মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-জগদীপ ধনখড় ফাইল চিত্র।
রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ গত আড়াই বছরে এতটাই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে যে, বিরক্তিকর একঘেয়েমি ছাড়া এতে এখন আর আলাদা কোনও অনুভূতি তৈরি হয় না। তবে ইদানীং বিষয়টি আবার একটি জটিল বাঁক নিতে চলেছে, যা আগামী দিনে রাজ্যপালের সঙ্গে সরকারের ‘অসহযোগিতা’র দিকে গড়ালেও হয়তো খুব বিস্ময়ের হবে না।
বহু দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যপাল ধনখড় রোজ সকাল থেকে নিয়ম করে মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, পুলিশের ডিজি-সহ রাজ্য প্রশাসনের পরিচালকদের মুণ্ডপাত শুরু করেন। ইদানীং সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন বিধানসভার স্পিকারও। নবান্নের প্রতিক্রিয়া উস্কে দেওয়ার পক্ষে এগুলি যথেষ্ট। আর সে সব প্রতিক্রিয়া যে সব সময় নিয়ন্ত্রণের গণ্ডিতে থাকে, তাও বলব না। অনেক সময় সেখানে এমনও হয়, যেটা কাঙ্ক্ষিত নয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজ্যপালের নিন্দাবাদের উৎস হল মূলত বিজেপি নেতাদের তোলা নানা অভিযোগ। এটা তাঁর ভূমিকাকে দৃশ্যত ‘রাজনৈতিক’ করে তুলেছে। রাজ্যপালদের নিয়োগ অবশ্যই রাজনৈতিক। ‘কেন্দ্রের এজেন্ট’ হয়েই তাঁরা রাজ্যে আসেন। সাধারণত যেখানে ‘বন্ধু’ সরকার, সেখানে রাজ্যপাল বন্ধু। অন্যথায় প্রয়োজনমতো তিনি কলকাঠি নাড়েন। বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্র-বিরোধী সরকার তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যপালদের ভূমিকা এই ভাবেই চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে।
তবে সেখানে একটা ‘মুখোশ’ রাখার চেষ্টা কিছু কাল আগে পর্যন্ত দেখা যেত। অর্থাৎ, রাজভবনকে সরাসরি পার্টি অফিস করে তোলার ক্ষেত্রে একটু আড়াল-আবডাল থাকত। সেটা ক্রমে ঘুচে যাচ্ছে। শুধু বাংলায় নয়, দেশের বিরোধী-শাসিত অন্য রাজ্যগুলির বেলাতেও এটা কম-বেশি প্রযোজ্য।
নানা সময় ক্ষমতাসীন বামেদের সঙ্গে একাধিক রাজ্যপালের বিরোধ হয়েছে। ধর্মবীর ও অনন্তপ্রসাদ শর্মা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার আগে পর্যন্ত রাজ্য ও কেন্দ্র, দু’জায়গাতেই কংগ্রেস সরকার থাকায় রাজ্যপালদের সঙ্গে বিরোধ বাধত না। যুক্তফ্রন্ট আমলে প্রথম রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধের বড় ঘটনা ঘটে রাজ্যপাল ধর্মবীরের সঙ্গে জ্যোতি বসুদের। সরকার ভেঙে দেওয়ার ‘চক্রী’ ধর্মবীরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জেরে অচিরেই তাঁকে রাজ্য ছাড়তে হয়।
বামফ্রন্ট আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে তিন জনের প্যানেল থেকে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বেছে নিয়ে শর্মা সিপিএম শাসকদের রোষে পড়েছিলেন। তাঁকেও চলে যেতে হয়েছিল এক সন্ধ্যায়, দিল্লির তাৎক্ষণিক নির্দেশে।
অনেকের নিশ্চয় মনে পড়বে, শর্মা রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে কোনও মন্ত্রী তাঁকে বিদায় জানাতে যাননি। তৎকালীন মুখ্যসচিব একটি ফুলের তোড়া নিয়ে গিয়েছিলেন হাওড়া স্টেশনে। কারণ জ্যোতিবাবুরা আগে থেকেই ‘বয়কট’ করেছিলেন রাজ্যপালকে।
এ ছাড়াও রাজ্যপাল হয়ে আসা ভৈরবদত্ত পান্ডেকে ‘বাংলা দমন পান্ডে’ বলা, দেশের প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান টি ভি রাজেশ্বরকে ‘পুলিশ কনস্টেবল’ বলা ইত্যাদি রাজ্যপালদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের ‘মধুর’ সম্পর্কের আরও কিছু উদাহরণ। তাঁরাও কেউ অবশ্য এখানে পুরো মেয়াদ থাকেননি। বলা ভাল, কেন্দ্র তাঁদের সরিয়ে নিয়েছে। আবার এই রাজ্যেই জ্যোতিবাবুর সম্মতিতে অটলবিহারী বাজপেয়ী রাজ্যপাল করে পাঠিয়েছিলেন বিজেপি নেতা ও শিল্পপতি বীরেন জে শাহকে। তিনি আবার ছিলেন জ্যোতিবাবুর ‘ব্যক্তিগত’ বন্ধু।
সাধারণত কাউকে রাজ্যপাল করে পাঠানোর আগে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়। ধনখড়ের ক্ষেত্রে তা হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বার বলেছেন, ধনখড় যখন কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছেন, তখন তাঁকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নতুন রাজ্যপালের আগমন-সংবাদ জানিয়েছিলেন। উত্তরে মমতাও সে দিন তাঁর ক্ষোভ গোপন করেননি।
এখনও পর্যন্ত ধনখড়ের কার্যকালের প্রায় পুরোটাই যে বিতর্কে কাটছে, এক কথায় তা হল, রাজ্যপালের ‘সাংবিধানিক’ অধিকার। কোন ক্ষেত্রে সেই সীমা কত দূর বিস্তৃত, তা বিশেষজ্ঞরা অনেক ভাল বলতে পারবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে অন্য যে কোনও রাজ্যপালের কর্মধারার সঙ্গে জগদীপ ধনখড়ের কার্যকলাপে অমিল অনেক। তাতে ‘বাড়াবাড়ি’র উপাদানও যথেষ্ট।
রাজভবনে বসার কয়েক দিনের মধ্যেই ধনখড় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তখনকার বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ছাত্র বিক্ষোভ থেকে ‘উদ্ধার’ করতে। তাঁর ওই যাওয়ার পিছনে যতটা চমক ছিল, ততটাই ছিল রাজনীতি। সেটা বোঝা গিয়েছিল ওখানে গিয়ে উপাচার্যকে পুলিশ ডাকার জন্য চাপ দেওয়া এবং অন্যথায় ‘চরম’ পরিণতির হুমকি দেওয়ার মধ্যে। ধনখড় সে দিন আচার্যের ‘ক্ষমতা’ দেখিয়ে পুলিশ ডাকতে চান। তাঁর এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সেই শুরু। তার পরে গত আড়াই বছর ধরে একের পর এক বিষয়ে সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের ক্ষমতার লড়াই কার্যত দৈনন্দিন প্রশাসনিক বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আদতে সরকার এবং রাজভবনের সেই বিষবৎ সম্পর্কের মাসুল দিতে হচ্ছে জনগণকে। যেমন বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে অনুমোদন না-আসা।
সংবিধান অনুযায়ী প্রধানত মন্ত্রিসভার পরামর্শ ও সহায়তা নিয়ে রাজ্যপাল কাজ করেন। অর্থ বিল তিনি আটকাতে পারেন না। বিধানসভায় পাশ হওয়া অন্য কোনও বিল তাঁর সম্মতির জন্য পাঠানো হলে প্রয়োজনে পুনর্বিবেচনার জন্য রাজ্যপাল তা ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু বিধানসভা আলোচনা করে যদি একই বিল ফের রাজ্যপালের কাছে পাঠায়, তা হলে তাতে অনুমোদন দেওয়াই বিধি। অন্যথায় রাজ্যপাল তা রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারেন। কিন্তু নিজে আটকে রাখতে পারেন না।
প্রসঙ্গত, হাওড়া পুরসভা থেকে বালিকে আলাদা করার বিলটি এখন কোথায়? রাজ্যপাল বলেছেন, তাঁর কাছে কোনও বিল আটকে নেই। অথচ সরকারের কাছেও বিলটি ফেরত আসেনি। পরিণামে ঝুলেই রয়েছে হাওড়ার পুরনির্বাচন।
বর্তমান রাজ্যপালের ধারাবাহিক সাংবাদিক সম্মেলন ও সমাজমাধ্যমে সরকার-বিরোধী বক্তব্য প্রকাশ রাজ্য রাজনীতিতে আর একটি নতুন এবং অভিনব সংযোজন। আর এটাও ঘটনা যে, তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য থেকে বিজেপি ‘অক্সিজেন’ খুঁজে পায়!
রাজ্যে নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন রাজ্যপালের শিষ্টাচার কী বলে? রোজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদ্গার করা কি তাঁর পদের পক্ষে উপযুক্ত? অতীতে কোনও রাজ্যপাল কি এমন করেছেন? সরকারের গরিষ্ঠতা যত ক্ষণ থাকে, তত ক্ষণ রাজ্যপালের ভূমিকাও সীমিত। চাইলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট তিনি পাঠাতেই পারেন। কিন্তু সরকার, মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাসুলভ বিবৃতি রাজ্যপালকে শোভা পায় কি?
রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক যদি এ ভাবে তিক্ত হয়ে যায়, তা হলে তার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা ধনখড় ও মমতা দু’জনেই বোঝেন। এই দুই শীর্ষ সাংবিধানিক পদাধিকারী কেউ কারও অধীনস্থ নন। তাঁরা পারস্পরিক মর্যাদা রক্ষা করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু বিষয়টি যখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর দিকে চলে যায়, তখন হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাজ্যপালের বিষয়ে ছ’টি চিঠি লিখেছেন। শেষ চিঠিটি লেখা হয় ২৫ জানুয়ারি। এ বার সরাসরি রাজ্যপালের অপসারণ দাবি করা হয়েছে। বোঝানো হয়েছে, তিনি এখানে ‘অবাঞ্ছিত’।
এযাবৎ একটি চিঠিরও জবাব অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আসেনি। ধরে নেওয়া যায়, এই রাজ্যপালের ‘ভূমিকা’ দিল্লির অনুমোদন ও প্রশ্রয়পুষ্ট। এই অবস্থায় মমতা বিষয়টিকে এ বার রাজনৈতিক মোকাবিলার দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। পরিণাম যা-ই হোক, এই কাদা ছোড়াছুড়ি ‘মহামহিম’ পদের পক্ষে সম্মানের হবে তো?