উৎসব: বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়লাভের পর তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের বিজয়মিছিল। ১৬ এপ্রিল, ২০২২। ছবি: পিটিআই
এক-একটি ভোটে হার এবং হাহাকার! সেই সঙ্গে দোষারোপ। রাজ্য বিজেপির এটাই যেন এখন বাঁধা রুটিন। সবাই জানি, গত বছর বিধানসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়া থেকে বিজেপিতে এই পর্ব শুরু হয়েছিল। একের পর এক উপনির্বাচনে ধাক্কা খেতে খেতে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। আসানসোল লোকসভা এবং বালিগঞ্জ বিধানসভার সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে শোচনীয় হারের পরে ওই দলে সাংগঠনিক পদ থেকে ইস্তফার হিড়িক সেই ধারায় সর্বশেষ সংযোজন।
পাশাপাশি এটাও পরিষ্কার যে, তৃণমূলের পক্ষে বহুমতকে এক কথায় ‘জুলুম’ বা ‘জল মেশানো’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলে সেটা নিছক মূর্খামি হতে পারে। কারণ, পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা সর্বত্র যদি ধারাবাহিক ভাবে একই প্রবণতা দেখা যায়, তা হলে তার পিছনে একই হিসাবের অঙ্ক কষা যায় না।
সিপিএমের ভোট বাড়ছে কেন, তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনেক। তবে সাদামাটা বিচারে এ কথা বলতেই হবে যে, বামের ভোট ‘রাম’-এর ঝুলিতে যাওয়ার ফলে বিজেপির কলেবর বেশ খানিকটা বেড়েছিল। মানুষ বিজেপির থেকে মুখ ফেরানোয় তার একটি অংশ আবার বামেরা ফেরত পাচ্ছেন।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সংখ্যালঘু ভোট। অনেকে মনে করেন, সিপিএমের ভোট শতাংশ বৃদ্ধিতে সংখ্যালঘু ভোটের অবদান আছে। একেবারে নেই, তা হয়তো নয়। কিন্তু বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে সিপিএমের দ্বিতীয় স্থানে উত্থান দেখে যদি কেউ ভাবেন, সংখ্যালঘুরা দলবদ্ধ ভাবে বামের দিকে চলে যেতে শুরু করেছেন, তা হলে বোধ হয় সেটা অতি-সরলীকরণ হয়ে যাবে।
বালিগঞ্জে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে সিপিএম যে ভাগ বসিয়েছে, সন্দেহ নেই। সেখানে সংখ্যালঘু ভোট থাকার কথা অন্তত ৪৫ শতাংশ। তৃণমূল প্রার্থী সম্ভবত তার বেশিটাই পাননি। নয়তো সিপিএমের ভোট শতাংশ ৩০ ছাড়াত না।
তবে অনেকেই মানবেন যে, বালিগঞ্জে এই বিষয়টি যতটা বাবুল-কেন্দ্রিক, ততটা তৃণমূল-কেন্দ্রিক নয়। তাই আসানসোেল ১৭ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূল প্রায় সবটাই ধরে রাখতে পেরেছে। তাদের জয়ের ব্যবধানও সেখানে বিশাল।
সুতরাং, সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের থেকে সরে যাচ্ছে, এমন কোনও সাধারণ সিদ্ধান্তে এখনই উপনীত হওয়া যায় না। সেই চেষ্টা যুক্তিগ্রাহ্যও হতে পারে না। বরং বিজেপির অ-সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কেও যে ক্রমশ ফাটল ধরেছে, আসানসোল ও বালিগঞ্জ দু’টি ক্ষেত্রেই তা প্রমাণ করা সহজ। বালিগঞ্জে বিজেপির তৃতীয় হওয়া ও আসানসোলে তৃণমূলের কাছে তিন লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হওয়ার অন্য কোনও ব্যাখ্যা থাকতে পারে কি?
আসানসোলে ভোটারদের প্রায় অর্ধেক হলেন অ-বঙ্গভাষী। বিজেপি এত দিন জেনে এসেছে, সেটা তাদের বড় ভরসার জায়গা। এ বার তা-ও কিন্তু নড়ে গেল! বালিগঞ্জে গত পুরভোটেও অ-সংখ্যালঘু যে সব ওয়ার্ডে তৃণমূল কম ব্যবধানে জিতেছে, এ বার তারও কয়েকটিতে তাদের ব্যবধান বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিজেপির তথাকথিত ‘শক্ত’ জমি দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং পায়ের তলার মাটি দৃঢ়তর হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের।
এই সরকারের কি তবে ভুল-ত্রুটি নেই? যা হচ্ছে, যা চলছে, সবই কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে? নিশ্চয় নয়। বস্তুত এক নজরে দেখলে রাজ্যে সময় এখন যে বেশ সুস্থির, এমনটাও বলা যাবে না। খুন-জখম হচ্ছে। একের পর এক ধর্ষণের অভিযোগ সামনে আসছে। নির্যাতিতার মৃত্যু হচ্ছে। মন্ত্রী-পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়েও দুর্নীতির আঙুল উঠছে। এমন আরও কত কী। সরকার ব্যবস্থা করলেও বিষয়গুলি প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
তথাপি এখনকার সময়ে যে কোনও নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জেতেন। তাঁর দলই বেশি ভোট পায়। কারণ অধিকাংশ মানুষ আজও মনে করেন যে, রাজ্যে এই মুহূর্তে অন্য কোনও গ্রহণযোগ্য বিকল্প নেই। বাম তো দূরের কথা, বিজেপির সম্পর্কেও জনগণের ভাবনা একই রকম নেতিবাচক। তাই দেখা যায়, মমতার বিরুদ্ধে যাঁরা ‘নাগরিক প্রতিবাদ’ সংগঠিত করেন, তাঁরাও তাঁকে গদিচ্যুত করার দাবি তোলেন না। বরং শাসক হিসেবে তাঁর কাছেই ‘সুশাসন’ চাওয়া হয়।
এই পরিস্থিতিতে দুর্বল বিজেপি এবং তার সহায়ক বশংবদরা ঘুরপথের বিকল্প বেছে নিয়েছে। তা হল, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য চাপ বাড়িয়ে চলা। এ ছাড়া তাদের ‘গত্যন্তর’ নেই। তারা চায়, ৩৫৬ করে পুরোপুরি রাষ্ট্রপতির শাসন বা ৩৫৫ প্রয়োগ করে পুলিশ-প্রশাসনের উপর কর্তৃত্ব— যে ভাবেই হোক রাজ্য সরকারকে ‘লাগাম’ পরানো। অনেকেরই ধারণা, এই চাপ আরও বাড়বে। ‘উপযুক্ত’ স্তর থেকে প্রশ্রয়ও জোগানো হবে। আগামী লোকসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ ভাবে রাজ্যে ‘ব্যতিব্যস্ত’ করে রাখারও এ এক কৌশল।
পরিণাম কী হবে, জানি না। তবে বিষয়টি যে ভাবে নিরন্তর চর্চায় এসে পড়েছে, তাতে মনে হয়, কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ যেন বাজারের আনাজ বা মুদিখানার চাল-ডাল! রাষ্ট্রপতির শাসন যেন হাতের মোয়া! কিলো দরে থলে ভরে কিনে আনলেই হল!
১৯৬২ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে চার বার রাষ্ট্রপতির শাসন দেখেছে এই রাজ্য। প্রথম বার বিধান রায়ের মৃত্যুর পরে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী স্থির হওয়া পর্যন্ত সাত দিনের। বাকি তিন বার ১৯৬৮, ১৯৭০ ও ১৯৭১-এ রাষ্ট্রপতির শাসন ছিল দীর্ঘমেয়াদি। নেপথ্যে রাজ্যপালদের কলকাঠি তখনও ছিল। তবে প্রকাশ্যে ছিল সরকারের গরিষ্ঠতার সঙ্কট।
এখন কিন্তু সরকারের গরিষ্ঠতা হারানোর বিন্দুমাত্র শঙ্কা নেই। তাই আলাদা ছক। বিধানসভার ভোট মেটার পর দিন থেকেই বাংলায় নির্বাচিত সরকার ভেঙে দেওয়ার সক্রিয় চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। অনেকেরই মনে আছে, মুখ্যমন্ত্রীর শপথের আগের দিন আদালতে একটি জনস্বার্থের আবেদন জমা দিয়ে শপথ আটকানো, অর্থাৎ ভোট বাতিল করানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। অভিযোগ— ভোটে হিংসা।
শপথ অনুষ্ঠানে একই বিষয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রকাশ্য মতভেদও ছিল নজিরবিহীন। যদিও ভোটের সময় পুলিশ-প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তথাপি ভোটে হিংসার অভিযোগে মমতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপির যুগ্ম তৎপরতায় জল গড়াল আদালত পর্যন্ত। সঙ্গে রাজভবন তো আছেই।
সম্প্রতি পর পর ঘটনার সিবিআই তদন্তও সরকারের বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ বলতে চাইছে যে, রাজ্যের পুলিশ, প্রশাসনের ‘নিরপেক্ষতা’ প্রশ্নাতীত নয়। তবে সবাই বোঝেন, সিবিআইয়ের উপর গুচ্ছ গুচ্ছ তদন্তের ভার চাপলেও সেটা এক অর্থে কেন্দ্রেরই হাত প্রসারিত করা। প্রসঙ্গত, সিবিআইয়ের ‘নিরপেক্ষতা’ সম্পর্কে দেশের প্রধান বিচারপতির মন্তব্যটি ভোলার নয়!
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত সরকারকে চাপে রাখার বহুমুখী প্রয়াস মমতার পক্ষে কতটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে এবং তিনি কী ভাবে তার মোকাবিলা করবেন, বলবে ভবিষ্যৎ।