্থ সাবালক করে তোলার মতো কত অভিজ্ঞতায় ভরা তাঁর জীবন। অফুরান মানবিক উদ্বৃত্তে ভরপুর কত বিচিত্র মানুষ জীবনভর দেখেছেন তিনি। বড় মাসিমা সুষমা আর মা সুরমার প্রসঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে— “ওই মা-মাসির মেয়ে হয়ে সারাজীবন ছোটদের জন্য বই লেখা ছাড়া আমার উপায় কী ছিল?” যে মা’কে হারিয়েছিল পাঁচ বছরের সুষমা আর তিন বছরের সুরমা, সেই জ্ঞানদাদেবীর প্রক্ষেপও পাকদণ্ডী-তে জ্বলজ্বল করছে। শিলং পাহাড়ের দেশে শৈশব-বাল্যে দেখেছেন সারদামঞ্জরি দত্তকে, পরম স্বতঃস্ফূর্তিতে যিনি অনাত্মীয় বালক-বালিকাদের ‘নদীর ওপারের দিদিমা’ হয়ে কত দায়িত্ব নিতেন। প্রায় মায়ের বয়সি নিয়মনিষ্ঠ হিন্দু বিধবা ননদ সরলা কী পরম স্নেহে গ্রহণ করেছিলেন ছোট ভাইয়ের বৌ লীলাকে। লীলা যে কায়স্থ বাবা আর ব্রাহ্মণকন্যা মায়ের ব্রাহ্মবিবাহের সন্তান, তা কোনও বাধা হয়নি। আহ্নিক না-করে জলগ্রহণ করতেন না লীলার যে শ্বশুরমশায়, বৌমাকে নিয়ে তাঁরও উষ্ণতা কম ছিল না। লীলার ভাগ্নি নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে আত্মনির্ভর জীবন পেল। এ দিকে যে মামিমা ভাগ্নির ওই দুরূহ যাত্রাপথে মূল অবলম্বন, তিনি কেমন করে আখ্যানের পর আখ্যান কেবল আধুনিক যুবতীদের সুখী বৈবাহিক পরিণামে সাজিয়ে গেলেন? তাঁর দেখা কত চরিত্র যেন যথার্থ সাহিত্যায়নের জন্য আকুল-বিকুলি করছে। সরলা ভাবতেন, তাঁর অকালবিধবা মেয়ের আর্থিক স্বনির্ভরতার থেকে বহুগুণ স্বস্তির হল সে-মেয়ের মামা-মামির বদান্যতা।
সংসারে এ সব টানাপড়েনের কয়েক বছরের মধ্যে বেতারে জনপ্রিয় হল ‘ঠাকুমার চিঠি’ অনুষ্ঠান। একটি মধ্যবিত্ত মেয়ে এগারো-বারো বছর বয়স থেকে বিয়ে হওয়া অবধি যত সমস্যার সম্মুখীন হয়, তা সে ঠাকুমাকে চিঠিতে জানায়, ঠাকুমা উত্তরে মোকাবিলার পরামর্শ দেন। এই সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানগুলিরই পরিমার্জিত, একত্রিত অবয়ব লীলা মজুমদারের উপন্যাস মণিমালা ।
লেখিকা বার বার বলেছেন, নাতনিটি নেহাত গড়পড়তা; যখন সে বি এ পড়ে, ঠাকুমা লেখেন, প্রত্যেক নারীর উচিত নিজের সংস্থানটুকু নিজের করতে পারা, বিয়ের পরেও এটা জরুরি। কিন্তু যেই না নাতনি বিটি পাশ করে স্কুলে পড়াতে পড়াতে একটি যথেষ্ট সম্পন্ন জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে, সেই একই ঠাকুমা একই নাতনিকে বলেন “দরকার না হলে চাকরি কোরো না।” এই ‘দরকার’-এর সংজ্ঞা নিয়ে গড়পড়তা নাতনি বিভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু ঠাকুমাটি যে আদৌ সাধারণ নন, তা তো মণিমালা উপন্যাস আর লেখিকার জীবন জুড়ে বার বার প্রমাণিত। উপার্জন করলে যে মেয়েদের পদমর্যাদা কমে যায়, এ-সংস্কারের