সিপিএমের বিক্ষুব্ধ নেতারা নানা দিকে মুখ খুলছেন, কিন্তু আসল কথাটা কেউ বলছেন না। সিপিএম আসলে নির্বাচনটা লড়েইনি। তাদের তথাকথিত যুদ্ধ ছিল বিজেমূল নামক একটা কাল্পনিক দলের বিরুদ্ধে, যে দলের ভূভারতে কোনও অস্তিত্ব নেই। গোটা ভারতের লোক যখন মোদী-মমতার মরণপণ দ্বৈরথ দেখছে, সিপিএম তখন চক্ষু বন্ধ রেখে বলেছে, ও-সব কোনও ব্যাপারই না, আসলে দল তো একটাই, তার নাম বিজেমূল।
ছায়ার সঙ্গে এই পুরো যুদ্ধটাই করা হয়েছে বিজেপি-তৃণমূল বাইনারি ভাঙার নাম করে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, বাইনারিটা ছিল। একদা ময়দানে যেমন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানেরই নাম কেবল উচ্চারিত হত, এই যুদ্ধেও বড় দল ছিল দুটোই। বিজেপি এবং তৃণমূল। সেই বাইনারি ভাঙার দরকার ছিল, এ নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বাইনারি ভাঙার নাম করে টালিগঞ্জ অগ্রগামী নামক ছোট দল যদি দাবি করে যে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, আসলে দল একটাই, তার নাম মোহনবেঙ্গল, এবং সেই কাল্পনিক দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলে টালিগঞ্জ পাঁচ গোলে জিতেই ছাড়বে— তা হলে তা যতটা অবাস্তব ও হাস্যকর হত, এই বিজেমূল নামক তাত্ত্বিক কসরতটাও তাই।
কারণ, মোহনবেঙ্গল বা বিজেমূল নামক কোনও দল পৃথিবীতে নেই। সারা দুনিয়ার লোক দেখতে পেয়েছে, বিজেপি এমন একটা শক্তি, যা আরএসএস-এর আদর্শ এবং সংগঠনে বলীয়ান, যারা কেন্দ্রের ক্ষমতায় এসে ভারতকে একটা হিন্দুরাষ্ট্র বানিয়ে তোলার লক্ষ্যে ধাবিত, গোটা দুনিয়ায় দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের প্রসঙ্গে বোলসোনারো বা ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর নাম একই সারিতে উচ্চারিত হচ্ছে। সে তুলনায়, যত খারাপই হোক না কেন, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক অস্তিত্ব, যারা একটামাত্র রাজ্যে ক্ষমতায় আছে, তাদের কোনও তুলনাই হয় না। এটা দুনিয়ার সবাই বুঝেছে, কেবল সিপিএম বাদে। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। বিজেমূল নামক এই বকচ্ছপ ধারণাটাকে জনতা স্রেফ ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বিজেপি হল হেড-আপিস এবং তৃণমূল হল ব্রাঞ্চ, গ্রেটার এবং লেসার ইভিল বলে কিছু হয় না, যাহা গোখরো তাহাই লালপিঁপড়ে, ফলিডল-খাওয়া আর বদহজম একই জিনিস, এই জাতীয় কথাবার্তায় ন্যূনতম সাধারণজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কান দেওয়ার কথা নয়।
আরও এক অদ্ভুত জিনিস, যা ভূভারতে কখনও ঘটেনি, এ বারের নির্বাচনে ঘটানো হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম কোনও দল স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। এক-দেড় দশক আগে, শিল্পায়নের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম মডেল, এবং তা রূপায়ণের পদ্ধতিকে মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সেটা বড় কথা না, রাজনৈতিক দলের ইতিহাসে এ রকম ভুলভ্রান্তি হয়। ইন্দিরা গাঁধীর হয়েছিল জরুরি অবস্থা জারি করা। রাজীব গাঁধীর হয়েছিল বাবরি মসজিদের তালা খোলা। কিন্তু যেটা কখনও হয়নি সেটা হল, কোনও একটা সিদ্ধান্তের জন্য গদি যাওয়ার পরেও, অনর্গল ‘যা করেছিলাম ঠিক করেছিলাম’ আওড়ে চলা। ইন্দিরা কখনওই ‘জরুরি অবস্থা জারি করে বেশ করেছিলাম, সুযোগ পেলেই আবার করব’ বলে বেড়াননি। তা হলে সম্ভবত কংগ্রেস উঠে যেত। কোনও দলই এই রকম নির্বুদ্ধিতা দেখায় না, কারণ কেউই উঠে যেতে চায় না।
ব্যতিক্রম বঙ্গের সিপিএম। তারা প্রচুর বুদ্ধি খাটিয়ে নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর প্রসঙ্গ আবার খুঁড়ে তুলেছে এই নির্বাচনে। সেটা আবার নেহাত মিনমিন করে ‘আমাদের উদ্দেশ্য তো ভাল ছিল, পদ্ধতিতে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে’ বলে নয়। রীতিমতো বুক বাজিয়ে ‘যা করেছি বেশ করেছি’ ঘোষণা করে। “বুদ্ধবাবু যা করেছিলেন ঠিক করেছিলেন, নিন্দুকরা সব্বাই লাইন দিয়ে ক্ষমা চান”— এ কথাটা বারংবার গলা তুলে বলে যাওয়া হয়েছে। সোজা বাংলায় এর অর্থ হল, বাংলার বেশির ভাগ মানুষকে ‘অ্যাই তোরা আমাদের হারানোর জন্য ক্ষমা চা’ বলার অপরিসীম ঔদ্ধত্য দেখানো। আত্মহত্যার সদিচ্ছা না থাকলে ভোটের রাজনীতিতে এ জিনিস কেউ করে না। অবশ্য সজ্ঞানে স্বেচ্ছামৃত্যু চাইলে সে নিয়ে বলার কিছু নেই। বিশ্বের ইতিহাসে এটা নতুন কিছুও না। সোভিয়েট পার্টির মাথা মিখাইল গর্বাচেভ স্বয়ং নিজের পার্টির সদর দফতরে তালা মেরে দিয়েছিলেন, সে কেলেঙ্কারি আরও বেশি ছিল। তবে তার পরেও বাম-দিকে ঝোঁকা লিবারাল এই কলমচির অন্তত একটি বাঁ দিক-ঘেঁষা শক্তির স্বেচ্ছামৃত্যুর অঙ্গীকার দেখলে খারাপ একটু লাগে বটে।
সিপিএমের এ বারের নির্বাচনের আর এক দুর্ধর্ষ মাস্টারস্ট্রোক ছিল ‘লিবারাল’ নামক একটা গোষ্ঠীর পুনরাবিষ্কার। এ যেন নতুন করে চাকা আবিষ্কার। মার্ক্স-এঙ্গেলস দেড়শো বছর আগে লিবারালিজ়ম নিয়ে নানা কথা বলে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আজকের দুনিয়ায় লেফট-লিবারাল একটা প্রতিষ্ঠিত বর্গ। লিবারাল অর্থাৎ উদারমনস্ক মানেই বাম না হতেই পারে, কিন্তু বাম মানেই, মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয়, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ লিবারাল হবেই। এমতাবস্থায় বামেরা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে, এই মুহূর্তের যুদ্ধ শুধু বিজেমূলের সঙ্গেই নয়, আজকের বিরাট দ্বন্দ্ব বাম বনাম লিবারাল।
ব্যস, হাল্লা চলল যুদ্ধে। দলীয় মুখপত্র থেকে সমাজমাধ্যম পর্যন্ত সর্বত্র লিবারালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে ফেলা হল। তা হলে কি তাঁরা নিজেদের কনজ়ারভেটিভ বা রক্ষণশীল বলে দাবি করছেন? কে জানে। তবে এর ফলে কার্যত যেটা হয়েছে, সেটা হল— দুনিয়ার যে কোনও লোক, যিনি বামপন্থীদের কর্মপদ্ধতিতে ন্যূনতম সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, সবাইকে লিবারাল আখ্যা দিয়ে উত্তাল গালমন্দ। আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোটের পর এটা আরও বাড়ে। এমন এক জন লোক, যিনি আদতে ধর্মগুরু, যিনি মহিলাদের গাছে বেঁধে পেটানোর নিদান দেন নির্বিকার সারল্যে, তিনি কী করে দু’দিনের মধ্যে বামেদের মুক্তিসূর্য হয়ে উঠলেন, এই নিয়ে বহু বাম-সমর্থক প্রশ্ন তোলায় মহাপ্রাজ্ঞ পার্টি মেশিনারি কেবল একটা কাজই করেছে— প্রশ্নকারীদের নাগাড়ে লিবারাল, চালচোর এবং ইসলামোফোব বলে দাগিয়ে গালমন্দ করা। দুনিয়ার সর্বত্র, এমনকি বিপ্লব-টিপ্লবের সময়ও, বামপন্থী-ডানপন্থী নির্বিশেষে সবাই দোদুল্যমান শক্তিকে নিজের দিকে টেনে আনার একটা চেষ্টা করে। পশ্চিমবঙ্গই এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম, কারণ এখানে বামপন্থী রাজনৈতিক লাইনের একমাত্র কাজ ছিল যত বেশি সংখ্যক লোককে শত্রু বলে দাগানো যায়, এবং দূরে ঠেলা যায়, সেই চেষ্টা করা। তাতেই যেন মোক্ষ।
এই কাজে দোসর হয়েছে, অনলাইনে বামেদের অধুনাখ্যাত ট্রোলবাহিনী। এমনিতেই বামেদের সঙ্ঘবদ্ধ অস্তিত্ব এখন কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায়। নেতৃত্ব যা-ই করুন, মাটিতে গুটিকতক যা কর্মী ছিলেন, তাঁরা যখন দাঁতে-দাঁত-চেপে যা হোক কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন, তখন কলকাতাকেন্দ্রিক এই ট্রোলবাহিনী সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে কী করে মানুষকে দূরে ঠেলা যায়, সে চেষ্টা নাগাড়ে করে গিয়েছে। এই সঙ্ঘবদ্ধ কর্মীরা বিদ্যায় কালিদাস, কর্মে অষ্টরম্ভা, ঔদ্ধত্যে হার্মাদপ্রতিম, এবং কী করে নিজের দলের ভোট কমাতে হয় আর জ্যামিতিক হারে শত্রু বাড়াতে হয়, তার কপিবুক উদাহরণ। দুনিয়ার সমস্ত দল যখন ভোটের আগে ভোটারদের তুষ্ট করতে ব্যস্ত, এই সোশ্যাল মিডিয়া সেলের কর্মীরা তখন মহাসমারোহে ভোটার-তাড়াও যজ্ঞ করে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। একে যদি মূর্খামি বলা হয় তো বিশ্বের ইতিহাসে এর সমতুল্য মূর্খামি খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেরলের সিপিএম, শোনা গিয়েছে, অনলাইন কর্মীদের জন্য আচরণবিধি নির্ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে সে সবের বালাই নেই, অতএব এই বিশ্বরেকর্ডে নেতৃত্বের অনুমোদন ছিলই ধরে নিতে হবে।
এই সবের যোগফলই আজকের অবস্থা। বামেরা শূন্য। বিরোধী শক্তি বিজেপি। পনেরো বছর আগে যে ফ্রন্টের ৫০% জনসমর্থন ছিল, আরও একগুচ্ছ দলের সঙ্গে জোট-টোট করেও তারা এখন ৮%। এই -৪২% অগ্রগতি দেখালে বিশ্বের যে কোনও সংস্থার মাথাদেরই এত দিনে চাকরি যেত। যে কোনও পার্টিই লাইন বদলে ফেলত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম চলছে জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতো। সমর্থনে ঘটি ডোবে না, কিন্তু জমিদারি ঘরানার কোনও পরিবর্তন নেই। বাস্তব অবস্থাকে খোলা চোখে না দেখলে এ অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। দন কিহোতের মতো উইন্ডমিলের সঙ্গে যুদ্ধ, বা এই নিবন্ধকারকে শত্রু ঠাহরে গালাগাল, কোনও কিছুতেই এই অবস্থা বদলাবে না। অবস্থা ঘোরাতে গেলে, আদৌ যদি ইচ্ছে থাকে, এইটুকু কটু বটিকা সেবন করা প্রয়োজন। বামপন্থার এবং বিজেপি মুক্ত বাংলার স্বার্থে।