বিপন্ন: আকাশ থেকে তোলা ছবিতে আমাজন অরণ্যের মনুষ্যসৃষ্ট সঙ্কট, ব্রাজিল, ৮ জুলাই। রয়টার্স।
দেড় দশক আগে আইপিসিসি আর আল গোর যৌথ ভাবে শান্তির নোবেল পাওয়ার পর থেকেই কি জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক রূপরেখা পশ্চিম বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে বেশি স্পষ্ট হল? তার কিছু বছর পর সুদূর স্টকহোমের কোনও এক আশ্চর্য মেয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বের তাবড় রাজনৈতিক নেতাদের ভর্ৎসনা করলেন তাঁদের যুগান্তের নিষ্ক্রিয়তার জন্য, বললেন “কী সাহস তোমাদের!” পরিবেশ নিয়ে আলোচনা আর সিরিয়াস বৈঠকে আটকে থাকল না, ড্রয়িংরুমে নেমে এল। এই প্রথম।
রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সংক্রান্ত ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ়’ (সিওপি) তো হয়ে আসছে সেই ১৯৯৫-এর বার্লিন সম্মেলন থেকেই। পরিকল্পনা হয়েছে বিস্তর। দড়ি-টানাটানি হয়েছে আরও বেশি। কোভিডের জন্য বছরখানেক থমকে থাকার পর যখন ২০২১-এ সিওপি২৬ সংগঠিত হল গ্লাসগোতে, অবাক বিস্ময়ে দুনিয়া দেখল একটা জলবায়ু সম্মেলন নিয়েও মিডিয়া, এমনকি সাধারণ জনতারও কতটা মাতামাতি সম্ভব।
এ বছর ৬-১৮ নভেম্বর মিশরের শার্ম এল-শেখ শহরে ‘সিওপি২৭’-এর আগেই আমাজনের অরণ্য নিয়ে জলবায়ু কর্মীদের উৎফুল্ল হওয়ার কারণ ঘটেছে বিলক্ষণ। সদ্যসমাপ্ত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী লুলা দা সিলভা ভোটের আগেই নির্বিচারে আমাজন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনিতেই বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্য ধ্বংসের প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া দুনিয়ার উষ্ণায়নের ফলে উদ্ভূত হয়েছে প্রলয়কালের পরিস্থিতি। মানুষ যেন এখন এক বিপন্ন প্রজাতি। যে আমাজনের অরণ্য ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত, তা আজ যতটা কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি করে, শুষে নেয় তার চাইতে কম। প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর আমলে নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছে আমাজন, প্রধানত কৃষিজমি, মাংস উৎপাদন এবং খননের প্রয়োজনে। গত বছরেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি।
আমাজন নিয়ে উদ্বিগ্ন দুনিয়া উদ্গ্রীব হয়ে ছিল ব্রাজিলের ভোটের ফলের জন্য। কিন্তু এ কথা তো স্পষ্ট যে অতিমারি-বিধ্বস্ত দেশটাতে খাদ্য, জীবিকা, চিকিৎসা-পরিষেবা, অসাম্য, দুর্নীতির বিষয়গুলি এতটাই প্রকট যে, জলবায়ুর সঙ্কট এবং আমাজন রেনফরেস্ট উজাড়ের সমস্যা অধিকাংশ ব্রাজিলীয়র চলমান জীবনের বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। তবু ভোটের বাজারে নেতাদের আজকাল পরিবেশ আর জলবায়ু নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। কারণ তাঁরা মনে করছেন, এ সবের খানিক ব্যালট-মূল্য আছে। এবং সেটাই আসল কথা। যেমন, এ বারের হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনের লড়াইতে তাঁর প্রস্তাবিত আমাজন-নীতি লুলা-কে হয়তো সামান্য সাহায্য করে থাকতেও পারে, কে জানে!
