School Dropouts

লেখাপড়ায় এত অনীহা কেন

লেখাপড়ায় অনীহা বা ছেড়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট কারণ দর্শাতে না পারাটা পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় খামতিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement

সব্যসাচী রায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৩ ০৬:২১
Share:

স্কুলছুট ছেলেদের মধ্যে ৩২.১% ও মেয়েদের মধ্যে ২১.৪% লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনও কারণ বলতে পারেনি। —ফাইল চিত্র।

কেন্দ্রীয় সরকারের স্কুলশিক্ষা ও সাক্ষরতা বিভাগের ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন বা ইউডিআইএসই-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের সংখ্যা গড়ে ১৪.৬% (ছেলেদের মধ্যে ১৪.৯%, এবং মেয়েদের মধ্যে ১৪.২%)। নিম্ন ও উচ্চ-প্রাথমিক স্তরে অবশ্য পরিসংখ্যানটি স্বস্তিদায়ক, যথাক্রমে ০.৭৫% এবং ১.৩%। মাধ্যমিক স্তরে এত স্কুলছুট কেন, সেই কারণ খুঁজলে প্রথমেই কয়েকটি কথা মনে আসবে— পারিবারিক আর্থিক দুর্দশা, বা বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব। কিন্তু, তথ্য বলছে যে, এই কারণগুলো গৌণ— মুখ্য কারণ হচ্ছে লেখাপড়ায় অনীহা। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা এনএফএইচএস-৫’এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, ৬ থেকে ১৭ বছরের স্কুলছুট ছেলেদের মধ্যে ৩৫.৭% এবং স্কুলছুট মেয়েদের মধ্যে ২৭.৯% লেখাপড়া ছাড়ছে আগ্রহের অভাবে। স্কুলছুট ছেলেদের মধ্যে ৩২.১% ও মেয়েদের মধ্যে ২১.৪% লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট কোনও কারণ বলতে পারেনি। অর্থনৈতিক অসঙ্গতিকে লেখাপড়ায় ইতি টানার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে মাত্র ১৬.১% ছেলে ও ২০.৬% মেয়ে।

Advertisement

লেখাপড়ায় অনীহা বা ছেড়ে দেওয়ার নির্দিষ্ট কারণ দর্শাতে না পারাটা পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় খামতিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। ১৪০ কোটির দেশে অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ধরে রাখতে হলে যে উদ্ভাবনী শিক্ষা পরিকাঠামো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের প্রয়োজন, তা কি জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে? মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, বিনামূল্যে স্কুল ইউনিফর্ম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, এত কিছুর পরও লেখাপড়ায় আগ্রহ যে সার্বিক ভাবে জন্মাচ্ছে না, সেটা স্কুলছুটের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট। তাই, ‘লেখাপড়ায় অনীহা’ ব্যাপারটির চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে এই নয়া শিক্ষানীতির উচ্চাশী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নামলে দিনের শেষে এ বারও না মুখ থুবড়ে পড়তে হয়! ‘কেন লেখাপড়া করব’, এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর যেন ছাত্রছাত্রীরা খুঁজে পায়, প্রথমে সেটা দেখা জরুরি।

শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের ঝোঁক আজ অনস্বীকার্য। দেশে প্রায় ২৫ কোটি স্কুল-পড়ুয়ার মধ্যে ৪৮% (প্রায় ১২ কোটি) বেসরকারি স্কুলকে বেছে নিয়েছে। ক্রমশ কমছে সরকারি স্কুলে ভর্তি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। ১৯৭৮ সালে যা ছিল ৭৪%, ২০১৭ সালে সেটা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২.২ শতাংশে। উল্টো দিকে, কোনও সরকারি সুবিধা না পাওয়া (আন-এডেড) বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ১৯৭৮ সালে ছিল মাত্র ৩.৪%, ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৪.৮%। তাই, নতুন শিক্ষানীতিকে ফলপ্রদ করতে হলে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে তোলার সকল পথকে প্রথমে বন্ধ করতে হবে।

Advertisement

এ দিকে, চাহিদা কমতে থাকা সরকারি স্কুলগুলোর মলিন চিত্রটিকেও সজীব করতে হবে। আজকের দিনে, দেশে প্রায় ১০.২২ লক্ষ সরকারি স্কুলের মধ্যে চার লক্ষ স্কুলে ছাত্রসংখ্যা পঞ্চাশের কম এবং ১.১ লক্ষ স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কুড়ি জনেরও কম! সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার উদ্যোগ থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন, সর্বশিক্ষা থেকে শুরু করে সমগ্রশিক্ষা— এত কিছুর পরেও শিক্ষার ডাক কেন শিশু-কিশোর-অভিভাবকদের সামগ্রিক ভাবে নাড়া দিতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর আগে বার করতে হবে।

দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও হতাশাজনক। কোঠারি কমিশনের সুপারিশ থেকে শুরু করে ১৯৬৮ এবং ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতি— সবেতেই দেশের জিডিপি-র ৬% শিক্ষাখাতে ব্যয় করার সুপারিশ ছিল। কিন্তু, বিগত পাঁচটি দশকে এই হার ৩ শতাংশের আশপাশেই ঘোরাফেরা করেছে। নতুন শিক্ষানীতিতেও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপি-র ৬% পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এই ৬ শতাংশও আসলে রক্ষণশীল লক্ষ্য। কারণ, আজকের দিনে দেশের সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, স্কুলগুলোতে মূলধনি খাতে বিনিয়োগ, স্কুলে তথ্যপ্রযুক্তির পরিকাঠামো গঠন ইত্যাদি বিচারে এই বরাদ্দ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু, এই হারকে ৩% থেকে দ্বিগুণ করতে যতটুকু সাহসী পরিকল্পনার প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে কি?

নতুন শিক্ষানীতিতে উদ্ভাবনী পঠনপাঠনের উল্লেখ রয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষাদানেও। এই লক্ষ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী ই-বিদ্যা’ নামের একটি সর্বভারতীয় অনলাইন পোর্টাল শুরু হয়েছে, যার ট্যাগলাইন হচ্ছে ‘এক দেশ, এক পোর্টাল’। কিন্তু এখনও দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী নাগরিকের সংখ্যা মাত্র ৩৪ কোটি, যার সিংহভাগই শহরবাসী। ফলে, শিক্ষাব্যবস্থায় সকলকে অন্তর্ভুক্ত করাই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি শিক্ষার আকর্ষণ ও ব্যবস্থায় বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এর জন্য এক উদার আবহে শিক্ষাকে নিঃশ্বাস নিতে দিতে হবে। পরিচালন সমিতি, পড়ুয়া, শিক্ষক, অভিভাবক মিলিয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক নিজস্ব পরিমণ্ডল গড়ে উঠতে দিতে হবে। সেই পরিমণ্ডলকে বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ভাববিনিময়ের পরিসর দিতে হবে। তা করতে না পারলে কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি নামক উচ্চাশী পরিকল্পনার হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement