মহিলাদের সুরক্ষার জন্য রয়েছে ‘গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধ আইন ২০০৫’। পণ, সাংসারিক নির্যাতনের কারণে কোনও মহিলার শারীরিক নিগ্রহ হলে সেই অপরাধ রিপোর্ট করা, গ্রেফতারি, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি প্রতিবিধানের কথা বলা হয়েছে তাতে। তবে, তেরোটি রাজ্য নিয়ে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে, এই আইন বুঝি প্রহসন! কারণ, সমীক্ষা জানাচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে মারধর করলে, তাতে আপত্তির কিছু নেই বলেই মনে করেন দেশের বিরাট অংশের পুরুষ, এবং নারী।
স্বামী কর্তৃক প্রহারকে ‘স্বাভাবিক’ ভাবা রাজ্যবাসী সর্বাধিক তেলঙ্গানায়। আশ্চর্য, নারীরাই এই নির্যাতনকে সমর্থন করছেন। এর পরই রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক। ‘শিক্ষিত’ রাজ্য কেরলের ৫২.৪% ও পশ্চিমবঙ্গের ৪২% নারীরও স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনে আপত্তি নেই। রান্না-গৃহকর্মে ত্রুটি, স্বামীর অবাধ্য হওয়া, শ্বশুরবাড়ির ‘অভিভাবক’কে অসম্মান ইত্যাদি নানা কারণে নাকি স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেই পারেন জীবনসঙ্গী!
দাম্পত্যে শারীরিক নির্যাতনের অনুমোদন ভয়াবহ প্রবণতা। স্বাধীন ভারত প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়েও স্ত্রীজাতির মর্যাদাকে গুরুত্ব দিতে শেখেনি। নারীকে শেখায়নি অধিকার; আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন করেনি। কৃষক, শ্রমিক, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন ও আত্মমর্যাদার অধিকার নিয়ে তবু চর্চা হচ্ছে। কিন্তু স্বামীর ঘরে স্ত্রীর অধিকার বুঝি সেই গুরুত্ব পায়নি। তাই আইনি কবচ অর্থহীন হয়ে যায়। মেয়েরা শিক্ষা, কর্মজীবনে পা রাখছেন (যথেষ্ট সংখ্যায় নয়), জন্মনিয়ন্ত্রণের সুফল, ভোটাধিকারও মিলেছে। তবু নিজেকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ মনে করা ‘অর্ধেক আকাশ’ যদি স্বামীর মার খেতে প্রস্তুত থাকেন নানা ছুতোয়, তা হলে এই স্বাধীনতা, এই গণতন্ত্র, এই সাংবিধানিক শাসনের কোনও অর্থই থাকে না।
গার্হস্থ হিংসায় আমাদের দেশ এমনিতেই সোনার মেডেল পেয়ে বসে আছে। পণ না দিতে পারা, শ্বশুরবাড়ির কথা মাথা নিচু করে মান্য করতে না পারা ইত্যাদি নানা ‘দোষ’-এরই দাম শরীরময় কালশিটে, রক্তক্ষরণ, সিলিং ফ্যান থেকে লাশ হয়ে ঝোলা, ধর্ষিত হওয়া ইত্যাদি। জীবনসঙ্গীকে ‘স্বামী’ হিসাবে চাপিয়ে দিয়ে সমাজ প্রথমেই প্রভুত্বের সামনে অবনত হতে বাধ্য করে। আইনের দরজায় কড়া নাড়ার মতো সাহস, সঙ্গতি ক’জন মহিলার আছে? ফলে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় নারী গার্হস্থ হিংসার শিকার হলেও, অপরাধ নথিবদ্ধই হয় না বহু ক্ষেত্রে। বিচার, শাস্তি তো দূর। বিশেষত বিহার, কর্নাটক, মণিপুর ইত্যাদি রাজ্যে যে ৪০% নারী শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হন, তাঁদের মাত্র ৮% লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অনেক অভিযোগই হয়তো খবরে আসে অভাগিনীর মৃত্যুর পর। ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’-র তথ্যে ২০১৯-এ হওয়া নারী নির্যাতনের ৪০%-ও অভিযোগের খাতায় ৪৯৮-এ ধারায় নথিবদ্ধ হয়নি। অথচ আইনটি হয়েছেই বিবাহিতাদের ‘স্বামী’, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে। লোকলজ্জা, সমাজ, দারিদ্র, কুসংস্কার ইত্যাদি নানা কারণে নির্যাতিতারা চুপ থাকতে বাধ্য হন— এ এক ট্র্যাজেডি। কিন্তু নিজেদের প্রতি অত্যাচারকে যদি তাঁরা নিজেরাই উচিতার্থে সমর্থন করেন, তার চাইতে বড় ট্র্যাজেডি এই ‘আলোকিত ভারত’-এ দাঁড়িয়ে আর কিছু হতে পারে না।
আশ্চর্যের কথা, কেরলে মেয়েদের সাক্ষরতা ৯৬.২%, অথচ সেখানে অর্ধেকের বেশি নারী ও সমসংখ্যক পুরুষ মনে করেন স্বামীর মারধর অন্যায় নয়! এই মনোভাব সবচেয়ে কম হিমাচলপ্রদেশের মেয়েদের (১৪.৮%)। অথচ সে রাজ্যে মেয়েদের সাক্ষরতার হার (৭৪%) কেরলের মেয়েদের চেয়ে অনেক কম। এই বাংলা, যে রাজ্যে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নিবেদিতা, বিবেকানন্দ, সারদা দেবী, বেগম রোকেয়ার মতো নক্ষত্র, সেখানেও অর্ধেকের কিছু কম নারীর পুরুষের হাতে মার খেতে আপত্তি নেই! তা হলে কি নারীর মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত শিক্ষার সংযোগের তত্ত্বটি ভুল? না কি, যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব, আত্মমর্যাদা, স্বাতন্ত্র্যের পাঠ দেয়, আমাদের পাঠ্যক্রমে তা কখনও যোগই হয়নি! না হলে যে ভারত বৈষম্যহীনতা, সাম্যের কথা বলে, সেই মাটিতে ‘স্বামী’ শব্দটি উচ্চারিত হয় কী ভাবে? প্রভুত্ব, পুরুষতন্ত্র, পুরুষ-নারীর বৈষম্য— এই ভাইরাসগুলি দেশের স্বাস্থ্যের পক্ষে কম ক্ষতিকর নয়।
সভ্য দেশে মানুষ মানুষকে মারবে? প্রহৃত মানুষ তা ‘স্বাভাবিক’ বলে জানবে? এ কেমন কথা? যদি স্ত্রী দোষ করেনও, স্বামী আইন হাতে নিয়ে তাঁকে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সাহস পান কী করে? দেশে আদালত নেই? যদি স্বামীর হাতে স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনে আপত্তি না থাকে, তবে গার্হস্থ হিংসায় মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’, স্ত্রী-প্রহারকে ‘আইনসঙ্গত’ আখ্যা দেওয়া হোক! প্রহৃত স্ত্রীকে তাঁর কর্মস্থল বিশেষ অসুস্থতাজনিত ছুটি দিক! শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত স্ত্রীর জন্য বিশেষ চিকিৎসাবিমা চালু হোক!
পুরুষ ‘স্বামী’র মারে আপত্তি না করে স্ত্রী আসলে তাঁর অন্তরকে বিষিয়ে দেওয়া প্রচ্ছন্ন পুরুষতন্ত্রকে প্রকট করছেন। প্রহারকে ‘প্রতিবিধান’ বলতে শেখা তাঁর রক্তাক্ত ঠোঁটে ভর করছে আমাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। সেই সমাজ নারীকে দিয়েও ‘পুরুষতান্ত্রিক উচ্চারণ’ করিয়ে নিচ্ছে। নারীর হৃদয়-জগৎকেও ছেড়ে কথা বলছে না।
আমরা এই ভয়ঙ্কর বর্বরতা এবং তার কাছে নারীর শর্তহীন আত্মসমর্পণকে ‘মনুষ্যত্বের ব্যর্থতা’ বলে মানতে শিখব কবে? ধর্মীয় উগ্রতা যে ভাবে দেশের মাটিকে ক্লেদাক্ত করছে, তাতে এমন প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।