‘মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা’
Mamata Banerjee

যা কিছু বলার স্বাধীনতা

কু-জনে বলে, ভারতের রাজনীতিতে এবং বিশ্বে সংক্ষিপ্ততম আতঙ্ক-কাহিনি হল একটিই শব্দ— ‘মিত্রোঁ’। নোটবন্দির বক্তৃতার পর থেকেই এই কাহিনির উদ্ভাবন।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২২ ০৫:০৭
Share:

লম্বা গলার অনেক উপকারিতা।

কেষ্টকে গ্রেফতার করলেন কেন, কী করেছিল কেষ্ট?’ কী করেছিল?

Advertisement

শুনে ভয় লাগল।

কেমন ভয় জানেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নিশীথে’ গল্পটিতে দক্ষিণারঞ্জনবাবুর প্রথম স্ত্রী (যিনি তখন অসুস্থ, শয্যালগ্নও বটে), চিকিৎসকের অল্পবয়সি মেয়েটিকে প্রথম দেখে প্রশ্ন করেছিলেন ‘ও কে গো?’ দক্ষিণারঞ্জনবাবু তত দিনে ডাক্তারের কন্যা মনোরমার প্রতি আকৃষ্ট, স্ত্রীকে ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদিতে নিত্য ভুল। এর পরে স্ত্রীর মৃত্যু হলে মনোরমাকে বিয়ে করেন দক্ষিণারঞ্জনবাবু। কিন্তু নবদাম্পত্যে জাল বিছিয়ে দিল একটিই ধ্বনি! “কিন্তু আমার কানের কাছে, অন্ধকারে আবার সেই অবরুদ্ধ স্বর বলিয়া উঠিল, ‘ও কে, ও কে, ও কে গো।’ আমার বুকের রক্তের ঠিক সমান তালে ক্রমাগতই ধ্বনিত হইতে লাগিল, ‘ও কে, ও কে, ও কে গো। ও কে, ও কে, ও কে গো।’ সেই গভীর রাত্রে নিস্তব্ধ বোটের মধ্যে আমার গোলাকার ঘড়িটাও সজীব হইয়া উঠিয়া তাহার ঘণ্টার কাঁটা মনোরমার দিকে প্রসারিত করিয়া শেলফের উপর হইতে তালে তালে বলিতে লাগিল, ‘ও কে, ও কে, ও কে গো! ও কে, ও কে, ও কে গো!’”

Advertisement

পড়লেই ভয় করে। শুনলেই ভয় করে। বলতেও ভয় করে।

এ তেমনই এক শব্দগুচ্ছ। ‘কী করেছিল?’

আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সকলেই অভিযুক্ত, কেউ দোষী নন, এ আপ্তবাক্যটি মাথায় রেখে, কেন্দ্রীয় সংস্থার যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ মাথায় রেখেও বলা যায়, গুন্ডামি, অত্যাচারতন্ত্র যদি ‘কী করেছিল’তে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, আতঙ্কের প্রভূত কারণ রয়েছে।

কু-জনে বলে, ভারতের রাজনীতিতে তো বটেই, বিশ্বে সংক্ষিপ্ততম আতঙ্ক-কাহিনি হল একটিই শব্দ— ‘মিত্রোঁ’। নোটবন্দির বক্তৃতার পর থেকেই এই আতঙ্ক-কাহিনির উদ্ভাবন। এই ভয়টিও স্থায়ী। যেমন নতুন ভয় ১৫ অগস্টের প্রাতঃবাণীটি। আচরণে তো নয়ই, কোনও ভাবে কোনও বাক্যেও মেয়েদের যেন অসম্মান করা না হয়। একটি পরিচ্ছেদ প্রায় বললেন তিনি, এবং বলার সময় সামান্য থেমে আবেগ দেখানোর কষ্টকল্পও ছিল। উন্নাও, হাথরসের ধর্ষণের ঘটনায় দেশ উত্তাল হলেও যিনি নীরব ছিলেন, তিনি বলছেন মেয়েদের যেন অসম্মান করা না হয়। আর ঘটনাচক্রে বিকেলেই গুজরাতের বিজেপি সরকার গঠিত বিশেষ কমিটি বিলকিস বানোর গণধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবনের সব আসামিকেই মুক্তি দিল। ২০০২ সালে গোধরা অগ্নিকাণ্ডের পর দাঙ্গা থেকে পালাতে গিয়ে বিলকিসের তিন সন্তান নিহত হয়, বিলকিসকে ধর্ষণ করা হয়। অমৃত মহোৎসবে বিশেষ ক্ষেত্রে আসামিদের মুক্তিদান প্রসঙ্গে মোদী সরকারের ঘোষিত নীতিতে কিন্তু ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়নি। অথচ তার ঠিক উল্টো পথেই হেঁটেছে গুজরাতের বিশেষ কমিটি। কী ভাবে এই বাতাবরণ তৈরি হয়?

অসত্য কথা, অসত্য প্রতিশ্রুতি, অত্যাচারকে সমর্থন যখন রাষ্ট্রনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে চোখের সামনে, সব অত্যাচারিতদের ভূত-প্রেত প্রশ্ন করে চলে, ‘ও কে, ও কে গো, ও কে গো!’

শুধু আতঙ্ক-সাহিত্য চর্চা নয়, স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে একটি অতিচিৎকৃত বক্তৃতা শুনে প্রাণিচর্চারও চেষ্টা করা গেল। সব ভাষার মতোই বাংলাতেও এক-একটি শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়। যেমন ধরুন গলা। তা আমরা কণ্ঠস্বর বোঝাতে বলি, আবার শরীরের অংশ বোঝাতেও প্রয়োগ করি।

‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনফর্মার’-এর সাইটে প্যাট্রিসিয়া গ্রিন-এর একটি নিবন্ধে লম্বা গলা (বড় গলাও বলতে পারি) নিয়ে কিছু তথ্য রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পুরুষ জিরাফের গলা সাধারণত ৮ ফুট হয়, মেয়ে জিরাফের গলা ৭ ফুট। ডারউইনবাদ বলে, আফ্রিকায় খাবারের জন্য লড়াই করে বেঁচে থাকতে, বিবর্তনের ফলে জিরাফের গলা লম্বা হয়েছে, যাতে নিরামিষাশী প্রাণীটিকে, জঙ্গলের পাতা নিয়ে লড়াই করার বদলে গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা অনায়াসে খেয়ে জীবন নির্বাহ করা কিছুটা সুবিধের হয়।

মূলত খাবারের জন্য লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা (জলে গলা ঢুকিয়ে খুঁটে খাওয়া বা উঁচু গাছ থেকে ডালপালা খাওয়া বা পা বেশি লম্বা হলে যাতে পা মুড়ে বসে খেতে না হয়, সবই হতে পারে) গলা বাড়িয়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করা, শত্রু আসছে কি না আগেভাগে আঁচ করা, চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ গলা বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে শিকার গলাধঃকরণ করা, সব কারণেই গলার দৈর্ঘ্য প্রয়োজন। অস্ট্রিচ বা উটপাখি, ৩.২ ফুট লম্বা গলা, (সেই গলা আবার ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেখে নিতেপারে শত্রু কোথায়) ওয়ালার গ্যাজেল, .৮ ফুট লম্বা গলা, মাংসাশী কচ্ছপ, স্নেক নেকড টার্টলস, যাদের গলা .৬ ফুট, গোলাপি রঙের .৭ ফুট লম্বা গলার স্কারলেট আইবিস, হুপার সোয়ান— যে রাজহাঁসের ৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর গলাই ৩ ফুট, ২.৬ ফুট গলার ফ্লেমিঙ্গো, আফগানিস্তান, পশ্চিম এশিয়াএবং সাহারায় ঘুরে বেড়ানো ড্রোমডেরি ক্যামেলস (গলা সাড়ে ৬ ফুটের বেশি), উঁচু গাছ থেকে পাতা খেতে পটু ৩.৮ ফুট গলার আলপাকা, আর ৪.৩ ফুট গলার লামা— লম্বা গলার অনেক উপকারিতা। ফলে আঙুল তুলে কেউ চেঁচালেই, পৃথিবীতে শুধু বিশেষ কারও ‘বড় গলা’ হয় (কারও দোষের জন্য কারও পিতৃমাতৃপরিচয় উল্লেখ করে কটূক্তি করা বিকৃত মানসিকতার ধরন, ফলে তা উল্লেখ করলাম না সচেতন ভাবেই), এমন ভুল ধারণা বা ভুল বলার কোনও কারণ নেই।

যদিও জননেত্রী এর আগে এক সভায় বিজেপিকে আক্রমণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, চোরের মায়ের বড় গলা, চোর কি মাই জোরসে বোলে, মাদার অব থিফ সাউন্ডস মোস্ট।

‘কী করেছিল কেষ্ট?’

‘ও কে, ও কে গো, ও কে গো!’

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এবং স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাদ্বয় শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান খুব মনে পড়ছিল— স্বদেশ পর্যায়ের ‘আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না’।

‘এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি—

মিছে কথা কয়ে, মিছে যশ লয়ে, মিছে কাজে নিশিযাপনা!’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement