বর্তমান সম্পর্কে মানুষের এমন নিস্পৃহ উদাসীনতা শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না! প্রতীকী ছবি।
সম্প্রতি বরাহনগর থেকে গড়িয়াবাজার পর্যন্ত মেট্রো চড়ে বার বার যাতায়াত করতে হয়েছিল। বহু দিন মেট্রো চড়িনি। অনেক কিছুই নতুন লাগছিল। মেট্রো এখন পুরোপুরি বাতানুকূল, সময়ানুবর্তী ও সুসজ্জিত। যাত্রীরা অনেক বেশি সুশীল ও নিঃশব্দ। ছ’জনের বরাদ্দ আসনে সাত জন রীতিমতো সহনশীল। কিন্তু লক্ষ করে দেখলাম, এই আপাত শান্তিকল্যাণের পিছনে একটি গূঢ় পরাবাস্তব দৃশ্যপট অন্তর্নিহিত হয়ে আছে। দেখলাম, প্রায় প্রতি যাত্রীর হাতেই মুঠোফোন, কানে ইয়ারবাড গোঁজা! চোখেমুখে এক অলৌকিক পুলকের ঐশ্বরিক উদ্ভাস। সংলগ্ন সহযাত্রী আর পরিদৃশ্যমান ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে মানুষের এমন নিস্পৃহ উদাসীনতা শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না!
কয়েক দিন আগে পল রোকেট-এর একটা বই পড়ছিলাম: দ্য ইমার্সিভ এনক্লোজার: ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইন জাপান। জাপানিদের কল্পজগৎ নিয়ে লেখা হলেও এ বই আসলে সাম্প্রতিক বিশ্বের যাবতীয় মানুষের কল্পনাযাপনের গল্পকথা। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা কল্পবিশ্ব আজ একটি সামাজিক অ-সুখ। মানুষকে তার স্থানিক অবস্থান থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন জগতে নিমজ্জিত করে দিতে পারছে। তার চলতি মন-অপসন্দ বাস্তবতাকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করে আরও নমনীয়, আরও সহনীয় ও আরও রমণীয় অনস্তিত্বের কল্পজগতে পালিয়ে গিয়ে মুক্তি পেতে চাইছে। তাই আমার মেট্রোযাত্রায় মনে হল, কর্পোরেট অফিসঘরের খোপ-খোপ ঘেরাটোপের ব্যক্তিগত বেষ্টনী আর এই গণপরিবহণের গণপরিসরে নৈর্ব্যক্তিক কল্পময়তায় নিমজ্জন আসলে একই বৈকুণ্ঠধামের দিকে যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শব্দ-প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সত্যিই বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। একমাত্রিক ব্যক্তিপরিসরের অর্থই আমূল বদলে দিয়েছে। আমরা জানি, শব্দ-প্রযুক্তির জগতে আমরা শুরুর দিকে পেয়েছিলাম হেডফোন, ওয়াকম্যান আর স্পিকার। হেডফোন আমাদের কলেজ-বেলার শ্রবণবিশ্বে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। একটি ত্রিমাত্রিক কল্প-পরিসরে এখন আমি আমার ডান কান আর বাম কানকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারলাম। এর পর ওয়াকম্যান নিয়ে এল শব্দের বহনযোগ্যতার কৌশল। আর তার সঙ্গেই এল ব্যক্তিক স্বতন্ত্রতা। কানে ওয়াকম্যান লাগানো মানুষটি তার বাইরের শব্দময় জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তার জগৎটি নিতান্তই নিজস্ব প্রাইভেট জ়োন।
শুরুতে কাল্পনিক বাস্তবতার এই প্রযুক্তিগত কৌশলের উদ্ভাবক আর দখলদার ছিল আমেরিকা। তার পর তা ছড়িয়ে পড়ল অন্যত্র। আমেরিকায় কল্প-বাস্তব প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল রেডিয়ো অ্যাক্টিভ বা তেজস্ক্রিয় পরিমণ্ডলে। জাপানিরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করল টেলিকমিউনিকেশনের জগতে, প্রধানত ভিডিয়ো গেম-এ। ভিডিয়ো গেম নিয়ে এল একটা ফ্যান্টাসির জগৎ। ত্রিমাত্রিক কল্পবিশ্বে আজব সব কাণ্ডকারখানা ঘটতে লাগল। বেতার সঙ্কেতে দূর থেকেই যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রবীণ ও অশক্ত মানুষদের জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতার এক নতুন অর্থ বয়ে আনল। নিরানন্দ অবসর যাপন ঢের বেশি আনন্দঘন হয়ে উঠল।