দায় এক জন সরলার উপর বর্তায় না। বিপন্ন ভাগ্নিকে আত্মনির্ভর করতে যে মামিমার চেষ্টার শেষ ছিল না, তিনি কিন্তু ১৯৫৬-তে প্রথম প্রকাশিত মণিমালা-র দ্বিতীয় সংস্করণেও কোনও বদল করেননি। অথচ সেখানে আছে, অর্থবান স্বামীর ঘরনি হলে রোজগেরে মেয়ে যেন নিজের চাকরিটি ছেড়ে দেয়, পাশাপাশি যেন মনে রাখে, স্বামীর উপার্জনের অর্থ নিজের রোজগারের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ব্যয় করা অসমীচীন।
যাকে বলে ‘ভাল বিয়ে’, তাই কি তবে শেষ কথা মেয়েদের জীবনে? এত সহজে বোধ হয় অত বড় এক জন লেখকের সাহিত্যিক সীমার কার্যকারণ নির্দিষ্ট হয় না। বয়স যখন পঁচিশ, তখন বাবা প্রমদারঞ্জনের মতের বিরুদ্ধে সুধীরকুমার মজুমদারকে বিয়ে করেন লীলা, পুর বিধি মতে। তাঁর মা বা ভাইবোনদের সে বিয়েতে পূর্ণ সমর্থন সত্ত্বেও যোগদান ছিল না, প্রমদারঞ্জনের অমতের কারণে। জীবনের পরবর্তী ষোলো বছরে বাবা মেজো মেয়ে, তার সংসার, তার ছেলেমেয়ে, কারও দিকেই ফিরে তাকাননি।
অথচ, নিজের যে নিটোল ছোটবেলাটি জীবনভর লীলা বিছিয়ে রেখেছেন দেশের বাল্যের সামনে, সে নাবালক বেলার মূল রূপকার ওই বনের খবর-এর স্রষ্টা, যিনি মুখে মুখে বিন্দু বা সরলরেখার অভ্রান্ত বোধ বানিয়ে দিতেন, মন খারাপের দিনে পাইনবনে বেড়াতে নিয়ে যেতেন, মসুয়ার কিংবা কর্মসূত্রে দেখা গহন বনের গল্পে গল্পে মাতিয়ে দিতেন, মেজো মেয়ের ডানপিটেমি আর জিদ্দিবাজি দেখে কখনও হেসেও ফেলতেন, খুবই সম্ভব নিজের অতীত মনে করে।
বাবার সঙ্গে অবনিবনা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বেড়েছিল লীলার, দু’জনের চারিত্রিক মিলই তার অন্যতম কারণ। ছোটদের জন্য লেখায় লীলা অযৌক্তিকের অছিলায় যুক্তি বুনে দেন হাসিতে, সরসতায়, স্বপ্নে। সে-যুক্তির উৎসে যে আবেগের বসবাস, তাকে পাঠকের ধরাছোঁয়ায় আনেন না। যখনই যৌবনের কি সাবালকের বালাই এসে জোটে, তখনই কি মনে হয়, শৈশব-বাল্যের নিশ্চিতির অন্যতম কারিগর সাবালক জীবনের কোথাও নেই? আবার ছোটদের জন্য লেখা আশ্চর্য সৃজনগুলির অনেকখানি গড়ে উঠেছে লীলার বিবাহিত জীবনে, আশ্চর্য সুন্দর একটি মানুষের সাহচর্যে। প্রমদারঞ্জনেরও তো যথেষ্ট পছন্দের মানুষ ছিলেন সুধীরকুমার, আপত্তি নাকি কেবল ব্রাহ্মমতে বিয়ে না-করায়।
রাগী বাবার প্রযত্নে ভরভরন্ত নিজের নাবালক বেলা নিয়ে লীলার স্মৃতিমেদুরতার শেষ নেই। আবার লেখালিখির কাজকে লালন করলেন মূলত যাঁর নৈকট্যে, তাঁর সঙ্গে জীবনযাপনের সিদ্ধান্তেই তো জীবন থেকে বাবার লোপাট হয়ে যাওয়া! এ অভাববোধ প্রকাশ করার মানুষ নন লীলা মজুমদার। রাগী বাবার জেদি মেয়ে যে! তাই কি বড়দের গল্পে বৈবাহিক সুখের ঘেরাটোপে রাগী প্রতিবাদ? সে রাগ যতখানি নাবালক, ততটাই মানবিক।