এত সহজেই এক শত্রু আর এক শত্রুর পরিবর্ত হয়ে উঠতে পারে
Bangladesh Unrest

চেতনা বনাম চৈতন্য

সেই কবে থেকেই ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’! তাই ভারত/বাংলাদেশ, হিন্দু/মুসলমান গোছের কাঠামো থেকে বেরিয়ে মানবসভ্যতার অসুখ হিসেবে ব্যাপারটা বুঝতে ইচ্ছে করে।

Advertisement

অনুরাধা রায়

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৬
Share:

বা‌ংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির অভিঘাতে বিধ্বস্ত হতে হতে একটু গভীরে গিয়ে বুঝে নিতে ইচ্ছে করছে ওই পৈশাচিক উন্মাদনাকে। এমন উন্মাদনা ইতিহাসে প্রথম দেখছি না, আর শুধুমাত্র বাংলাদেশ বা উপমহাদেশই এর বলি নয়— সেই কবে থেকেই ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’! তাই ভারত/বাংলাদেশ, হিন্দু/মুসলমান গোছের কাঠামো থেকে বেরিয়ে মানবসভ্যতার অসুখ হিসেবে ব্যাপারটা বুঝতে ইচ্ছে করে।

Advertisement

লক্ষ করুন, বাংলাদেশে হন্যমান মানুষ বা তাদের জ্বলন্ত বাড়িঘরের চেয়ে পদদলিত ভারতীয় পতাকা বেশি বই কম প্রতিক্রিয়া জাগাল না অনেকেরই মনে। ফলে এ দেশেও বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা। আমাদের দেশপ্রেম কি প্রায়শ মাটি-মানুষের থেকেও পতাকার মতো প্রতীকের জন্য বেশি করে উদ্বুদ্ধ হয়? আবার দেশও তো একটা প্রতীক। মানুষের যে গভীর তাগিদ অনেকে মিলে বেঁধে বেঁধে থাকা, তার প্রতীক। এই তাগিদেই তো মানুষ দেশ তথা নেশন কল্পনা করেছে, যে নেশনের কাল্পনিকতার তত্ত্ব বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের দৌলতে সমাজবিদ্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আবার যে সব নির্ণায়কের ভিত্তিতে এই কল্পনা— উপমহাদেশে ধর্ম বড় নির্ণায়ক— সেও নিরাপত্তা ও ন্যায়ের প্রতীকী নিশ্চয়তা। এক-একটি ধর্মও আবার হরেক প্রতীক লালন করে। অর্থাৎ প্রতীকের মধ্যে প্রতীক, তার মধ্যে প্রতীক। বাংলাদেশে আক্রমণের বড় নিশানা মন্দির বা ধর্মীয় সংগঠনও তো একটি ধর্ম ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতীক (ঠিক যে কারণে ভারতে নিশানা হয় মসজিদ)। একই ধর্মের অভ্যন্তরে অবশ্য প্রতীকচিহ্নের রকমফের থাকতে পারে। ইসলামের মধ্যে সুফিবাদের প্রতীক বা রূপকগুলি তার খুব নিজস্ব— বুলবুল, রক্তগোলাপ। হিন্দুদেরও অসংখ্য দেবতা, অজস্র প্রতীক। সবাই কি আর রাম বা গৈরিক পতাকার ভক্ত?

মানুষ কল্পনাপ্রবণ প্রাণী। আমরা ধুলোমাটি রক্তমাংসের বাস্তবের চেয়ে কল্পলোকেই বাঁচি বেশি করে। অর্থাৎ নদী, গাছ, পশুপাখি, এমনকি মানুষের থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি, জাতি (নেশন, কাস্ট, যে কোনও জনগোষ্ঠী অর্থেই) ইত্যাদি নিয়ে। এ সবই কিন্তু কল্পনার ফসল। কল্পনা আবার করা হয় প্রতীকের সাহায্যে। প্রতীক মানুষের মস্তিষ্কে এসে বাসা বেঁধেছে বিবর্তনিক সুবিধার জন্য— বিশাল ও জটিল বাস্তবকে আয়ত্ত করতে সাহায্য করে বলে। তা ছাড়া খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকাকে ছাপিয়ে জীবনের গভীরতর তাৎপর্যেরও সন্ধান দেয় প্রতীক। কল্পনার লীলাই তো মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি সব তৈরি করল, তাকে অসীম করল। আমাদের শিল্পসাহিত্যে প্রতীকের চমৎকার অভিব্যক্তি। স্নায়ুবিজ্ঞানী ভিলায়ানুর রামচন্দ্রন নিউরো-এস্থেটিক্স আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকদের মস্তিষ্কে প্রতীক বা রূপক উদ্ভাবনের ক্ষমতা অনেকের চেয়ে বেশি থাকে। তবে এক-একটি প্রতীকের উপর জোর দিতে গিয়ে, অন্য প্রতীকে বিশ্বাসী মানুষদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে, মানুষ তার কল্পনাশক্তির অপব্যবহারও করল। ইদানীং অস্মিতার রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে তার পরিচয়।

Advertisement

সুতরাং প্রতীক দু’দিকে কাটা তরোয়াল। এক দিকে মানববন্ধনের সহায়ক, যে বন্ধনের আবেগ আমাদের আত্মত্যাগে প্রাণিত করে মহীয়ান করে তোলে; অন্য দিকে অন্য গোষ্ঠীর প্রতি হিংস্রতারও উৎস। পতাকার কথাই ধরুন। শত্রুর পতাকা পায়ে দলার উল্লাস তো শুধু নয়, মাতঙ্গিনী হাজরা পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তেও হাতের পতাকাটি উত্তোলিত রাখেন বলে আমাদের কত গর্ব। শুধু পতাকা কেন, মনে করুন চিতোর-রানার ভৃত্য কুম্ভ কেমন নকল বুঁদিগড় রক্ষা করতে প্রাণ দেন হারাবংশী গোষ্ঠীর মাথা উঁচু রাখার উদ্দেশ্যে। আবার গোষ্ঠীমর্যাদার প্রতীক বলে গণ্য নারীশরীর শত্রুগোষ্ঠীর আগ্রাসনের মারাত্মক একটি লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে ।

রবার্ট স্যাপলস্কির মতো স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলেন, প্রতীকের প্রবল শক্তির কারণ— আমাদের মস্তিষ্কে প্রতীক ও বাস্তবের মধ্যে নৈকট্য, এমনকি বিভ্রান্তি। আমার শারীরিক যন্ত্রণা (নিজে মার খেতে খেতে) আর বহিঃস্থ/ভাবমূলক কোনও কারণে মানসিক যন্ত্রণা (অন্যকে মার খেতে দেখলে অথবা জাতীয় পতাকার অবমাননায়) মস্তিষ্কের একই জায়গায় আঘাত হানে, যাকে বলে এসিসি (anterior cingulate cortex)। অস্মিতার রাজনীতি প্রতীককে বাস্তবের সঙ্গে হরবখত গুলিয়ে ফেলে এবং অশান্তি বাধায়। বিশেষ করে আধুনিক যুগে যখন নানা রকম সাংস্কৃতিক প্রতীকে বিশ্বাসী মানুষ পাশাপাশি বাস করে, বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যের প্রতীককে অসম্মান করে নিজের প্রতীক দিয়ে বাস্তবটাকে পুরোপুরি দখল করতে চাইলে সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই বাস্তব আর প্রতীকের মধ্যে পার্থক্য করাটাও আধুনিক যুক্তিবাদী মানুষের কাছে প্রত্যাশিত। রামচন্দ্রন বলেন, এই পার্থক্য যে করতে পারে না সে স্কিটজ়োফ্রেনিক। কখনও কখনও সমাজে সামূহিক স্কিটজ়োফ্রেনিয়া মাথাচাড়া দেয়। অমর্ত্য সেনও তো আমাদের বলেছেন, মাল্টিকালচারালিজ়ম কথাটার অর্থ ‘মাল্টিপল মনোকালচারালিজ়ম’ হলে মুশকিল। অন্যের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার ঔদার্য তৈরি করতে হবে, সাংস্কৃতিক সমন্বয় চাই।

আর একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। মানুষ সামাজিক জীব বটে, কিন্তু তার সামাজিকতা সীমাবদ্ধ। নৃতত্ত্ববিদ রবিন ডানবার দেখিয়েছেন, মোটামুটি ১৫০ হল মানবগোষ্ঠীর স্বাভাবিক সংখ্যা, যে গোষ্ঠীর মধ্যে তারা নিজেদের নিয়ে মোটামুটি ভাল ভাবে থাকতে পারে। মস্তিষ্কের নিয়োকর্টেক্স, যা আমাদের চেতনার বড় উৎস, তার আয়তন অনুযায়ী ‘ডানবার নাম্বার’ বাড়ে-কমে। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় নিয়ানডার্থালদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছিল ১২০, হোমো ইরেকটাসদের ১১০, হোমোর পূর্বসূরিদের আরও কম। অথচ আধুনিক নেশন তৈরির অনেক আগে থেকেই ১৫০-ঊর্ধ্ব গোষ্ঠীতে মানুষ বাস করছে। পুরনো প্রস্তর যুগের কোনও কোনও শিকারি গোষ্ঠীও এর চেয়ে বড় হত। তার পর ক্রমে চিফ্‌ডম, রাজ্য, সাম্রাজ্য, ধর্মগোষ্ঠী, জাতিগোষ্ঠী, সব শেষে নেশন। এই আরোহণ সম্ভব হয়েছে মানুষের কল্পনাশক্তির দৌলতে। গোষ্ঠী সংহতির বড় ভিত্তি আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত প্রতীকীয়ানা। বিশেষ বিশেষ প্রতীক দিয়ে এক-একটি গোষ্ঠীকে বাঁধা হয়। আমাদের ভাষা, নতুন নতুন সামাজিক অভ্যাস প্রক্রিয়াটিকে সাহায্য করে (ভাষাও অবশ্য প্রতীক দিয়ে তৈরি চিহ্নতন্ত্র)। কিন্তু অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনাও থেকে যায়। এই ভাবে, যে নিয়োকর্টেক্স মানুষকে জ্ঞানী, সৃজনশীল, মহান করেছে, সেই তাকে করে তুলেছে নৃশংস, ধ্বংসাত্মক।

শুধু আন্তর্গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব কিন্তু নয়, অন্তর্গোষ্ঠী স্তরভেদ আর তজ্জনিত সংঘাতও আছে। গোষ্ঠী যত বড় হয়, ‘ঘোর কুটিল পন্থ’, ‘লোভজটিল বন্ধ’ দিয়ে কিছু মানুষ আধিপত্য নিশ্চিত করতে চায় সেখানে। তাই কত রকম ‘আমরা-ওরা’র ভিত্তিতে ‘নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’ চতুর্দিকে। তবে, স্যাপলস্কি দেখিয়েছেন, আন্তর্গোষ্ঠী সংঘাত তীব্র হলে অন্তর্গোষ্ঠী বিরোধগুলি চাপা পড়ে। তাই দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটানোর উপায় অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা ওস্কানো। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ একাধিক ‘আমরা’র সদস্য। এক-এক সময়ে এক-একটা আত্মপরিচয় অগ্রাধিকার পায় মাথার মধ্যে। কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে এক শত্রু আর এক শত্রুর পরিবর্ত হয়ে উঠতে পারে। তাই বাংলাদেশে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই রাতারাতি বদলে গেল প্রতিবেশী ‘অপর’কে নির্যাতনে।

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা, মানুষের সামাজিকতা যে-হেতু কল্পনা দিয়ে তৈরি, পিঁপড়ে বা মৌমাছির মতো জিন-চালিত স্বজ্ঞা-তাড়িত নয়, মানুষ কিন্তু নিজেকে ‘সর্বমানবচিত্তের মহাদেশ’-এর অধিবাসী হিসেবে কল্পনা করতে পারে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মতো অনেকেই আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, সর্বমানবের সঙ্গে মেলাটাই মানুষের গভীরতম তাগিদ। সেখানেই তার মনুষ্যত্ব, তার মুক্তি। আমরা বুঝিনি। আমাদের চেতনা চৈতন্য হয়ে ওঠেনি।

তাই আমার বাংলাদেশি বন্ধু, যার এই সময়ে গানের অনুষ্ঠান করতে এই বাংলায় আসার কথা ছিল, সে আসতে পারল না। আমরা মন খারাপ করে মোবাইল থেকে তার মধুক্ষরা কণ্ঠের গানগুলি শুনি। এবাড়িতে তার প্রিয় খালাম্মা একটা গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনে— কয়েক মাস আগে আমাদের ডাইনিং টেবিলে বসে খালি গলায় গাওয়া ‘সবারে বাস রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement