ফুটবল-প্রেমিক বাঙালির ঘরে ঘরে একদা রাজত্ব করত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। এখন দিন পাল্টেছে, তবে ফুটবল নিয়ে আবেগের লড়াই পুরোপুরি মুছে গিয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। ফুটবল বিশ্বকাপ এলে এখনও আবেগের লাভাস্রোত বয়ে যায়। এখন যেমন বাঙালি রাত জেগে ইউরো আর কোপা আমেরিকা-র মতো টুর্নামেন্ট দেখছে। সেই সঙ্গে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্নও কি ক্রমাগত খোঁচা দিচ্ছে না? বাঙালিকে কি সারা জীবন ফুটবলে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি বা ফ্রান্সের মতো দেশকে সমর্থন করেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে? ফুটবলের বড় মঞ্চে ভারত কখনও খেলার সুযোগ পাবে না?
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কথা ভাবতে গেলে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের ছবিটা চোখের সামনে ভাসে। প্রথম এশিয়ান গেমসে (১৯৫১) ভারতীয় ফুটবল দল সোনা জিতেছিল। ১৯৬২-র এশিয়ান গেমসেও ভারত ফের চ্যাম্পিয়ন হয়। গর্ব করার বিষয়, সেই চ্যাম্পিয়ন দল দুটোকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই বাঙালি— ১৯৫১-তে শৈলেন মান্না, ১৯৬২-তে চুনী গোস্বামী। ১৯৬৪’র এশিয়া কাপ ফুটবলে ভারত রানার্স হয়েছিল, ১৯৭০-এর এশিয়ান গেমসে পেয়েছিল ব্রোঞ্জ পদক। তার পর সময় যতই এগিয়েছে, ফুটবলে ভারত ততই পিছিয়ে পড়েছে। বিশ্বের বহু ছোট দেশ নানান সমস্যার মধ্যেও নতুন করে ফুটবল-পরিকাঠামো নির্মাণ করে দেশের ফুটবলকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আমরা পারিনি।
খেলাধুলোর জগতে উন্নতি করতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আন্তরিক ও নিরলস প্রয়াসী হতে হয়। শুধু প্রশাসনের শীর্ষ মহলকেই উদ্যোগী হলে চলবে না, তৃণমূল স্তরেও চাই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। দরকার সেই সব দক্ষ মানুষকে, যাঁরা খেলাটাকে ঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। ভারতের সমস্যা হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনীতিকরাই খেলাধুলো পরিচালনা করেন, সিদ্ধান্ত নেন— কারণ, বিভিন্ন ক্রীড়াসংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো তাঁদেরই দখলে। রাজনীতির ঘোলা জলে ভেজা তাঁদের সেই সব সিদ্ধান্তে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা মাথা নিচু করে পিছনের বেঞ্চে বসে থাকে। তাই আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভারত সম্প্রতি তেমন বড় সাফল্য পায়নি। প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের এই দেশ এখনও পর্যন্ত এক বারও বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলতে পারেনি, এ কি লজ্জার নয়? সেনেগাল, অ্যাঙ্গোলা বা টোগোর মতো ছোট, বহু সমস্যায় দীর্ণ দেশও বিশ্বকাপে খেলে, আমরা ভারতীয়রা শুধু দেখি। ফুটবল-ভক্তদের অনেকেই তো এখনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চেনা গণ্ডির বাইরেই বেরোতে পারলাম না!
তবে প্রশাসনকেও একতরফা দায়ী করে কোনও লাভ নেই। সমস্যা ভারতীয়দের মানসিকতাতেও। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা কেবল পড়াশোনা করেই কেরিয়ার গড়ুক। খেলাধুলোর প্রতি আমাদের যে একটা বিমাতৃসুলভ আচরণ রয়েছে, তা অস্বীকার করলে আসল সত্যিটাকেই অনৈতিক ‘লাল কার্ড’ দেখিয়ে দেওয়া হয়! এ দেশে এক জন ফুটবলারকে সাফল্য পেতে গেলে বিপুল পরিশ্রম ও আত্মত্যাগ করতে হয়, নিতে হয় বিরাট ঝুঁকিও। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভারতীয় ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক সুনীল ছেত্রী। আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন তিনি। চটজলদি সাফল্যের হাতছানি এড়িয়ে ছুঁতে চেয়েছেন ‘এক্সেলেন্স’কে, সফলও হয়েছেন। ওঁর মতো মানসিকতা অন্য খেলোয়াড় ও সংশ্লিষ্ট ক্রীড়া প্রশাসকদের থাকলে ভারতীয় ফুটবলের চেহারাটা আজ অন্য রকম হতেও পারত।
শুধু সমস্যার গর্তগুলো দেখিয়ে লাভ নেই, দরকার ঠিক পথে হাঁটা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এগোতে হলে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকাঠামো, প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। দরকারে পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। কাজ-চালানো অপেশাদারি ভাবনাকে ছুড়ে ফেলে আনতে হবে পেশাদারি মানসিকতা। এই সমস্ত শুধু ভাবলেই হবে না, তার সার্থক প্রয়োগও ঘটাতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সব কাজই সরকার বা প্রশাসন করবে, এই দায়-এড়ানো ফাঁকিবাজি একেবারেই অর্থহীন। ‘পাবলিক’, ‘প্রাইভেট’ আর ‘পিপল’— সকলেরই সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
সরকারকে দেখতে হবে যাতে ক্রীড়া-প্রশাসনে দক্ষ মানুষরা জায়গা পান। অতীত দিনের ফুটবলাররা যাঁরা ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছেন, তাঁদের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজন মতো পেশাদারি ‘ম্যানেজার’দের নিয়োগ করলে সুফল মেলার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এর পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে স্পনসরদের। এখানে একটা সুবিধে, ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলায় বিনিয়োগ করলে লাভ মন্দ হয় না। সাধারণ মানুষকেও দেখতে হবে, বাড়ির প্রতিভাধর ফুটবলাররা যেন খেলার জগতে থাকতে পারে। সহজ কেরিয়ারের লোভে তাদের পা থেকে ফুটবল কেড়ে নিলে প্রতিভা নষ্ট হয়। তাতে নিশ্চিত ভাবেই দেশের ক্ষতি।
২০১৪ সাল থেকে পেশাদারিত্বের জমিতে ভর করে দৌড়চ্ছে আইএসএল। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল— সকলেই সেই দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছে। এগুলো অবশ্যই ভাল খবর। তবে এখানে না থেমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই হয়তো ভবিষ্যতের বিশ্বকাপে এক দিন সুনীল ছেত্রী-সন্দেশ ঝিঙ্গন-আদিল খান বা ওঁদের উত্তরসূরিদের নিয়ে গলা ফাটাতে পারব।