তেমন কিছু তো ঘটেনি
Bengali

খুব খেপিয়ে না দিলে কিন্তু বাঙালি ভোটাররা পরিবর্তন চান না

স্মরণ করা যেতে পারে যে, এ অবধি পশ্চিমবঙ্গে যত বার রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, প্রত্যেকটি পরিবর্তনের আগে কোনও না কোনও বড় ঘটনা ঘটেছিল।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১০
Share:

দশ বছর আগে, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে, তৃণমূল কংগ্রেস ‘পরিবর্তন’-এর কথা বলেছিল। এখন, ২০২১ সালে পৌঁছে, বিজেপি দাবি করছে, তাদের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে এ বার ‘আসল পরিবর্তন’ আসতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সত্যি-সত্যিই রাষ্ট্রক্ষমতার আবার একটা পরিবর্তন হবে কি না, সেটা আগামী ২ মে-র আগে জানা যাবে না। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের নিরপেক্ষ চশমা দিয়ে দেখলে বিজেপির দাবি নিয়ে কয়েকটা গভীর সংশয় থেকে যায়।

Advertisement

স্মরণ করা যেতে পারে যে, এ অবধি পশ্চিমবঙ্গে যত বার রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, প্রত্যেকটি পরিবর্তনের আগে কোনও না কোনও বড় ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৬৭ সালে, যখন প্রথম বার কংগ্রেস ক্ষমতা হারাল, তার আগে রাজ্য জুড়ে প্রবল খাদ্যাভাব, এবং তার বিরুদ্ধে বাম সংহতি ও সক্রিয়তা শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর সঙ্গে খাদ্যনীতিতে কিছু অযৌক্তিক কঠোরতা, চাল, মিষ্টি ইত্যাদি বাঙালির অতিপ্রিয় খাদ্যের উপর অহেতুক বিধিনিষেধ, বাঙালির কী খাওয়া উচিত সে-ব্যাপারে অযাচিত সরকারি নির্দেশ (মাছ-ভাত-মিষ্টির বদলে গম ও কাঁচকলা), তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন করে তুলেছিল। ১৯৬৭-র নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর, মনে আছে, নেহাত কংগ্রেসি বাড়িও দু’বেলা দু’গাল ভাত খাওয়ার প্রত্যাশায় তাৎক্ষণিক ভাবে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল।

সেই উল্লাস অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। প্রথম যুক্তফ্রন্ট কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙে গেল, দ্বিতীয়টির ইতিহাসও তথৈবচ। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২-এর মতো অস্থির সময় পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনও আসেনি। এক দিকে নড়বড়ে রাষ্ট্রক্ষমতা, অন্য দিকে নকশাল আন্দোলন। বিপ্লবের নাম করে অকারণ নিরীহ মানুষ হত্যা। শুধু জোতদার নয়, সাংবাদিক, ইস্কুল মাস্টার, ট্র্যাফিক পুলিশ, বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী, কিংবা অন্য যে কেউ যাকে বিপ্লবের শত্রু বলে মনে করা হচ্ছে, তারই নাম ঢুকে যাচ্ছে খতম তালিকায়। পড়াশোনা, কাজকর্ম লাটে উঠেছে। স্বস্তিতে রাস্তায় বেরোনো যায় না, কে জানে কখন গুলি-বোমা শুরু হয়ে যাবে। এক কথায় বলতে গেলে, এই অরাজকতায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ

Advertisement

হয়ে উঠেছিল, যার ফল ১৯৭২ সালে কংগ্রেসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন।

১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা বামফ্রন্টের হাতে চলে গেল। এর অব্যবহিত কারণ ইন্দিরা গাঁধীর ইমার্জেন্সি ঘোষণা। জরুরি অবস্থার সময় কারও কথা বলার অধিকার ছিল না, ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্রোধ জমে উঠেছিল। অতিশয়োক্তি হবে না যদি বলি ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের মসনদ থেকে মানুষ যে কংগ্রেসকে সরিয়ে দিল, তার সব থেকে জোরালো কারণ জরুরি অবস্থা এবং তার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ।

এর পরের দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর বামফ্রন্টের রাজত্ব। এই চৌত্রিশ বছর বামফ্রন্ট রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রটিকে যেমন মজবুত করেছে, তেমনই চিরতরে দুর্বল করে দিয়েছে আমাদের শিল্পের ভিত। কিন্তু এমন কিছু করেনি, যাতে সাধারণ মানুষ খেপে যেতে পারেন। তার থেকেও বড় কথা, তাদের চৌত্রিশ বছরের রাজত্বে বামফ্রন্ট অধিকাংশ পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে একটা বাম ভাবাদর্শ চারিয়ে দিতে পেরেছে। হয়তো এর বীজ আরও অনেক আগে, তেভাগা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, এমনকি নকশাল আন্দোলনের সময় থেকেই মানুষের মনে একটু একটু করে রোপিত হয়েছিল। কিন্তু বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসন যে তাকে বাঙালির মনে স্থায়িত্ব দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। এই সম্মিলিত বাম ভাবাদর্শ থেকে বাঙালি এখনও বেরোতে পারেনি। বস্তুত, যখন বামফ্রন্ট এই ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষকদের জমি কেড়ে শিল্প-স্থাপনের চেষ্টা করল, ঠিক তখনই পতন ঘটল তাদের। যদি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন না হত, তা হলে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটত না।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৭-র আগে খাদ্য আন্দোলন, ১৯৭২-এর আগে নকশাল আন্দোলনের অরাজকতা, ১৯৭৭-এর আগে ইমার্জেন্সি এবং ২০১১-র আগে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন— প্রত্যেকটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে একটা করে বড় ঘটনা ঘটেছে। এটা কাকতালীয় হতে পারে না। বাঙালি ভোটাররা স্বভাব-সহনশীল, খুব খেপিয়ে না দিলে তাঁরা ক্ষমতাসীন দলকে সরাতে চান না। প্রশ্ন, ২০২১-এর আগে বড় ঘটনা কী এমন ঘটেছে যাতে বিজেপি মনে করছে যে, এ বার ‘আসল পরিবর্তন’ আসবে?

পরিবর্তনের দুটো কারণের কথা বিজেপি মুখে বলছে। এক, দুর্নীতি; এবং দুই, বড় মাপের শিল্পায়নে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা। এর কোনওটাই কিন্তু কারণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি যদি সরকার পরিবর্তনের কারণ হতে পারত, তা হলে ২০১৬ সালেই— যখন সারদা-নারদা নিয়ে চর্চা চরমে— সরকার বদলে যেত। তার পরে তৃণমূলের নেতাদের জড়িয়ে নতুন কোনও তথ্য জনসাধারণের সামনে আসেনি। শুধু দিল্লির শাসক দল ভোটের ঠিক আগে ইডি ও সিবিআই-এর সাহায্যে পুরনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জনমানসে সেই পুরনো দুর্নীতির স্মৃতি উস্কে দিতে চেয়েছে। এতে চিঁড়ে ভিজবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, মেনে নেওয়া ভাল যে, পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ ভোটারের কাছে বড় মাপের শিল্পায়ন বা তার অভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। যদি তা হত তা হলে বামফ্রন্ট এত বছর রাজত্ব করতে পারত না।

গত লোকসভার নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলের থেকে মাত্র চারটি সিট কম পেয়েছিল। তাদের ভোট শতাংশেরও উন্নতি ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে। তাই বিজেপি নেতারা ভাবছেন, এই বিধানসভা নির্বাচনে একটু উঠে পড়ে লাগলেই পশ্চিমবঙ্গটা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। উঠে পড়ে যে তাঁরা লেগেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্য সর্বভারতীয় বিজেপি নেতাদের এত বার নির্বাচনী প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে আসাটা আগে কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু মানুষ যে বিবেচনায় লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন, ঠিক সেই বিবেচনাতেই কি বিধানসভায় ভোট দেবেন?

লন্ডন ইউনিভার্সিটির বিমল বালসুব্রহ্মণ্যম, ওয়ারিক ইউনিভার্সিটির অপূর্ব ভাটিয়া এবং অশোকা ইউনিভার্সিটির সব্যসাচী দাসের একটি অপ্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র থেকে জানতে পারছি, ভারতীয় ভোটাররা যখন লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে এক সঙ্গে ভোট দিচ্ছেন, তখন দু’টি স্তরে একই দলের জেতার সম্ভাবনা প্রায় ২১% বেড়ে যাচ্ছে। এর মানে হল, এক সঙ্গে ভোট হলে মানুষ মোটের উপর একই দলকে ভোট দিচ্ছেন। কিন্তু আলাদা আলাদা সময় লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচন হলে সেটা বলা যাচ্ছে না। এই গবেষণার তাৎপর্য এই যে, পশ্চিমবঙ্গে যে হেতু আলাদা আলাদা সময় লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট হচ্ছে, লোকসভার ভোটের ফল দিয়ে বিধানসভা ভোটের ফল ভবিষ্যদ্বাণী করা মুশকিল।

বিজেপির আসল জোর অবশ্য টাকার। অভিযোগ, টাকার জোরেই তারা তৃণমূলের কিছু নেতাকে ইতিমধ্যে হাত করে ফেলেছে। টাকার জোরে তারা যে পরিমাণে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। কিন্তু শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে বাঙালি ভোটারদের মন পাওয়া কি সম্ভব? আগেই বলেছি, সিংহভাগ বাঙালি ভোটারের একটা বাম ভাবাদর্শ আছে। এই ভাবাদর্শ পুনর্বণ্টনের, ধর্মনিরপেক্ষতার। এই ভাবাদর্শ অনুযায়ী অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের জরুরি ভূমিকা থাকবে। এই ভাবাদর্শের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাদর্শের কোনও বিরোধ নেই।

পক্ষান্তরে, বিজেপির ভাবাদর্শটা বাম ভাবাদর্শের একেবারে বিপরীত মেরুতে, তারা নির্বাচনী ইস্তাহারে যা-ই লিখুক না কেন। সারা পৃথিবী জানে, বিজেপি একটি দক্ষিণপন্থী, হিন্দুত্ববাদী দল। যে কোনও দক্ষিণপন্থী দলের মতো সরাসরি পুনর্বণ্টনে তাদের ততটা আস্থা নেই, যতটা বাজার-চালিত প্রতিযোগিতার উপর আছে। একই কারণে তারা পাইকারি ভাবে বেসরকারিকরণের পক্ষে। আর তারা যে ধর্মনিরপেক্ষ নয়, সেটা তো সর্বজনবিদিত। এ সবই কিন্তু সনাতন বাঙালি বিশ্বাসের পরিপন্থী। সে ক্ষেত্রে অবিশ্রাম বিজ্ঞাপনের দ্বারা সম্মোহিত হয়ে বাঙালি যদি বিজেপিকে বরণ করে আনে, সেটা তার পক্ষে খুব গৌরবের হবে না। বিশেষ করে যখন সম্প্রতি বড় কোনও ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে ঘটেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement