যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
তা হলে খ্যাতিকেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট অব এমিনেন্স-এর তালিকায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঠাঁই পেল না। উৎকর্ষের অভাবে নয়, অর্থের অভাবে। অনেক ‘কেন্দ্রীয়’ প্রকল্পের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রচুর কড়ি ফেলতে হত রাজ্য সরকারকে, একটি প্রস্তাবে কেন্দ্র দিত ১০০০ কোটি, রাজ্য ২০০০ কোটি! একই দুর্ভাগ্য তামিলনাড়ুর আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের। ফয়দা হল কেন্দ্রীয় সরকারের, কারণ প্রকল্পের দরখাস্তের মাসুল এক কোটি টাকা।
গোদা বুদ্ধিতে বলে, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হবে আমাদের সেরা মেধাকেন্দ্রগুলি আরও উন্নত করে দেশের জ্ঞানসম্পদ বাড়ানো। দেখা যাচ্ছে তা নয়, আসল উদ্দেশ্য কিছু লক্ষ্মীমন্ত শিক্ষায়তন মিলে নতুন এক খানদানের বলয় সৃষ্টি। সেগুলি হবে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সহায়ক ও সমধর্মী, আর প্রকল্পের শর্তই সেই আনুগত্য সুনিশ্চিত করবে। মেধার পাশাপাশি তাই স্থায়ী সম্পদও জরুরি— কেন্দ্রীয় বাজেট, বা কর্পোরেট সূত্রে কর্পাস ফান্ড। রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো খুচরো অনুদানের রোজগারে চলবে না। জমিদারের হুঁকোয় কি জোতদার তামাক খাবে?
প্রকল্প চালু হয়েছে বারোটি প্রতিষ্ঠানে: আটটি কেন্দ্রীয় সরকারের, চারটি অসরকারি। কেন্দ্রীয় সংস্থা বলতে বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি, চারটি আইআইটি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়— দিল্লি, হায়দরাবাদ ও বারাণসী। এখানেই প্রশ্ন।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক দেশের উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের মানের তালিকা প্রকাশ করে। তাতে গত পাঁচ বছর সব রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় যাদবপুর ও কলকাতা। ধারে কাছে কেবল আন্না এবং পুণে বিশ্ববিদ্যালয়। যাদবপুর প্রতি বছর দিল্লি, প্রায়শ হায়দরাবাদ, মাঝেমধ্যে বারাণসীর চেয়ে এগিয়ে; কলকাতাও কাছাকাছি। গত দু’বছর সব শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চতুর্থ স্থানে ছিল যাদবপুর, ২০২১-এ কলকাতা। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের ২ শতাংশ সর্বাধিক স্বীকৃত বিজ্ঞানীর তালিকা প্রকাশ করে। এ বছর তাতে যাদবপুরের ৪২টি নাম, আইআইএসসি এবং ছ’টি আইআইটি-র পরেই। দেশের সব এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে যাদবপুর দশম; প্রথম আটটিই আইআইটি।
আইআইটি-দের অগ্রণী স্থান কায়েম রাখছে ভারত সরকারের নীতি, সেই হারে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। ২০২১-২২ সালে যাদবপুরের অনুদান ছিল ৩৪৩ কোটি টাকা; আইআইটি মুম্বইয়ের ৮০৪ কোটি, আইআইটি মাদ্রাজের ৭৪০ কোটি। স্থায়ী সম্পদের ফারাক সাগরপ্রমাণ। প্রায় সব তালিকার শীর্ষে আইআইএসসি। এই পরম সমৃদ্ধ গবেষণাকেন্দ্রটির সঙ্গে আর পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনাই বাতুলতা।
এ দিকে নামে-ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানের অভ্যস্ত দাবিদার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ‘খ্যাতিকেন্দ্রের’ তালিকায় নেই, নেই এ বছর তৃতীয় স্থানে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া— হয়তো এক কোটি টাকা দেয়নি বলে। কিন্তু এতগুলি অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান যদি বাদ পড়ে, এই প্রকল্পটির তবে কী উদ্দেশ্য, কী সার্থকতা?
করদাতার অর্থের সবচেয়ে দরাজ প্রবাহ একেবারে ভিন্ন দু’টি প্রতিষ্ঠানে, যাদের কথা বড় শোনা যায় না। তাদের অর্থ জোগায় বিদেশ মন্ত্রক, অন্যান্য দেশ থেকেও কিছু আসে। একটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যার বাজেট বছরে ২৫০-৩০০ কোটি, ছাত্রসংখ্যা ৪০০, অর্থাৎ ছাত্র প্রতি ৬০-৭০ লক্ষ। অন্যটি সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, তার বরাদ্দ ছাত্র প্রতি ২১-২২ লক্ষ। আইআইটি মুম্বই আর জেএনইউ-এ অঙ্কটা ৭ লক্ষ, যাদবপুরে আড়াই লক্ষ; রাজ্যপুষ্ট বহু জায়গায় আরও ঢের কম।
রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গুণমানের তালিকায় স্থান পায় বিপুল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে। (প্রথম একশোর মধ্যে বর্ধমানও আছে।) তাদের অর্থাভাব চরম, অতএব অভাব লোকবল ও পরিকাঠামোয়। উপরন্তু যুঝতে হয় কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই প্রস্ত (কখনও পরস্পরবিরোধী) কড়াকড়ির সঙ্গে। নিশ্চিত বাৎসরিক অর্থবরাদ্দ তলানিতে ঠেকেছে। রসদ সরঞ্জাম পরিকাঠামো মায় ভবন নির্মাণের টাকা জোগাড় করতে হয় বিভিন্ন প্রকল্প ও অনুদান থেকে। এগুলি মেলে দক্ষতার সাক্ষ্য ও পূর্বেকার কাজের ভিত্তিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রায় সমস্ত সম্পদ ওই প্রাতিষ্ঠানিক উপার্জন থেকে।
সমস্যা তুঙ্গে পৌঁছেছে দিল্লিতে বর্তমান সরকার বহাল হয়ে। মোক্ষম ঘা এসেছে দু’টি সূত্রে। এক, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রায় সমস্ত প্রকল্প আজ শিকেয়। তার অপ্রতুল স্থান নিয়েছে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রক চালিত ‘রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান’— যার প্রতিশ্রুত টাকা আচমকা বন্ধ হওয়ায় যাদবপুর-সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আতান্তরে পড়েছে।
দ্বিতীয় আঘাত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা লোপ পাওয়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এটাই ছিল বই ও সরঞ্জাম কেনা, নতুন ভবন গড়া, সর্বোপরি নতুন শিক্ষকপদ লাভের প্রশস্ত উপায়। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি বিকল্প খাতে অনুদান পাচ্ছে। মাথায় হাত রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির।
ভাতের জোগান কমছে, বাড়ছে কিলের বহর। শিক্ষক নিয়োগের বিচিত্র শর্তে যোগ্যতম প্রার্থীরা ছিটকে যাচ্ছে। নিত্যনতুন নিয়মে গবেষক ও নির্দেশক উভয়ে বিভ্রান্ত। পাঠ্যসূচি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, ছাত্রদের নতুন কিছু শেখাবার রাস্তা বন্ধ। অজস্র সরকারি অনুষ্ঠানের খুচরো বালাই বাদই দিলাম।
রাজ্যবাসীর কাছে তাই একটা আবেদন। এ রাজ্যে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটির শেষ নেই: বিভ্রান্তিকর আমলাতন্ত্র, হতশ্রী শিক্ষাপ্রাঙ্গণ, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীর নিয়ত আন্দোলন (ক্বচিৎ ন্যায্য কারণে)। এই খামতিগুলো দূর না করলেই নয়। এর ফলে আমরা হেয় হচ্ছি, অন্যের দৃষ্টিতে, নিজেদের দৃষ্টিতে। তবু শেষ বিচারে যেন আমরা ভিতর-বাহির, সার আর উপসর্গ গুলিয়ে না ফেলি, ‘সিনিসিজ়ম’-এ মশগুল হয়ে বাংলার প্রতিষ্ঠানগুলির স্বীকৃত উৎকর্ষটুকু ভুলে না যাই, নস্যাৎ না করি।
শেষ নিবেদন রাজ্য সরকারের প্রতি। রাজ্যের ভান্ডার শূন্য। তবু যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আজও এখানে মাথা তুলে আছে, সেগুলির মঙ্গলসাধনের কোনও চেষ্টাই কি হবে না?
প্রথম দাবি মেটাতে একটা পয়সা লাগবে না, শিক্ষকদের হৃত স্বাধীনতা আর মর্যাদা ফিরিয়ে দিন। আগের জমানায় দলীয় দৌরাত্ম্যে অনেক অনাচার হয়েছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে নিজের মতো করে, নিজের হয়ে উদ্যোগ করতে পেরেছে। এ ভাবেই জমি শক্ত করেছে যাদবপুর, বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ, কল্যাণী, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আট-নয় বছর আগে কর্তৃত্ব বিস্তারের ধুম লাগল। ভর্তি-নীতি কেন্দ্রীভূত হল, কিন্তু ভর্তি-প্রক্রিয়া রইল বিশৃঙ্খল, অতএব দুর্নীতিপ্রবণ। একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যৌথ উদ্যোগের পথ আটকাল সরকারি খবরদারি। (সহযোগী বিদেশি হলে কেন্দ্রও আসরে নামল।) ফলে সারস্বত আদানপ্রদানের সঙ্গে টান পড়ল গবেষণার অর্থসমাগমে। শিক্ষকদের বাক্স্বাধীনতা আর বিদ্যায়তন পরিচালনায় অংশগ্রহণ রোধের চেষ্টা হল আচরণবিধি জারি করে, আর সেই টানাপড়েনে অবিশ্বাস্য ভাবে থমকে গেল মৌলিক বিধি (স্ট্যাটিউটস) প্রণয়ন।
সুষ্ঠু বিধির অভাবে সব স্তরের নিয়োগ গুরুতর ভাবে ব্যাহত। উপাচার্য নিয়োগের শোরগোলে আমরা ভুলে যাই, ডিন নির্বাচনও অভূতপূর্ব ভাবে সরকারের হাতে। ডিনের অভাবে ভর্তি, পরীক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি গুরুতর কাজ ধাক্কা খেতে বাধ্য। সবচেয়ে সঙ্গিন, শিক্ষকের অভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার এক প্রধান কারণ, রাজভবন-নবান্নের কাজিয়ায় আচার্যের মনোনীত নির্বাচকের নাম মিলছে না। এ দিকে কেন্দ্রের চাপে চালু হয়েছে তিনের বদলে চার বছরের ডিগ্রি কোর্স। তাতে কর্মভার বাড়বে এক-তৃতীয়াংশের ঢের বেশি, কারণ চতুর্থ বর্ষে প্রত্যেক ছাত্রকে দিয়ে একটি স্বতন্ত্র গবেষণাপত্র লেখাতে হবে। এই শিক্ষকবাহিনী কবে আসবে, কে টাকা দেবে তার হদিস নেই, নেই বাড়তি ঘর বই সরঞ্জামের। এমনিতেই ভর্তির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, কলেজগুলি নাজেহাল।
পশ্চিমবঙ্গে আজ রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয় ৩২টি; ২০১১-তে ছিল ১৩টি। এই সময়ে উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে রাজ্যের বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় এগারো গুণ, ১২০ থেকে ১৩০০ কোটি। এটা কম নয়, কিন্তু ১৯টি নতুন ও তিনটি প্রায়-নতুন প্রতিষ্ঠান গড়তে, সেই সঙ্গে আগেরগুলির চাহিদা মেটাতে, চরম অপ্রতুল। এক দিন না এক দিন জেলাবাসীরা বুঝবেন, স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁদের প্রত্যাশা মিটছে না। মাঝখান থেকে দেশের যে অগ্রণী প্রতিষ্ঠানগুলি এ রাজ্যে অবস্থিত, সেগুলির অবনতি ঘটবে। আমও যাবে, ছালাও যাবে।
কী কেন্দ্র কী রাজ্যের দৃষ্টিতে শিক্ষা আজ অন্য খেলার ঘুঁটি। ‘শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকেছে’ বললে কিছু বলা হয় না, শিক্ষার সেটুকু অভ্যন্তরীণ গুরুত্বও অবশিষ্ট নেই। শিক্ষাব্যবস্থা বৃহত্তর রাজনীতির একটা অস্ত্র মাত্র, সেই উদ্দেশ্যে বাইরে থেকে ইচ্ছেমতো গড়াপেটা হচ্ছে। কতগুলি দুর্লঙ্ঘ্য বাধা লেখাপড়ার পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে, সেটা যেন আমরা স্পষ্ট বুঝি।