নিধন: নাইন আওয়ার্স টু রামা (১৯৬৩) ছবিতে অভিনীত গান্ধী-হত্যার দৃশ্য।
ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় স্থান করে নেওয়ার জন্যই কলকাতার দুর্গাপুজো এ-বার সংবাদের শিরোনামে থাকবার কথা ছিল। সেটা অংশত হয়েছেও বটে, এ-সব ব্যাপারে ওয়াকিবহাল কিছু মানুষ এই স্বীকৃতিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু জনারণ্যে তার চেয়ে বেশি শোরগোল হল সারা ভারত হিন্দু মহাসভার মণ্ডপে প্রদর্শিত অসুরের বিচিত্র মূর্তিটিকে নিয়ে। এক সাংবাদিকের চোখে সেই অসুরের চেহারায় মহাত্মা গান্ধীর আদলটি প্রথম ধরা পড়ে, তাঁর পরিচিত ধুতি এবং গোল চশমা চিনে নিতে কারও ভুল হয়নি, বিশেষ করে যে-হেতু স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রচারে প্রতীক হিসাবে সাম্প্রতিক কালে সেটি বিশেষ পরিচিত।
রাজ্য প্রশাসনের তৎপরতায় পুজোর উদ্যোক্তারা দ্রুত মূর্তির সংস্কারে বাধ্য হন, চুল এবং গোঁফ জুড়ে গান্ধীজির সঙ্গে সাদৃশ্য মুছে দেওয়া হয়। চশমাটি মণ্ডপেই মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়, ওই সাংবাদিকই সেটি ক্যামেরাবন্দি করেন। তবে, অসুরের মুখ ঢাকতে বাধ্য হলেও উদ্যোক্তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নড়েননি। কেউ কোনও অনুশোচনাও জানাননি। সারা ভারত হিন্দু মহাসভার পশ্চিমবঙ্গ শাখার কার্যনির্বাহী সভাপতি চন্দ্রচূড় গোস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা গান্ধীকেই প্রকৃত অসুর বলে মনে করি। তিনিই আসল অসুর। সেই কারণেই মূর্তিটি ওই ভাবে গড়া হয়েছিল।”
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই মূর্তির নিন্দা করেছেন, কিন্তু গোটা ব্যাপারটাকে একটা চরম মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন আচরণ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, লোকের মনেও তার স্মৃতি স্থায়ী হয়নি। বিশেষ কেউ খেয়াল করিয়ে দেননি বা আদৌ ভাবেননি যে, গান্ধীজিকে অসুর হিসাবে দেখানোর রীতি নতুন নয়।
গান্ধীর অমর্যাদার ধারাটি হঠাৎ জন্মায়নি। কয়েক বছর আগে, তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বর্ষপূর্তির সময় জাতীয় শোক পালনের পরিচিত দৃশ্যের পাশেই দেখা গিয়েছিল তাঁর একটি প্রতিমূর্তিকে গুলিবিদ্ধ করার ছবি, সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সেই ঘটনার ছবি তুলতে। নাটকীয়তা বাড়িয়ে তোলার জন্য পিস্তলটি ধরানো হয়েছিল এক মহিলার হাতে, তিনি হিন্দু মহাসভার সদস্য। গুলির আঘাতে গান্ধীজির দেহ থেকে রক্তের মতো লাল রং নিঃসৃত হচ্ছে, প্রচারমাধ্যমে এই দৃশ্যই প্রধান দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছিল।
আরও পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে গোয়াতে হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি ‘হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনার্থে’ সারা ভারত হিন্দু কনভেনশন-এর আয়োজন করে। সেখানে অন্যতম প্রধান বক্তা কে ভি সীতারামাইয়া ঘোষণা করেন যে, গান্ধী ছিলেন ‘ভয়ানক, দুষ্ট এবং ঘোর পাপী’। গীতায় কৃষ্ণের সেই বহুচর্চিত বাণীটি আওড়েছিলেন তিনি: পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্/ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। (সজ্জনদের পরিত্রাণ এবং দুষ্কৃতীর বিনাশ সাধনের জন্য, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হব।) এখানেই থামেননি তিনি, ঘোষণা করেছিলেন যে, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি রামচন্দ্র নাথুরাম গডসের রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে গান্ধীকে বধ করেছিলেন। তিনি যে এই প্রথম বার গান্ধী হত্যার মহিমা কীর্তন করলেন তা নয়, গান্ধী ওয়াজ় ধর্মদ্রোহী অ্যান্ড দেশদ্রোহী: দ্য সুপ্রিম জাজমেন্ট নামে তাঁর লেখা একটি বই আছে, সেখানে তিনি বলেছেন, “ধর্মদ্রোহীদের হত্যা করা উচিত” এবং “যাদের হত্যা করা উচিত তাদের হত্যা না-করা মহাপাপ।” প্রসঙ্গত, ওই সংগঠনের রাজনৈতিক গোত্র এবং আরএসএস-এর সঙ্গে তাঁর সংযোগের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী— এই কনভেনশনে শুভেচ্ছা-বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
গান্ধীকে অসুর এবং গডসেকে দেশভক্ত বলে ঘোষণা করার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বা শুভ-অশুভের ধারণাকে উল্টে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা আছে। ইন্দোরে বিজেপির আইটি সেলের পরিচালক ভিকি মিত্তল দাবি করেছিলেন, গান্ধী না গডসে, কে এই দেশে বেশি জনপ্রিয় সেটা বিচার করার জন্য গডসে যে পিস্তল দিয়ে গান্ধীকে মেরেছিলেন সেটি নিলামে তোলা হোক। কেমন সাড়া মেলে, তা থেকেই বোঝা যাবে দেশের লোক গডসেকে সন্ত্রাসী ভাবে, না দেশভক্ত।
গত বছর দশেক যাবৎ ১৫ নভেম্বর তারিখটি বলিদান দিবস রূপে পালন করা হচ্ছে। ওই দিন নাথুরাম গডসের ফাঁসি হয়েছিল। এখন তাঁর ছবি পুজো করা হয়, আবক্ষমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তাঁর মন্দির নির্মাণের উদ্যোগও হয়েছে। মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্ত এবং পরে সাংসদ হিসাবে নির্বাচিত প্রজ্ঞা ঠাকুর গডসেকে দেশভক্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি প্রজ্ঞাকে ‘অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারবেন না’, কিন্তু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম প্রত্যাহার করা হয়নি।
আজ নয়, সেই ১৯৯৩ সালের ১৯ নভেম্বর বম্বের দাদার-এ পাটিল মারুতি মন্দিরে গডসের সম্মানে এক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। নাথুরাম অখণ্ড ভারত ও হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ওই সভায় তাঁর ভাই এবং গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে অন্যতম অভিযুক্ত গোপাল গডসে সেটি পাঠ করেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত শ্রোতারা সংস্কৃতে লেখা সেই আহ্বানের কথাগুলি সশ্রদ্ধ ভাবে পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন, যেন তাঁরা শপথ নিচ্ছেন। সভায় বিভিন্ন বক্তার ভাষণ ছিল গান্ধীর প্রতি ঘৃণায় এবং নাথুরামের বন্দনায় পরিপূর্ণ। ধর্মভূষণ এস জি শেভড়ে গান্ধী-হত্যার প্রশংসা করলে শ্রোতারা তুমুল হর্ষধ্বনিতে তাঁকে সমর্থন জানান। ‘পাকিস্তানকে হিন্দু রাষ্ট্রের দখলে এনে সিন্ধু নদীকে মুক্ত করার’ জন্য সবাইকে মুক্তহস্তে দান করার আহ্বান জানান গোপাল গডসে। বলা হয় যে, নাথুরাম চেয়েছিলেন তাঁর দেহভস্ম যেন শুধুমাত্র সিন্ধু নদীতে ছড়ানো হয়— জেলে বসে তিনি বলেছিলেন অন্য সব নদীর জলে গান্ধীর দেহভস্মে কলঙ্কিত হয়েছে। গান্ধীকে— ভারতের নয়— পাকিস্তানের জনক বলে অভিহিত করা হয়। ঘোষণা করা হয় যে, তাঁর হত্যার দিনটি উৎসবের লগ্ন হিসাবে উদ্যাপন করা হবে। গান্ধী হত্যাকে ‘বধ’ আখ্যা দেওয়া হয়, অসুর বধের মতো। বলা হয় তিনি এক জন বিশ্বাসঘাতক, তাঁকে বধ করে নাথুরাম গডসে ভারতকে আরও এক বার ভাগ হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন, তাই তিনি হলেন জাতীয় নায়ক। গান্ধীকে বলা হয় ‘মতান্ধ’ এবং ‘রক্তচোষা’— তাঁর হাতে নির্দোষ হিন্দুদের রক্ত লেগে আছে। তিনি অভিহিত হন দেশদ্রোহী বলে। এ-যাবৎ গান্ধীর মৃত্যুকে আমাদের দেশে শাহদত (শহিদত্ব বরণ) হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাসের এই সাম্প্রদায়িক পুনর্লিখনে দেখানো হয় অসুরবধ হিসাবে।
ভালমন্দের ধারণাকে উল্টে দেওয়া এই ঘৃণার রাজনীতির প্রসার ঘটানোর জন্য যে ভাবে ধর্মের ভাষা ও বাগ্ভঙ্গিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা এক বিশাল ও গভীর উদ্বেগের কারণ। সংঘাতের মোকাবিলা করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আনতে গান্ধীজি ধর্ম-কে তার নীতি ও বিশ্বাসকে কী ভাবে ব্যবহার করেছিলেন, সেই ইতিহাস বহুশ্রুত। এর বিপরীতে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরগুলো ধর্মের অপব্যবহার ও অপব্যাখ্যা করে এবং পবিত্র স্থান ও ধর্মীয় মূর্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র থেকে তীব্রতর মেরুকরণ ঘটিয়ে চলেছে। ভোটে জেতা এবং রাজনীতিকে দখলে রাখাই তাদের লক্ষ্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গান্ধীকে মা দুর্গার অস্ত্রে নিহত অসুর রূপে দেখানোর উদ্যোগটির গুরুত্ব অনুধাবন করা দরকার। রাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বার্থে পবিত্র ধর্মীয় পরিসরকে বেছে নেওয়া সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিভেদ তৈরি করাই সেই উদ্দেশ্য।
সেন্টার ফর হিস্টরিক্যাল স্টাডিজ়, স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেস, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়