মেট্রো রেলের নামকরণের স্বেচ্ছাচারের কাহিনি। ফাইল চিত্র।
আপনি কি স্তালিনগ্রাদ যেতে চান? কমরেড জোসেফ ভিসারোনিয়োভিচ স্তালিনকে আপনি পছন্দ না-ই করতে পারেন, কিন্তু ওই যুদ্ধ তো পৃথিবী এখনও ভোলেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম নির্ণায়ক যুদ্ধ ছিল স্তালিনগ্রাদ শহর দখলের জার্মান আর সোভিয়েট ইউনিয়নের লড়াই, যাতে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের শহর আর আজ মানচিত্রে খুঁজে পাবেন না। ১৯৬১ সালে স্তালিনের উত্তরসূরি কমরেড ক্রুশ্চেভ সেই শহরের নাম পাল্টে করেছেন ভল্গোগ্রাদ, ভল্গা নদীপারের শহর। তবে আপনি স্তালিনগ্রাদ যেতেই পারেন আর সে স্তালিনগ্রাদ বেঁচে আছে প্যারিসে, প্যারিসের মেট্রোতে। কেন প্যারিসে, সেখানকার কি কারও অনুপ্রেরণায় একটি রাশিয়ান শহরের নামে ফ্রান্সের রাজধানীতে একটি রেল স্টেশন হয়ে গিয়েছিল? আসলে প্যারিসের বুলেভার দ্য লা ভিল্লেত্তে রাস্তার মেট্রো স্টেশনের নাম ছিল বুলেভার দ্য লা ভিল্লেত্তে, যেমনটা হয়। ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধবিজয়কে সম্মান জানাতে ওই বুলেভার দ্য লা ভিল্লেত্তে রাস্তার একটি অংশের নাম হল প্লাস দ্য স্তালিনগ্রাদ এবং ফলে নিকটস্থ মেট্রো স্টেশনের নামও পরিবর্তিত হল স্তালিনগ্রাদ।
পাঠককে মেট্রো স্টেশনের নামকরণ বোঝাতে সুদূর বিদেশে হাইজ্যাক করার কারণ দেশে ও বিদেশে স্থানীয় স্থান নামেই রেলের স্টেশন হয়। স্থানের নাম পাল্টে হল প্লাস দ্য স্তালিনগ্রাদ, ফলে স্টেশনের নামও হল তাই।
ভারতীয় রেলের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ভাবে স্টেশনের নামকরণ হয়। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সেই স্থানের সঙ্গে জড়িত কোনও বিশেষ ঘটনা, বিশেষ ব্যক্তিত্ব, বিশেষ প্রতিষ্ঠানের নামেও স্টেশন হয়। কিন্তু কারও খেয়ালখুশিমতো রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় না, যায়ও না। আপনি ট্রেনে চাপেন কোনও স্থানে যাওয়ার জন্য, শুধু কোনও বিশেষ নামের স্টেশনে যাওয়ার জন্য নয়। যিনি গড়িয়া যাবেন রেলের টিকিট কাটেন গড়িয়া স্টেশনের, কিন্তু মেট্রো রেলে গড়িয়া যেতে হলে তাঁকে নামতে হবে কবি নজরুল স্টেশনে! এই বিড়ম্বনা আপনি মেনে নিয়ে ভাববেন যে, এই রসিকতার নিশ্চয় কোনও গম্ভীর কারণ আছে, বিদ্রোহী কবির জন্মস্থান না হলেও গড়িয়ার সঙ্গে কবির কোনও গভীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। না, সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে গুগল ঘেঁটেও তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। তা হলে এই নামকরণ কারণহীন— কারও স্বেচ্ছাচার।
রেল স্টেশনের নামকরণের এই স্বেচ্ছাচার শুরু হয় ২০০৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বের মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রী হওয়ার পর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য অভিজ্ঞ রেলমন্ত্রী, এর এক দশক আগে ১৯৯৯-এর অক্টোবর থেকে ২০০১-এর মার্চ, দেড় বছর বিজেপি নেতৃত্বের মন্ত্রিসভায় রেলমন্ত্রী ছিলেন এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব তিনি গোপন রাখেননি। ২০০৯-এর মে মাসে আবার রেলমন্ত্রী হয়েই তিনি কলকাতা মেট্রোর সম্প্রসারণের কাজে গতি আনলেন এবং দুই দশক পর কলকাতা মেট্রোয় নতুন ছয়টি স্টেশন যুক্ত হল। এর আগের কলকাতা মেট্রোর ১৭টি স্টেশনের নামকরণ হয়েছে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্থান-নামেই। রবীন্দ্রনাথের নামে দু’টি স্টেশন হয়েছে রবীন্দ্র সদন ও রবীন্দ্র সরোবরের নিকটস্থ বলে। নেতাজি সদন স্টেশন হয়েছে কাছেই সুভাষ চন্দ্র বসুর বাসভবন রয়েছে বলে। কিন্তু যিনি প্রচলিত রীতির কখনওই তোয়াক্কা করেন না, তিনি নিজের খুশিমতো নতুন ছয়টি স্টেশনের নামকরণ করলেন কয়েক জন বাঙালি ব্যক্তিত্বের নামে। একমাত্র বাংলার সিনেমা স্টুডিয়োপাড়া টালিগঞ্জ স্টেশনের নাম বদলে চিত্রাভিনেতা উত্তমকুমারের নামে করা অসমীচীন হয়নি। কিন্তু বাকি সব কয়টি স্টেশনের নামকরণ হয়েছে নিজের খুশিতে। নজরুল, সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, নেতাজিরা নমস্য ব্যক্তি, কিন্তু এই সব স্থানের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই। কবি সুভাষ অর্থাৎ বামপন্থী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় শেষ জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের মানুষ হওয়ায় তিনিও স্টেশন হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের নামে দু’টি স্টেশন ও নেতাজির নামে একটি স্টেশন মেট্রো রেলে থাকা সত্ত্বেও সম্ভবত এঁদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ বিজ্ঞাপিত করতে গীতাঞ্জলি ও নেতাজি স্টেশন করা হল। ২০০৯-১০’এর ব্যাপার, তখন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর্ব শুরু হয়ে গেছে, বাঙালির প্রিয় মনীষীদের নাম যুক্ত থাকায় সম্ভবত কোনও রাজনৈতিক দল যাত্রীদের সঙ্গে এই নিদারুণ রসিকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
এ তো সবে উপক্রমণিকা। আরও বড় রসিকতা বাকি ছিল। কংগ্রেস সরকারের রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১-তে নিউ গড়িয়া থেকে কলকাতা বিমানবন্দর মেট্রো লাইনের প্রকল্পটির উদ্বোধন করলেন। তখনই এই মেট্রো লাইনের ২৩টি স্টেশনের নামকরণ করে ফেলা হল। যথারীতি যেমন খুশি নামকরণ। সঙ্গীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সিনেমার সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক স্থান পেলেন, বামপন্থী কবি সুকান্তও পেলেন একটি স্টেশন। যে ভাবে কবি সুভাষ ঢুকেছিলেন স্টেশন তালিকায়, সে ভাবেই বাংলার প্রখ্যাত সম্পাদক প্রফুল্ল কুমার সরকার, শিশির ঘোষ, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে তালিকায় নাম তুলে ফেললেন তাঁর প্রিয় গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত। এমনকি স্টেশন হল জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর নামে। এই সাহিত্যিকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি উনি জীবিত থাকলে বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের বাদ দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ওঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিশ্চয় মেনে নিতেন না!
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, এই সব তালিকায় শিল্পসাহিত্যের বাইরে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক, শিল্পপতি, খেলোয়াড়দের কোনও স্থান নেই। অবশ্য এই সব বাঙালি যে-হেতু বুদ্ধিজীবী প্রজাতির বলে পশ্চিমবঙ্গে গণ্য হন না, ফলে তাঁদের এই তালিকায় স্থান পাওয়া কঠিন। এই হল মেট্রো রেলের নামকরণের স্বেচ্ছাচারের কাহিনি।
এই স্বেচ্ছাচারে মেট্রো যাত্রীদের ভীষণ অসুবিধা তো হচ্ছেই। তা ছাড়া অপমান করা হচ্ছে স্থানীয় আবেগকেও। গড়িয়া আদি গঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ। হঠাৎ সে ইতিহাস বাতিল করে স্টেশনের নাম নজরুল করা কি কবিরই অপমান নয়? চারণকবি মুকুন্দদাস, স্বদেশি গানের কবি মুকুন্দদাস— তাঁর দেশ বরিশাল থেকে আগত উদ্বাস্তুদের বসতি অঞ্চলের নাম মুকুন্দপুর। এখানে মুকুন্দদাসের নামে বিদ্যালয়, তাঁর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মূর্তি স্থাপন করে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রেখেছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। এঁদের সবার আবেগের অসম্মান করে এখানের মেট্রো স্টেশনের নাম করা হল জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। পাঁচ দশক আগে কালিকাপুর খ্যাত হয়েছিল কৃষক আন্দোলনে। এই পুরনো স্থানের সঙ্গে যোগাযোগহীন কবি সুকান্ত এখানকার স্টেশনের নাম।
কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদী, খাল, জলাভূমির স্মৃতি— সেই স্মৃতির রেশ নিয়ে জেগে থাকা চিংড়িঘাটা হয়ে গেল গৌরকিশোর ঘোষ। সায়েন্স সিটির রেল স্টেশনের নিকটস্থ স্টেশনের নাম হল বিজ্ঞানের সঙ্গে যোগাযোগহীন ঋত্বিক ঘটক। আরও গোটা দুয়েক নজরুল ও এক পিস রবীন্দ্রনাথও জায়গা করে নিয়েছে এই নতুন লাইনে। এ রকম স্বেচ্ছাচারের ২৩টি মাইলফলক এই নতুন ২৩টি মেট্রো স্টেশনের নাম।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে চলে আসার পর কলকাতা ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো লাইন হচ্ছে, সেখানে স্টেশনের নামকরণ হচ্ছে স্থান নামেই, প্রচলিত রীতি অনুযায়ীই। আর দিল্লি মেট্রো এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মেট্রো পরিষেবা এবং সেখানে স্টেশন সংখ্যা ২৫৫টি। এই বিপুল সংখ্যার স্টেশনের নামকরণে কোনও স্বেচ্ছাচার বা রসিকতা নেই। নামকরণ হয়েছে স্থান নামেই।
আশ্চর্য বিষয় হল, এই স্বেচ্ছাচারের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বজ্জন বুদ্ধিজীবীরা সবাই এক সঙ্গে নীরব। একই ভাবে নীরব রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার, তার পর থেকে রেলমন্ত্রী বিজেপির নেতারাই। এ ভাবে মেট্রো রেল স্টেশনের নামকরণের বিরোধিতায় রেলমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন দলীয় ব্যক্তিত্বরাও। তিতুমীর নামের স্টেশনটির নাম সম্প্রতি পরিবর্তন হয়েছে, আর কিছুই হয়নি। মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের মতামত সম্পর্কে উদাসীনতা সর্বভারতীয় দলগুলির নেতৃত্ব গত পঁচাত্তর বছর ধরেই বহন করে চলেছে। রেল মন্ত্রকের এখনও সময় ও সুযোগ আছে এই স্বেচ্ছাচারের নামফলকগুলি বদলে আবার স্থান নামের পুনর্বাসন করার।
নইলে ইতিহাসে লেখা থাকবে এই স্বেচ্ছাচারী নামকরণ-সহ নিউ গড়িয়া থেকে কলকাতা বিমানবন্দর মেট্রো লাইন চালু হয়েছিল বিজেপি সরকারের আমলেই।