কলকাতার বায়ুদূষণ।
এক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ (‘বিপর্যয়ের প্রহর গোনা’, জয়ন্ত বসু, ২৬-৮) পড়ে প্রথমে যারপরনাই উদ্বিগ্ন হলাম। প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন-এর অধীন মিলকেন ইনস্টিটিউট স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর এক রিপোর্টের ভিত্তিতে। এই রিপোর্টকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করে লেখক জানিয়েছেন, গোটা দুনিয়ায় বায়ুদূষণে কলকাতা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে; দিল্লির ঠিক পরেই। ২০১৯ সালে এই শহরের বাতাসে অতি ক্ষুদ্র দূষক বা পিএম ২.৫-এর গড় পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৪ মাইক্রোগ্রাম, দিল্লিতে ১১০ মাইক্রোগ্রাম। কলকাতার পিএম ২.৫ দূষণের মাত্রাটি কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত মাত্রার দ্বিগুণেরও বেশি, আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার ১৭গুণ। কলকাতায় ওই দূষকের প্রভাবে গত এক দশকে ১.৮৫ লক্ষ মানুষ অকালে মারা গিয়েছেন।
রিপোর্টটি পড়ে দেখলাম, সেখানে কোথাও বলা হয়নি যে, ২০১৯ সালে কলকাতার বাতাসে ভাসমান পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৪ মাইক্রোগ্রাম। গবেষকরা লিখেছেন, ওই বছর কলকাতায় ‘পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যানুয়াল অ্যাভারেজ পিএম ২.৫ এক্সপোজ়ার’ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৪ মাইক্রোগ্রাম। উল্লেখ্য যে, বাতাসে ভাসমান দূষণের পরিমাণ তিনটি পদ্ধতিতে হিসাব ও প্রকাশ করা যায়। এক, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে কত মাইক্রোগ্রাম দূষক ভাসছে, তা দেখা; দুই, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স হিসাব করা; এবং তিন, পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যানুয়াল অ্যাভারেজ পিএম ২.৫ এক্সপোজ়ার প্রকাশ করা। এই তিন ধরনের হিসাবের পদ্ধতি আলাদা, আর সেখানেই লেখক ভুল বুঝেছেন।
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কলকাতার দশটি স্থানে বাতাসে ভাসমান পিএম ২.৫ ও অন্যান্য দূষকের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে, এবং সে তথ্য ওয়েবসাইট ও ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে নাগরিকদের জানায়। সেই বিশাল তথ্যভান্ডার পর্যবেক্ষণ ও ক্যালিব্রেশনের দায়িত্বে আছেন আইআইটি দিল্লির অধ্যাপক ও গবেষকরা। ২০১৯ সালে ১০টি মনিটরিং স্টেশনে রেকর্ড করা পিএম ২.৫-এর গড় ও জনসংখ্যা নিয়ে গণনা করলে দেখা যাচ্ছে যে, ওই বছর এই শহরে ‘পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যানুয়াল অ্যাভারেজ পিএম ২.৫ এক্সপোজ়ার’ ছিল প্রতি ঘনমিটারের ৫৬.৮৩ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ভাসমান পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ছিল ৫৭.৭০ মাইক্রোগ্রাম; আইআইটির মডেল-ভিত্তিক গবেষণা বলছে, ওই বছর কলকাতায় ‘পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যানুয়াল অ্যাভারেজ পিএম ২.৫ এক্সপোজ়ার’ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫২ মাইক্রোগ্রাম, আর উপগ্রহনির্ভর তথ্য বিশ্লেষণ করলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পিএম ২.৫-এর ‘পপুলেশন-ওয়েটেড অ্যানুয়াল এক্সপোজ়ার’-এর নির্ধারিত প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা হল ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। নানা কর্মসূচি রূপায়ণের পর ২০২১ সালে কলকাতায় পিএম ২.৫-এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮.৭৩ মাইক্রোগ্রাম।