এর মধ্যে দিয়েই জাপান বাণিজ্যবুদ্ধির এক দিগন্ত উন্মোচন করে ফেলল। শ্রমিকের অনটনকে সামাল দিতে জাপানি উদ্যোগপতিরা সমুদ্রপারের চার দিকে আন্তর্জাল ছড়াল। ব্যয়বহুল শ্রমিকের শারীরিক উপস্থিতি নয়, শ্রমিক এখন টেলিপ্রেজ়েন্স রোবট। কেউ প্রশ্ন করল না, এ-শ্রমিক স্বদেশি না বিদেশি, সাদা না কালো, লম্বা না খাটো। আস্ত একটা জ্যান্ত মানুষকে কেটে-ছেঁটে কল্প-কলের উপযোগী করে তোলা হল। বিশ্বব্যাপী ছড়ানো এই শ্রমিককুলকে সোশ্যাল সিকিয়োরিটি দেওয়ার দায়ও থাকল না। এ এক নতুন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য, যেখানে রোবটের মুখোশ পরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক-একটি মানবযন্ত্র কাজ করে চলে তার কাল্পনিক বাস্তবতার বিচ্ছিন্ন প্রকোষ্ঠে।
এর পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার ঘটে চলেছে। খেয়াল করে দেখুন, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির জগতে যে সব অ্যানিমেশন তৈরি হচ্ছে তা অতিমাত্রায় যৌনগন্ধী, যৌনতাবাদী। ভিডিয়ো গেমে লক্ষ করবেন যে সব অ্যানিম চরিত্র ভায়োলেেন্স মুখ্য অংশ নিচ্ছে তারা অধিকাংশই নারী, সুন্দরী, স্বল্পবাস, তন্বী। আর এগুলো বানাচ্ছে যারা, সেই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির ডিজ়াইনাররা বেশির ভাগই পুরুষ। এই সব অ্যানিমেশনে পুরুষ-শরীরকে সচরাচর আড়াল করা হয়। নারী-শরীরকে প্রকট করে তোলা হয়। অ্যানিমেশনে ভায়োলেন্সের খণ্ড-উপাখ্যানটি দেখানো হয় পুরোপুরি পুরুষ-দৃষ্টির প্রেক্ষিতে।
লিঙ্গভেদের এই স্থানিক পুনর্নির্মাণ আপতিক বা আকস্মিক নয়। এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে নারী সম্পর্কে পুরুষের নেতিবাচক মনোভাব। যৌনমনস্ক ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির প্ল্যাটফর্ম পুরুষের আধিপত্যকেই ঘটনার কেন্দ্রে স্থাপন করে। বেশির ভাগ সময়েই আখ্যান শেষ হয় নারীর অধীনতামূলক মিত্রতায়, কিংবা তার অসহায় আত্মসমর্পণে, আর পুরুষটির নান্দনিক বিজয়-পুলকে। এই দৃশ্যায়নের দর্শক যে পুরুষটি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির চিরন্তন ঘেরাটোপের আড়ালে বসে আছে, তার মনে মনে তৈরি হচ্ছে এক পৌরুষদৃপ্ত যৌনতাবাদ, যেখানে কল্পায়নের আবদ্ধতায় আবিশ্ব পুরুষ একমাত্রিক।
ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির নির্মাণকর্তারা নিঃশব্দে একটি সামাজিক রাজনীতির ডিসকোর্সও রচনা করে চলেছেন। সে-রাজনীতির ভাষ্য তাঁদের নির্মিত অবাস্তব বাস্তবিকতায় যত না নিহিত, তার থেকে ঢের বেশি প্রোথিত তাঁরা যে-বাস্তবকে আড়াল করে চলেছেন, তার মধ্যে। সেই অস্বস্তিকর সমাজ-সত্যকে স্বীকার করলে মানুষের ব্যক্তিগত আড়াল ঘুচে যাবে। তাই সমাজ-বাস্তবতায় যে-বিষয়গুলি অবাঞ্ছিত উপদ্রব, যেগুলির উচ্ছেদ জরুরি বলে একটি সংশোধনবাদী সমাজ সাব্যস্ত করেছে, সেগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির অতিপ্রাকৃত কল্প-জগৎ। আজ অভিজাত গণপরিবহণ মেট্রোর আসনে কিংবা অত্যাধুনিক গ্যাজেট-সমৃদ্ধ সুখী গৃহকোণে হাতে হাতে সেলফোন। তাদের সামনে থরে-বিথরে মনোরঞ্জনের ভার্চুয়াল উপহার-সামগ্রী। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব পুনর্নির্মিত ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি-জগতের অধীশ্বর। এ কোন মানুষ, এ কোন গৃহস্থ, এ কোন প্রতিবেশী, এ কেমন সহযাত্রী! বিস্ময়ে দেখি, আমাদের গায়ে লেগে আছে শুধু সফটওয়্যারের আঁশ! আমরা আমাদের সামাজিক জীবনযাপনের পাসওয়ার্ডটি আউটসোর্স করে দিয়েছি।