ছবি: সুব্রত চৌধুরী
কাকে বলে ব্যক্তিত্ববান? যাঁর পছন্দ ও অপছন্দের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত আছে। তিনি রাগী হতেও পারেন, না-ও হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে সকলেই সমঝে চলে। কথাটা বলছি আমার দাদু রাজকুমার সম্পর্কে। এক জন সফল মোক্তার, এক জন মিতবাক মানুষ, শিষ্ট আচরণশীল, কিন্তু সবাই সসম্ভ্রমে তাঁকে অগ্রাধিকার দেয়। কথাটা বলছি এই কারণে যে, আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে দুর্গাপুজো হোক, এটা বোধ হয় আমার দাদুর মনঃপূত ছিল না। কিন্তু তিনি ঈষৎ অনিচ্ছার সঙ্গে মত দিয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর স্ত্রী, অর্থাৎ আমার ঠাকুরমার ইচ্ছা বড় একটা অপূর্ণ রাখতেন না। পুরুষতন্ত্রের অনেক নিন্দেমন্দ শোনা যায়, কিন্তু পুরুষতন্ত্রের মানে শুধু যে মহিলাদের দাবিয়ে রাখাই নয়, তা আমি ঠাকুরমা আর দাদুকে দেখেই আজ বুঝি। ওই রকম এক জন বাঘা পুরুষও কদাপি সংসারের উপরে ঠাকুরমার অখণ্ড কর্তৃত্বের বিরোধিতা করেননি। যা রোজগার করতেন, তার সবটাই ঠাকুরমার হেফাজতে জমা করে দিতেন। ঠাকুরমার হুকুমেই সংসার চলত।
কথাটা বলছি তার কারণ, এক দুর্গাপঞ্চমীর দিনে আমাদের এক জ্ঞাতির ছেলে একটা ছোট দুর্গামূর্তি কোথা থেকে নিয়ে এসে হাজির করেছিল। সেই জ্ঞাতি আমাদের বাড়িতেই উঠোনের এক পাশে ছোট একটি ঘরে থাকতেন। পুরোহিত মানুষ, কায়ক্লেশে দিনযাপন। দুর্গামূর্তি দেখে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কারণ, পুজো করার সামর্থ্য তাঁর নেই। আবার না করলেও অমঙ্গলের আশঙ্কা। ছেলের উপরে রাগারাগি করছিলেন। মুশকিল-আসান হয়ে দেখা দিলেন আমার ঠাকুরমা। ঘোষণা করলেন, “পূজাকাটাইল্যা দিনে যখন দুর্গামূর্তি আইয়া পড়ছেই, তখন পূজাও কইরতেই হইবো। পূজা আমরাই করুম।” শুনেছি, দাদুর প্রস্তাবটা পছন্দ হয়নি। তবে ঠাকুরমার উপরে তিনি নিজের মতামতও চাপিয়ে দেননি। মৃদু অমত জানিয়েও শেষে চুপচাপ মেনে নেন। সেই আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর শুরু। রাতারাতি প্যান্ডেল খাড়া হয়ে গেল, বাড়ির ও প্রতিবেশী মহিলারা লেগে গেলেন ডেকোরেশন এবং নানা জোগানদারিতে। আমাদের কী সাংঘাতিক আনন্দ!
সেই বাড়ির পুজো অবশ্য বেশি দিন চলেনি। কালান্তক দেশভাগ এসে আমাদের পরিবারটিকে বিচ্ছিন্ন এবং তছনছ করে দিয়েছিল। কিন্তু যে ক’বছর পুজো হয়েছিল, তার অমলিন স্মৃতি আজও সঙ্গীহয়ে আছে।
তখন বারোয়ারি পুজোর এমন বাড়বাড়ন্ত হয়নি। বেশির ভাগই বাড়ির পুজো। সংখ্যায় কম। এখনকার তুলনায় নগণ্যই। আর পুজো নিয়ে এখনকার মতো এত মাতামাতিও ছিল না। তবে একটা ব্যাপার ছিল, পুজোর ছুটিতে প্রবাসীরা বাড়িতে আসত। আর সেটাই ছিল খুব আনন্দের বিষয়। বিক্রমপুর বানভাসি এলাকা। সেখানে চাষবাসের উপরে নির্ভর করা যেত না। সেই কারণে বিক্রমপুরের মানুষেরা লেখাপড়া শিখে বাইরে যেত চাকরিবাকরি করতে। তাই বিক্রমপুরে প্রবাসীর সংখ্যা একটু বেশি। আমার দাদুও তো বিক্রমপুর ছেড়ে ময়মনসিংহে এসেছিলেন রোজগার করতেই।
ময়মনসিংহে আমরা পুজো দেখতে যেতাম বেশির ভাগ জমিদারদের বাড়িতে। ময়মনসিংহ জমিদারদেরই জায়গা। শহরটায় বিস্তর জমিদারবাড়ি ছিল। বেশ বড় করেই পুজো হত সেখানে। তবে জাঁকজমক এখনকার মতো নয়। শোলা বা রাংতার কাজ আর রঙিন কাগজের শিকলি বা ডাকের সাজ। হ্যাজাক আর ডেলাইট ছিল সম্বল। স্ট্রিটলাইটের বালাই ছিল না, লোকে টর্চ বা লণ্ঠন নিয়ে চলাফেরা করত। আর থিম পুজোর আইডিয়াও তখন আসেনি। সব দুর্গামূর্তিই প্রায় এক রকম। আর তাতে বাড়ির মেয়ে-পুরুষ সকলেই শামিল হতেন। বারোয়ারিতে যেটা ভাবাও যায় না। ঘরোয়া পুজোয় একটা স্নিগ্ধতা আছে, পরিবারের সকলের ইনভলভমেন্ট আছে, উৎসব উপলক্ষে পুনর্মিলন আছে। পুজো কম হওয়ায় আমরা অনেক দূর হেঁটে তবে একটা পুজোর দেখা পেতাম।
আমার বালক বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বসত করতে হয়েছে তাঁর রেলের চাকরির সুবাদে। উত্তরবঙ্গ, অসম, বিহার— সব জায়গাতেই পুজো হত। কিন্তু কোথাও কখনও এখনকার মতো জাঁকজমক ছিল না। ছিল না এত আলোর রোশনাই। বা এত ডেকোরেশন। কিন্তু আনন্দ ছিল অনেক বেশি, উন্মাদনা কম। আর বিজয়ার কথা কী বলব, ওটাই ছিল আমাদের ছোটদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহের ব্যাপার। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাড়ু, তক্তি, মোয়া সাঁটানোর সে কী উদ্যম! আরও একটা জিনিস ছিল, জলসা এবং নাটক। বাইরে থেকে ভাড়াটে আর্টিস্ট এনে নয়, কুশীলব সাজতেন রেলের বাবুরাই, মহিলাও সাজতেন পুরুষরাই। সিরাজদ্দৌল্লা, কেদাররাজা, দুই পুরুষ যে কত বার দেখেছি।
পুজোর ধারণাটাই এখন পাল্টে গিয়েছে। স্নিগ্ধতার বদলে জাঁকজমক বেড়েছে বহু গুণ, উন্মাদনা তুঙ্গে, ভিড় অকল্পনীয়। তবু আমার কাছে এখনকার থিম পুজো খারাপ লাগে না। বরং সৃজনশীলতা, পেশাদারিত্বে উজ্জ্বল এই সব থিম পুজো সব দিক দিয়েই অনন্যসাধারণ। আর এ বার ইউনেস্কোর শিরোপা পাওয়ার পরে কলকাতা এবং বাংলার পুজো আরও নতুন মাত্রা পাবে।