পিএম ২.৫ বা আরও ক্ষুদ্র ভাসমান দূষক নানান দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে। প্রবীণ নাগরিক বা যাঁদের কোমর্বিডিটি আছে, তাঁরাই বায়ুদূষণে বেশি বিপন্ন হন। উল্লিখিত রিপোর্টটি জানিয়েছে যে, কলকাতায় প্রতি এক লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে ৯৯ জন বায়ুদূষণের জন্য মারা যান। নীতি আয়োগের তথ্যভান্ডার থেকে জানা যায় যে, কলকাতায় গত দশ বছরে নানা কারণে মোট ২.৫২ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। ওই রিপোর্টে উল্লিখিত মৃত্যুহার সত্য হলে আমাদের এই শহরে বায়ুদূষণের জন্য গত দশ বছরে ৪২ হাজার মানুষ মারা গেছেন। সেই সংখ্যাটি ১.৮৫ লক্ষের এক-চতুর্থাংশেরও কম। এই মৃত্যু কতটা দূষণের জন্য, আর কতটা কোমর্বিডিটি-জনিত, তা নিয়ে এখনও কোনও গবেষণা হয়নি।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত কলকাতায় লকডাউনের সময় যানবাহন, শিল্প, নির্মাণ ইত্যাদি সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। তখন আমরা জানার সুযোগ পেয়েছিলাম যে, সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হলে বায়ুর গুণগত মান কতটা উন্নত হয়। দেখা গিয়েছিল, লকডাউনের সময় পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় কলকাতার বাতাসে পিএম ২.৫-এর পরিমাণ ৪৭% কমেছিল। আইআইটি দিল্লির গবেষকরা জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার প্রায় ৫৩% শতাংশ বাতাসের টানে ভেসে আসে প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও বাংলাদেশ থেকে। এই বিষয় নিয়ে আরও গবেষণার জন্য রাজ্যের সীমান্ত বরাবর অত্যাধুনিক সেন্সর বসানো হয়েছে।
দু’বছর ধরে গবেষণার পর ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়রিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি) ২০১৯ সালে একটি রিপোর্টে জানিয়েছিল, কলকাতার বাতাসে বছরে ৪০৫৪ মেট্রিক টন সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পিএম ২.৫ ভাসমান থাকে। এই দূষকের তিনটি মূল উৎস হল গৃহস্থালি (২৮%); রাস্তার ধুলো (২৫%), যা হাওয়ার টানে ভাসতে থাকে; ও গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া (২৪%)। শিল্পের অবদান মাত্র ৭%, খোলা স্থানে কয়লা বা কাঠ পোড়ানোর জন্য দূষণ বাড়ে আরও ৭%। তখনও জানা যায়নি কলকাতার বাইরের থেকে বহমান বাতাস কতটা দূষণ টেনে আনে। কলকাতার দূষণ সমস্যাকে আরও গভীর ভাবে জানতে ও বুঝতে এ বার এক নতুন গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দিল্লির ‘দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট’-কে।
দূষণকে রাজনৈতিক সীমায় বাঁধা যায় না বলে গঙ্গা অববাহিকা জুড়ে এয়ার-শেড ম্যানেজমেন্ট-এর কথা ভাবা হচ্ছে। কলকাতা-সহ রাজ্যের ছয়টি শহরের জন্য ‘এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ তৈরি হয়েছে। আটটি সরকারি দফতরকে কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো বন্ধ করতে উপগ্রহ নির্ভর নজরদারি শুরু হয়েছে, শীতকালে রাস্তায় জল ছিটিয়ে ধুলো কমানোর চেষ্টা হচ্ছে। রাস্তার ধারের হোটেলগুলিকে কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পরিবহণ দফতর ‘ইলেকট্রিক বাস’ চালাতে শুরু করেছে। পাইপ লাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস ইতিমধ্যেই পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড় পর্যন্ত এসেছে; আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছবে বলে আশা।
কলকাতার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই দূষণের জন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। তাই জনমনে চেতনা জাগাতে হবে। প্রতি নাগরিকের অংশগ্রহণ ছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ এক অলীক স্বপ্ন।
পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