যেমন অস্ট্রেলিয়ার ২০২২-এর ভোট, যাকে বলা হয়েছে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের নির্বাচন’। জনপ্রতি কার্বন নিঃসরণে একেবারে উপরের সারিতে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। নেতাদের যুগান্তের নিষ্ক্রিয়তার প্রতীক হয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। গত তিন দশকের রেকর্ড-ভাঙা বুশফায়ার আর বন্যায় কিন্তু টনক নড়েছে অস্ট্রেলীয়দের। জলবায়ুর পরিবর্তন হয়ে উঠেছিল ভোটের এক প্রধান বিষয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী লেবার পার্টির নেতা অ্যান্টনি অ্যালবানিজ়-এর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেই ছিল জলবায়ু নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে দেশকে সমৃদ্ধ করা।
ঐতিহাসিক ভাবে অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনৈতিক প্রভাব হয়নি বিশেষ। আমেরিকার ২০২০-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষিতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার বুথফেরত সমীক্ষক সংস্থা এডিসন রিসার্চকে বলেছিলেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তন একটি ‘গুরুতর সমস্যা’। কিন্তু মজার কথা হল, এঁদের মধ্যে ২৯ শতাংশই ভোট দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, যে ট্রাম্প প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন আমেরিকাকে, জলবায়ু বিষয়ে যাঁর অবস্থান স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই জনগণ জলবায়ুকে খানিক গুরুত্ব দিতে শিখলেও এযাবৎ ভোটে তা কতটা নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পেরেছে, সে নিয়ে সন্দেহ থাকবেই। তবে তা নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে কঠিন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে, অন্তত তাই বোধকরি মনে করছেন রাজনীতিবিদরা। যেমন এ বারের আমেরিকার অতি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তিকালীন ভোটের প্রেক্ষিতে জলবায়ুর উন্নতিতে সহমত ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনে ১২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ২ মিলিয়ন ভোটারকে উদ্দেশ করে। এই ভোটাররা জলবায়ু এবং পরিবেশের সমস্যাকে অসম্ভব গুরুত্ব দেন, ২০২০-তে এঁরা সমর্থন করেছিলেন বাইডেন-কে, কিন্তু ভোট দেওয়া নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন এ বার। ও-দিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন অগস্টে সই করেছেন ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’-এ, যাকে তিনি বলেছেন ‘জলবায়ু নিয়ে সর্বকালীন সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ’। জীবাশ্ম জ্বালানিকে পিছু হটিয়ে পরিচ্ছন্ন শক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ি, সৌরবিদ্যুৎ-চালিত ব্যাটারি ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৩৬৯ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য এ সবের কতটা ‘সিওপি’ নামক বাৎসরিক সম্মেলনের প্রভাব আর কতখানি ভোটের দায়, তার হিসাব কষা মুশকিল বইকি।
সিওপি২৬-এ বিস্তর আলোচনা হয়েছে পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রাকে শিল্পযুগ শুরুর আগের তাপমাত্রার চাইতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে আটকে রাখার। কিন্তু বাস্তবে এই সীমাটা আড়াই ডিগ্রিরও বেশি। কার্বন নিঃসরণে অগ্রণী দেশগুলি যে এই সম্মেলনগুলিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তেমনটাও হয়তো নয়। গ্লাসগোতে যাননি শি চিনফিং, ভ্লাদিমির পুতিন, জাইর বোলসোনারো। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে এ বার কারা মিশর অবধি পৌঁছন, সেটাও দেখার। পরিকল্পনা আর প্রতিশ্রুতির মোড়কে জলবায়ুর বিপর্যয়ের ছবিটা আবৃত করার অতিরিক্ত কী হচ্ছে এই সম্মেলনগুলিতে, সেটাও প্রশ্ন বটে। সিওপি-র মাধ্যমে মিশরের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ‘গ্রিনওয়াশ’ করা হচ্ছে, এমন অভিযোগও রয়েছে এ বারের সিওপি নিয়ে। সম্মেলন বয়কট করেছেন গ্রেটা থুনবার্গের মতো জলবায়ু কর্মী।
আসলে দীর্ঘ দিন ধরে ‘কথা’ দেওয়া হয়েছে অনেক। রাখা হয়নি বেশির ভাগই। ২০০৯-এ উন্নত দেশগুলি ‘কথা’ দিয়েছিল ২০২০ থেকে জলবায়ুর উন্নতিকল্পে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বছরে দেবে ১০০ বিলিয়ন ডলার। তা বাস্তবায়িত হয়নি আজও। তাই এখন বোধকরি কথা রাখার সময়। জলবায়ু রক্ষাকল্পে দেশগুলির নিজেদের পরিকল্পনার রূপরেখা জমা দেওয়ার কথা এই সিওপি২৭-এ। এবং এই হয়তো প্যারিস পরিবেশ চুক্তি ভেঙে যাওয়ার আগে কার্বন নিঃসরণ কমাবার শেষ সুযোগ।
কিংবা, শেষ কথা কে বলবে? তার পরও থেকে যাবে ব্যালটের শক্তি। গ্রেটা থুনবার্গ যেমন বলেছেন, এই সিওপি কনফারেন্স পুরো সিস্টেমকে বদলাবার জন্যে নয়, বরং তা ধীরে ধীরে উৎসাহিত করে অগ্রগতিকে। তবু, এ গ্রহে দাপট দেখানো ক্ষুধা কিংবা অসাম্যকে অতিক্রম করে ‘জলবায়ু’ই হয়ে উঠবে বহুসংখ্যক মানুষের ভোটদানের প্রধান বিচার্য বিষয়, সেও বড় সহজ নয়। আশা-নিরাশার পেন্ডুলামের দোলার মধ্যেই আপাতত আমাদের বাঁচা।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা