যা হয়েছে তা ভাল হয়নি, যা হবে তা-ও কি ভাল?
Justice Rajasekhar Mantha

এক অবাঞ্ছিত সংঘাত

ক জন বিচারপতির বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে তাঁর বিরুদ্ধে পাড়ায় পোস্টার সেঁটে দেওয়ার যে বেনজির ‘সংস্কৃতি’ এখন তৈরি হল, তার জের সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:০৪
Share:

অশিষ্ট: যোধপুর পার্ক এলাকায় বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বিরুদ্ধে পোস্টার। ৯ জানুয়ারি, ২০২৩। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

বিচারপতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মাত্রা যে ভাবে যে স্তরে পৌঁছেছে, প্রথমেই বলি যে, তাকে নিন্দার ভাষা নেই। কালো কোট পরা এক দল আইনজীবী যে ভাবে তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন জুগিয়েছেন, তা-ও একই রকম নিন্দার। পশ্চিমবঙ্গ নামক এই ভুবনটির ভার যাঁদের হাতে, নিন্দাবাদ তাঁদেরও প্রাপ্য।

Advertisement

যাঁরা সংবিধান, গণতান্ত্রিক কাঠামো ইত্যাদি ভুলতে বসেছেন বলে বোধ হচ্ছে, তাঁদের জ্ঞাতার্থে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। যাঁরা বিচারের ভারপ্রাপ্ত, তাঁরা যেমন তাকে রক্ষা করতে দায়বদ্ধ, তেমনই আমাদেরও দায়িত্ব হল দিনের শেষে তাঁদের সাংবিধানিক মর্যাদাকে মান্যতা দেওয়া। এতে কোনও ঘাটতি দেখা দিলে স্তম্ভটি ধাক্কা খেতে বাধ্য। সেই ইঙ্গিত শুভ নয়।

বিচার নিয়ে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কোনও রায়ের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ করার আইনসম্মত সংস্থান আছে। বিচারের ‘নিরপেক্ষ’ তুলাদণ্ড হাতে অধিষ্ঠিত অনেক মান্যবর তাঁদের রায়, নির্দেশ বা মন্তব্যের কারণে নানা সময় জনসমাজে সমালোচিতও হন। কিন্তু এক জন বিচারপতির বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে তাঁর বিরুদ্ধে পাড়ায় পোস্টার সেঁটে দেওয়ার যে বেনজির ‘সংস্কৃতি’ এখন তৈরি হল, তার জের সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

Advertisement

তবে অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে এই ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন খুব জরুরি। বিচারপতির বিরুদ্ধে রাস্তায় পোস্টার পড়েছে দু’জায়গায়— প্রথমে তাঁর পাড়ায়, এবং এক দিন পরে হাই কোর্টের অদূরে চার্চ লেনে। ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করা দূরের কথা, পুলিশ এক জনকেও ‘চিহ্নিত’ করতে পারল না। কেন? পুলিশ কি সত্যিই এত অপদার্থ? এতই অদক্ষ?

কেন পারেনি, সেই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা আরও বহু প্রশ্ন উস্কে দিতে পারে। তার একটি হল, শাসক দলের কোনও জাঁদরেল নেতা-মন্ত্রীর বেলায় এমন হলে পুলিশ কী করত? তাদের ঘাড়ে মাথা থাকত কি!

কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতির বিভিন্ন নির্দেশের বিরুদ্ধে শাসক তৃণমূল অনেক দিন ধরে সরব। তাঁর বহু নির্দেশ যে বিরোধী দল বিজেপির পক্ষে ‘স্বস্তিজনক’ হয়েছে, এটাও ঘটনা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে আদালতের সম্মতি ছাড়া পুলিশের কাছে এফআইআর করা যাবে না, এই ধরনের ‘চমক’ জাগানো নির্দেশ তাঁর আদালত থেকেই এসেছে। আবার এই আদালতেরই বিভিন্ন নির্দেশে ‘চাপ’ বেড়েছে শাসক শিবিরে।

মাননীয় বিচারপতিদের প্রজ্ঞার উপর আস্থা রাখা শিষ্টতা। তথাপি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় নিয়ে সংশয় বিচিত্র নয়। যেমন, আইনের চোখে তো সবাই সমান। কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে এফআইআর করার বেলায় এমন ‘রক্ষাকবচ’ কেন?

বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার পাড়ায় সাঁটিয়ে দেওয়া পোস্টারে শুভেন্দুকে ‘ছাড়’ দেওয়া ছাড়া আর একটি অভিযোগ হল, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীরের ‘রক্ষাকবচ’ (কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত সংক্রান্ত) তুলে নেওয়া। বলা বাহুল্য, এই দু’টিই ঘোরতর রাজনৈতিক এবং দুই ক্ষেত্রেই বিজেপির উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে। রাজনীতির ময়দানও তাই পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গরম হয়েছে। কিন্তু তার পরিসর আদালতকক্ষ বা বিচারকের বাড়ি নয়।

বিচারপতি ‘বেআইনি সম্পত্তিতে’ বাস করছেন, এমন অভিযোগ ব্যক্তিগত কুৎসার পর্যায়ে পড়ে। কোনও সম্পত্তি বেআইনি কি না, তার নিষ্পত্তির জায়গা আদালত। যদি আদালতে কোনও সম্পত্তি বেআইনি সাব্যস্ত হয়, তা হলে সে কথা বলতে বাধা নেই। অন্যথায় এ কাজ অবমাননাকর এবং দণ্ডযোগ্য বলে গণ্য। পোস্টার-বাহিনী বা তাদের প্রশ্রয়দাতারা এ সব জানেন তো!

বিভিন্ন আদালতে মাঝেমধ্যেই বিচারপতিদের নিয়ে আইনজীবীদের ক্ষোভের ঘটনা ঘটে। এজলাস বয়কটের নজিরও কম নেই। আবার দ্রুত আপস-বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান হতেও দেখা যায়। কিন্তু এ বার বিচারপতি মান্থার বিরুদ্ধে আইনজীবীদের বিক্ষোভ নজির গড়ল। তাঁর এজলাসের দরজায় উকিলদের অবরোধ ঠেকাতে স্বয়ং বিচারপতিই তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছেন! এমনটি বোধ হয় আগে কখনও হয়নি।

তৃণমূল দাবি করেছে, এ সবের পিছনে তাদের কোনও ভূমিকা নেই। যদিও আদালতের আন্দোলন ও বাইরে পোস্টার-প্রতিবাদের ‘চরিত্র’ বলে দেয় যে, বক্তব্যগুলি কার্যত শাসক দলেরই ক্ষোভের প্রতিফলন। আরও লক্ষ করার, তৃণমূল এখনও পর্যন্ত সরাসরি ঘটনার নিন্দা করেনি। বলেনি যে, দলের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা করা হবে।

ঘটনা-বিন্যাস থেকে অনুমান করা যেতে পারে, যা হয়েছে, সেগুলি ‘সংগঠিত’ পরিকল্পনা। হঠাৎ কিছু নয়। কিন্তু পিছনে যারাই থাক, যাদের বুদ্ধিতে এ সব করা হয়ে থাকুক, তারা তৃণমূলের ‘হিতাকাঙ্ক্ষী’ নয়। কারণ, এর ফলে দলের ভাবমূর্তিতে আঘাত ছাড়াও বিচার-প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত অংশের সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্র প্রসারিত হল। কোথাকার জল কত দূর গড়াবে, কে বলতে পারে!

অনেকে দু’দশক আগে বিচারপতি অমিতাভ লালার সঙ্গে সে দিনের শাসক সিপিএমের সংঘাতের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন। ২০০৩ সালে কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি লালার গাড়ি মিছিলে আটকে পড়ার পরেই তিনি শহরে কাজের দিনে মিটিং-মিছিলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। অনেকের মতে, ওই নির্দেশের নেপথ্যে ‘বৃহত্তর জনস্বার্থ’-এর দিকটি উপেক্ষার নয়। তবে রায়ের বিরুদ্ধে সিপিএম রাস্তায় নেমেছিল। আদালত ‘প্রতিবাদের মৌলিক অধিকার’ কেড়ে নিচ্ছে বলে বক্তৃতা করেছিলেন জ্যোতি বসু। অন্য দলগুলিরও প্রায় কেউই ওই রায়ের পক্ষে ছিল না। কারণ, মিটিং-মিছিল সকলের চাই! সমস্যা তৈরি হল বিমান বসুর ‘লালা বাংলা ছেড়ে পালা’ হুমকির পরে। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত এবং বিচারপতিকে অবমাননার মামলা চলে বছর দুয়েক। আদালত তাঁকে জরিমানা-সহ তিন দিনের কারাদণ্ড দেয়। মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত জেলে যেতে না-হলেও ক্ষমা চাইতে হয়েছিল বিমানবাবুকে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিচারপতি লালার নির্দেশের বিপক্ষে থেকেও সিপিএম সে দিন তাদের শীর্ষনেতা বিমান বসুর পাশে দাঁড়ায়নি। বরং প্রকাশ্যে বলেছিল, ওই মন্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে এখানেই বড় তফাত।

তবে বিচারকের আসনে বসলেই কোনও ব্যক্তি নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যান, এটা ধরে নেওয়াও হয়তো অতিসরলীকরণ হবে। বিচারকরাও সমাজেরই অংশ। সমাজের স্খলন-পতন-ত্রুটি সবেরই ভাগীদার আমরা সবাই। ১৯৯৫ সালে বম্বে হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি আনন্দময় ভট্টাচার্যকে আইনজীবীদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছিল একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে ‘সন্দেহজনক’ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে। কিছু দিন আগেই আবার দেখা গেল, দেশের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ামাত্র শাসক বিজেপির ‘আনুকূল্য’-এ রাজ্যসভার সদস্য হয়ে গেলেন রঞ্জন গগৈ। করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে মাদ্রাজ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করা উচিত! তাঁর বদলি হল মেঘালয়ে। সেখানে তাঁকে নিয়ে বিচারপতি মাত্র চার জন।

এগুলি উদাহরণ মাত্র। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। বিচারপতি নিয়োগে কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকাও আজ অত্যন্ত অর্থবহ। ‘পছন্দ’-র জায়গা খোলা! তবু যাঁরা বিচারের আসনে, তাঁদের বিরুদ্ধে বল্গাহীন হলে সমগ্র ব্যবস্থায় অবাঞ্ছিত বিপদ ঘনিয়ে আসার আশঙ্কা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement