Climate Change

সামগ্রিক বিপদ, খণ্ডিত ভাবনা

জলবায়ু বদল পুরোপুরি ঠেকানোর পরিস্থিতি আর নেই। বিশ্বের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তাই তাপমাত্রার আরও বৃদ্ধিতে লাগাম পরানো যেতে পারে।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৩ ০৫:১৮
Share:

ফাইল চিত্র।

রাজ্য বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে পরিবেশ দফতরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১০১.৩ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের তুলনায় দু’কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে। পরিবেশ দফতরের কাজের খতিয়ানও রয়েছে। তাতে ‘স্টেট এনভায়রনমেন্ট প্ল্যান’ এবং ‘ডিস্ট্রিক্ট এনভায়রনমেন্ট প্ল্যান’ অনুযায়ী পরিবেশ দফতর কাজ করছে। এ ছাড়াও, নদীর জলপ্রবাহের গুণমান রক্ষা, বায়ুদূষণ কমানো, পরিচ্ছন্ন দেওয়ালি উদ্‌যাপন ইত্যাদি কাজও পরিবেশ দফতর করছে। তবে পরিবেশ দফতরের কাজের খতিয়ানে একটি বিষয় বহু খুঁজেও পাওয়া গেল না— সামগ্রিক ভাবে জলবায়ু বদলের বিপদ ঠেকাতে কী পরিকল্পনা করা হয়েছে?

Advertisement

জলবায়ু বদল পুরোপুরি ঠেকানোর পরিস্থিতি আর নেই। বিশ্বের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। তাই তাপমাত্রার আরও বৃদ্ধিতে লাগাম পরানো যেতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা যে-হেতু অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে তাই দুর্যোগ হবে। সে ক্ষেত্রে দুর্যোগ হলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা যাবে, তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও প্রয়োজন।

সেই প্রয়োজনীয়তার কারণও যথেষ্ট আছে। মনে করা যাক, ২০২০ সালের মে মাসের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আমপান আছড়ে পড়েছিল এ রাজ্যে। ঝড়ের তাণ্ডব, জলোচ্ছ্বাস— সব মিলিয়ে লন্ডভন্ড হয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। ২০২১ সালের মে মাসে এসেছিল আর এক অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ঝড়ের তাণ্ডব তুলনায় কম হলেও জলোচ্ছ্বাসের জেরে ভেসে গিয়েছিল উপকূলীয় বহু এলাকা। এই দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল জনজীবন। বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের জীবনের ক্ষতি অনেকাংশেই অপূরণীয়। আবহবিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদদের একাধিক গবেষণায় স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, এই ধরনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা আরও বাড়বে। তাতে বার বার জনজীবন বিপর্যস্ত হবে। এই ক্রমাগত বিপদের ফলে বাড়বে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরিবেশগত কারণে বাস্তুহারার সংখ্যা। পোশাকি ভাষায় যাঁদের বলা হয় ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ বা ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’। আর্থিক অনটনের জেরে বাল্যবিবাহ কিংবা নারী-পাচারের শিকার হবে কিশোরী, তরুণীরা। পেশার তাগিদে স্কুলের পাট চুকিয়ে ঘর ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিকের পথ নেবে কিশোরেরা।

Advertisement

শুধু ঝড় নয়, জলবায়ু বদলের জেরে তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের চরিত্রেও বদল ধরা পড়েছে। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের রিপোর্টেই তা আছে। রিপোর্ট বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের মোট বৃষ্টিপাতের ৭৬.৮ শতাংশ নির্ভর করে বর্ষাকালে প্রাপ্ত বৃষ্টির উপরে। গত কয়েক বছরে বর্ষার শুরুতে বৃষ্টি সে ভাবে মিলছে না। শেষের দিকে কয়েকটি নিম্নচাপের জেরে অতিবৃষ্টি হয়ে পরিসংখ্যানের বিচারে স্বাভাবিকের ধারে-কাছে পৌঁছে দিলেও বৃষ্টির জলে সেচের কাজ মিটছে না। ভূগর্ভের জলের ভান্ডারও পুষ্ট হচ্ছে না। রাজ্যের বহু জেলাতেই নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্তও সে ভাবে শীত পড়ছে না। আবার জানুয়ারি-শেষের আগেই রীতিমতো গরম পড়ছে। বাতাসে বাড়ছে আর্দ্রতাও। বর্ষার চরিত্র বদলালে পানীয় জলের ভান্ডারে টান পড়ছে। তাপমাত্রা বাড়লে জলের বাষ্পীভবন বাড়ছে। বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার বদলে কৃষি, উদ্যানপালন, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বহু ক্ষেত্রে কৃষিজ পণ্য, আনাজ এবং ফলের উৎপাদন মার খাচ্ছে, সেচের জলের অভাব মেটাতে নির্বিচারে ভূগর্ভের জলে হাত পড়ছে। তাতে বহু এলাকায় আর্সেনিক কিংবা ফ্লুয়োরাইডের প্রকোপও বাড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে বিপদ ঠেকানোর পরিকল্পনা কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সরকারি দফতরগুলির বাজেটে টুকরো টুকরো নানা বিষয় চোখে পড়েছে। যেমন পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি বিভাগ সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারে জোর দিচ্ছে। জলসম্পদ অনুসন্ধান বিভাগ খরাপ্রবণ এলাকায় সেচের জল সংরক্ষণে ‘জলতীর্থ’ প্রকল্প করেছে। সেচ দফতর খাল কাটছে। দূষণ কমাতে পরিবহণ দফতর বিদ্যুৎচালিত বাস পথে নামাচ্ছে। জলের দূষণ ঠেকাতে পুর দফতর নিকাশি শোধন কেন্দ্র করছে। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর বন্যাত্রাণ বিলি এবং ঝড় কবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করছে। এমন উদাহরণ আরও আছে। কিন্তু তাতে কত শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা আছে এবং কতটুকু প্রকল্পের চমক? কেন কোনও নির্দিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে এবং সমন্বয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা হবে না?

প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে রাজ্য সরকার যে পথে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপদ ঠেকানোর পথে হাঁটছে, তার সঙ্গে চিকিৎসাব্যবস্থার মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। যেমন, শরীরে ব্যথা হলে ‘পেনকিলার’ জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। তাতে সাময়িক ব্যথার উপশম হয়, কিন্তু ব্যথা নিরাময় হয় না। ব্যথা নিরাময়ের জন্য রোগ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করে তার চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। ব্যাধি জটিল হলে তার চিকিৎসা পদ্ধতিও সুদূরপ্রসারী এবং সুচিন্তিত হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে পথে পরিবেশগত বিপদ ঠেকাতে হাঁটছে তা অনেকটা ‘পেনকিলার’-এর মতো। সাময়িক উপশম হয়তো হবে, কিন্তু দুর্যোগ বার বার হবেই। সেই দুর্যোগে ব্যথা যাতে কম হয় তার দিশা কোথায়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement