Death of industries in Bengal

ভূমিসংস্কারের কাঙ্খিত ফল না পাওয়াই কি শিল্পক্ষেত্রে বাংলার পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ?

আজ দেশের বৃদ্ধির হার ভাল হলেও সাধারণ নাগরিকের লাভ কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যার মূলে রয়েছে বৃদ্ধির সুফল সাধারণের মধ্যে কতটা বণ্টন হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:০৭
Share:

আমদানি নীতির ফলে রাজ্যের শিল্পও মার খেতে শুরু করে। — ফাইল চিত্র।

বইমেলার ৬ নম্বর গেট থেকে ঢুকেই সামনে সুলেখা স্টল। ওখানে থাকব তিনটের সময়। চলে আসিস।

Advertisement

বন্ধুর বার্তা উপেক্ষা করা কঠিন। সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই যাব না যাব না করেও যাইনি, এই রকম বছর প্রায় নেই-ই। আর প্রতিবারই সেই বন্ধুদের ডাকেই। এই বছরের মিলনস্থল ছিল সুলেখা স্টল। বই কেনা, বহু দিন না দেখা মানুষের সঙ্গে, “আরে!” আর কত বই কিনতে চেয়েও না কিনতে পারা। আমাদের প্রজন্মের কাছে বইমেলা বোধহয় সেই নস্টালজিয়ার ইনফিউশন।

আর সুলেখার স্টলের সামনে দাঁড়িয়েও আবার সেই, “আরে!”

Advertisement

কথা হচ্ছিল বন্ধুর সঙ্গেই। তাতে যোগ দিলেন সুলেখার মালিক পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম, কৌশিক মৈত্র। ছিলেন ঝরনা কলম সংগ্রহ করে বিখ্যাত হওয়া চম গঙ্গোপাধ্যায়ও। সেই নস্টালজিয়া। স্কুল, কালি আর সুলেখা ঘেরা জীবন। আর ঠিক এমনই সময় এক তরুণী কণ্ঠ, “মা দেখো! বুক ফেয়ারে জুতোর কালি!”

মা একটু অপ্রস্তুত হলেন কি না জানি না। কিন্তু তাঁর উত্তর শুনলাম, “আমাদের ছোটবেলায় ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে লিখতে হত। এটা সেই কালি।“

ফাউন্টেন পেন ব্যবহারে ফিরছে এবং এখন আরও বেশি করে। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। তরুণীটি পেনের কালি বলতে কেন শুধু বলপেনের রিফিল বোঝে তাও কিছুটা প্রাসঙ্গিক হলেও বৃহত্তর প্রসঙ্গটি কিন্তু বাঙালির শিল্প এবং শিল্প সচেতনতা। প্রশ্নটা তা হলে করেই ফেলা যাক। ১৯০১ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে শুরু করে ১৯৩০-এর দশক জুড়ে একের পর এক ব্র্যান্ড। হ্যাঁ। শুধু কারখানা বা ব্যবসা নয়। ব্র্যান্ড। সুলেখা, কৃষ্ণা গ্লাস, বেঙ্গল পটারিজ...। আর ১৯৯০ সালে পা দিয়ে দেখছি হয় সংস্থাগুলি অধিগৃহীত, নয় বন্ধ বা ধুঁকছে। যেমন কৃষ্ণা গ্লাস, সুলেখার প্রতিবেশী। আর গোটা কারখানা চত্বরটাই পরিত্যক্ত। যেন ‘ভূতের রিসর্ট’।

ব্যতিক্রমী সুলেখা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাকিরা কেউ বাজারে নেই। আর প্রশ্নটা সেইখানেই। শুরু প্রায় একই সময় এবং মৃত্যুও প্রায় একই সময়েই। একি সত্যিই এক অদ্ভুত সমাপতন? নাকি এর মূলে অন্য কোনও কারণ রয়েছে যা কোনও গবেষকের অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় আসার অপেক্ষায়?

এই সব সংস্থার মালিক পরিবারের সঙ্গে কথা বললেই একটা সরল যুক্তি উঠে আসে বন্ধ হওয়ার দায় নিয়ে। এবং তা হল আগ্রাসী ট্রেড ইউনিয়ন। কিন্তু সেটাই কি সব? নাকি সমস্যা ছিল উদ্যোগপতি হিসাবে সমস্যা মোকাবিলা করার ব্যর্থতাও? এই প্রসঙ্গে সেই রকম কোনও গবেষণা নজরে আসেনি। তবে মানতেই হবে যে সেই সময় রাজ্যের অর্থনীতির উপর একটা চাপও কিন্তু ছিল।

রাজ্যের তৎকালীন বৃহত্তর আর্থিক পরিসরটা দেখলে দেখছি বাজারটাও ছিল দমবন্ধ করে দেওয়ার মতো। তথ্য বলছে গোটা ৮০-র দশকে রাজ্যের কৃষি বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ। কিন্তু আজ যেমন গোটা দেশের বৃদ্ধির হার খুব ভাল হলেও সাধারণ নাগরিকের লাভ তাতে কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যার মূলে রয়েছে এই বৃদ্ধির সুফল সাধারণের মধ্যে কতটা বণ্টন হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন। আর ঠিক একই ভাবে রাজ্যের কৃষির বিকাশ রাজ্যের উন্নয়নে ঠিক কতটা পুনর্বণ্টিত হয়েছে সেই সময়, প্রশ্ন থেকে গিয়েছে তা নিয়েও। কারণ রাজ্য বা দেশের সামগ্রিক আয় বাড়লে তাতে যদি সাধারণের লাভও তাল মিলিয়ে না হয়, তা হলে তৈরি হয় অনৈক্য আর তার প্রভাব পড়ে বাজারেও।

যদি মাথায় রাখি যে রাজ্যের উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশই আসত কৃষি থেকে, তা হলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে বাজারের চাহিদার উপর কৃষির আয়ের প্রভাব কতটা ছিল। কিন্তু সমস্যা তৈরি হল এখানেই। রাজ্যের কৃষির বিকাশে ভূমি সংস্কারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার এই ভূমি সংস্কারের কারণেই হয়ত কৃষির বৃদ্ধির প্রতিফলন আমরা বাজারে দেখতে পাচ্ছি না। যদিও বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪ শতাংশ, কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে কিন্তু চিত্রটা ধূসর থেকে ধূসরতর। এই সময়ে কৃষিতে কর্মসংস্থানে বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বদলে ছিল নিম্নমুখী। আর পতনের হার ছিল ৫ শতাংশ।

মাথায় রাখতে হবে, ভূমি সংস্কার বা অপারেশন বর্গার কারণে কিন্তু বাজারে চাহিদার উপর তার কোনও প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়নি ওই সময় নিয়ে নানান গবেষণায়। কারণ, এই সময়ে একটা বড় সংখ্যক ভাগচাষির সঙ্গেই জমির মালিকের লিখিত চুক্তি করানো যায়নি। আর এই কারণেই কৃষির বৃদ্ধির সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছিল চালকলের মালিকদের হাতে। প্রান্তিক কৃষকদের হাতে সারা বছর কাজের ফলে কোনও উদ্বৃত্ত থাকার জায়গা ছিল না কুক্ষিগত সম্পদের জন্যই।

পাশাপাশি, শিল্পক্ষেত্রে কেন্দ্রের বঞ্চনাও ছিল অনস্বীকার্য। যার প্রতিফলন আমরা দেখি মাসুল সমীকরণের মতো নীতিতে। ১৯৫২ সালে মাসুল সমীকরণ নীতির ফলে রাজ্যে তৈরি কয়লা, স্টিল, সিমেন্টের মতো শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ভারতের যে কোনও প্রান্ত থেকে একই দামে কেনা যেত। ১৯৯৩ সালে এই নীতি গুটিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এর ফলে রাজ্য হারায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সুবিধা। আর লগ্নি চলে যায় মূলত তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র আর গুজরাতে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, মার খায় বিহার, ওড়িশা এবং মধ্যপ্রদেশও।

একই সঙ্গে আমদানি নীতির ফলে রাজ্যের শিল্পও মার খেতে শুরু করে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব কিন্তু আমরা দেখি আঞ্চলিক বাজারেও। কৃষির বৃদ্ধি যেমন বাজারের চাহিদা বৃদ্ধিতে পরিবর্তিত হয়নি, ঠিক একই ভাবে কিন্তু বিনিয়োগ পালানোর ফলে বাজারের চাহিদার উপর আরও চাপ সৃষ্টি হতে থাকে।

আর চাহিদা কমলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব তো স্থানীয় শিল্পের উপর পড়বেই। কৃষ্ণা গ্লাস বা সুলেখা তা সামলাতে পারেনি। শুধু আগ্রাসী শ্রমিক আন্দোলনকে এর জন্য দোষ দেওয়াটা হয়ত বেশ অনেকটা একদেশদর্শীতা হয়ে যায়। তা ঠিক কতটা তা দেখার জন্য প্রয়োজন বন্ধ শিল্প সংস্থা ধরে গবেষণার। কিন্তু তা কি কেউ করছে? বইমেলার ওই তরুণীর করা প্রশ্ন আসলে এই যোক্তিক নিরীক্ষণের অভাবেই। আর তা কিন্তু আত্মবিস্মৃতি নিয়ে বাঙালিকে দোষ দেওয়ার পরিসরকে আরও গভীর করে তুলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement