‘আমাদের পথ নেই আর’
BJP

কখনও পোশাক, কখনও খাদ্য, কখনও ধর্ম দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি

কর্নাটকে যে মুসলমান ছাত্রীরা হিজাব পরতে চায়, দীর্ঘ দিন ধরেই তারা হিজাব পরে কলেজে যেত।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৪২
Share:

ছোটবেলা থেকেই ভারতকে চিনেছি নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মহান মিলনক্ষেত্র হিসেবে। কিন্তু আজকাল প্রায়শই দেখছি বৈচিত্র ও বহুত্বের এই মহামিলনের বিরুদ্ধে নেমে আসছে ক্ষমতার খড়্গ। সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণের কথা বলি। কর্নাটকে ফতোয়া জারি হল যে, মুসলমান মেয়েরা হিজাব পরে কলেজে যেতে পারবে না। দিল্লির এক পুরসভা বলল, নবরাত্রিতে মাংস বিক্রি বন্ধ রাখতে হবে। রামনবমীর দিন দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ঘটল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরামিষ ভোজন চাপিয়ে দিতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সংগঠিত হামলা হল। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এবং সমন্বয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য রাস্তা ছেড়ে রাষ্ট্রশক্তি ও পেশিশক্তির বলে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের নামে দেশ ও সমাজকে আমরা কি এ ভাবে বিভাজনের পথে ঠেলে দেব?

Advertisement

কর্নাটকে যে মুসলমান ছাত্রীরা হিজাব পরতে চায়, দীর্ঘ দিন ধরেই তারা হিজাব পরে কলেজে যেত। ভারতের অন্য অনেক রাজ্যেও এই চল আছে। বিজেপি নেতাদের দ্বারা পরিচালিত কলেজ সমিতি পোশাকবিধি চালু করে হিজাব নিষিদ্ধ করতেই আমরা দেখলাম যে, গুন্ডাবাহিনী সেই নিষেধাজ্ঞা সুনিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমে পড়ল। শান্তি-শৃঙ্খলার নাম করে সরকারও সেই নিষেধাজ্ঞার পক্ষে দাঁড়াল; আদালতও সেই অবস্থানের পক্ষেই রায় দিল। স্কুল-কলেজের বাইরে প্রবেশদ্বারে শিক্ষিকাদেরও বাধ্য করা হয়েছে হিজাব জমা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে। হিজাব পরার অধিকার এবং শিক্ষা গ্রহণ বা পরীক্ষায় বসার অধিকারের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে ছাত্রীদের। এর ফলে শিক্ষা বা পরীক্ষার অধিকার থেকে ছাত্রীদের বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।

আশঙ্কা, কর্নাটক থেকে এই হিজাব নিষেধাজ্ঞা এ বার স্বাভাবিক ভাবেই ছড়িয়ে পড়বে দেশের অন্যান্য রাজ্যে। এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পেতে হলে মুসলমান ছাত্রীদের যেতে হবে শুধুমাত্র মুসলমান ছাত্রীদের জন্য আলাদা ভাবে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ, বিভিন্ন ধর্মের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ ও পরিসর বন্ধ হতে থাকবে। বিহারে ব্যাঙ্কের একটি শাখায় হিজাব পরিহিতা মহিলাকে টাকা দিতে অস্বীকার করার ভিডিয়ো দেখা গিয়েছে। কলেজের পোশাকবিধির আড়ালে গোটা সমাজে আমরা-ওরা বিভাজনের প্রাচীর তুলে দেওয়ার অনায়াস আয়োজন।

Advertisement

এই আমরা-ওরা বিভাজন রেখা টেনেই কয়েক বছর আগে মাঝরাতে মহম্মদ আখলাককে বাড়ি থেকে বার করে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। অজুহাত ছিল, তাঁর বাড়ির ফ্রিজে নাকি গোমাংস রাখা ছিল। তার পর একের পর এক গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা আমরা দেখেছি গোটা দেশ জুড়ে। ছুতো কখনও গোমাংস, কখনও গোহত্যা, কখনও গরু পাচারের অভিযোগ বা নিছক গুজব। গুজরাতে দেখা গেল একের পর এক শহরে রাস্তায় ডিম বা মাংস বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা। বরোদা, রাজকোট, ভাবনগর, আমদাবাদ পেরিয়ে নবরাত্রিতে নিষেধাজ্ঞার গণ্ডিতে বাঁধা পড়ল রাজধানী দিল্লি। শুধু মাংস নয়, চিত্তরঞ্জন পার্কের মাছের বাজারেও নোটিস ধরানো হয়েছে। নবরাত্রির পাশাপাশি রমজান, আর রমজান মানেই সান্ধ্য ইফতার। পুরসভার একুশে আইনে ইফতারও বাধ্যতামূলক ভাবে নিরামিষ। এই আহারসংহিতার বিরোধিতা করতে গিয়ে আহত হলেন জেএনইউ-এর পড়ুয়ারা।

পোশাক থেকে আহার, কলেজ থেকে সিনেমা হল, আমরা-ওরা’র কাঁটাতারের বেড়ায় ক্ষতবিক্ষত আজ গোটা দেশ। একটি চলচ্চিত্রকে কী ভাবে এই কাজে লাগানো যেতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণও আজ আমাদের চোখের সামনে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস সিনেমাটি নিয়ে যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী-সহ সরকার এবং সমগ্র সঙ্ঘবাহিনী প্রচারযুদ্ধে নেমে পড়েছে, এবং সিনেমা প্রদর্শনীকে ঘিরে যে ভাবে গোটা দেশ জুড়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বা সামাজিক-রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় নজিরবিহীন। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর সন্ত্রাসবাদী হানা এবং বিরাট সংখ্যায় তাঁদের শরণার্থী হয়ে পড়ার কাহিনি অবশ্যই সকলের জানা উচিত; দেরিতে হলেও তাঁরা যেন সুবিচার পান, তা নিশ্চিত করা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক বড় দায়িত্ব। কিন্তু কাশ্মীর ফাইলস সিনেমা এবং তাকে ঘিরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলমান অভিযান আমাদের সে দিকে নিয়ে যায় না— তা আমাদের ঠেলে দিচ্ছে এক তীব্র অন্ধ মুসলমানবিদ্বেষের কানা গলিতে।

কাশ্মীর ফাইলস যদি গত তিন দশকের কাশ্মীর পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের সামান্য হলেও সজাগ করত, তা হলে আমরা কাশ্মীরি মুসলমান জনগণকেও ভুক্তভোগী হিসেবে দেখতাম। তা হলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগত যে, তিন দশকেও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কেন ঘরে ফেরানো গেল না। বিশেষ করে সেই তিন দশকের দীর্ঘ সময় জুড়ে যখন কেন্দ্রে, এমনকি রাজ্যেও, বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। প্রশ্ন জাগত, ৩৭০ ধারাকে অকেজো করে দিয়ে, রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত এলাকায় পরিণত করে, নির্বিচারে বিজেপি ছাড়া প্রায় সব দলের সব নেতাকে জেলে বা ঘরে আটক করে, ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে কার্যত গোটা কাশ্মীরকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার কি আদৌ কোনও সমাধান হচ্ছে? ৩৭০ ধারা এবং রাজ্য বিধানসভার পরিবর্তে আজ সশস্ত্র বল বিশেষাধিকার আইন বা আফস্পাকেই কি সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের যোগসূত্র হিসেবে তুলে ধরছে?

কাশ্মীর ফাইলস কাশ্মীর সমস্যা ও কাশ্মীরের বৃহত্তর জনগণ সম্পর্কে আমাদের ভাবায় না, কিন্তু জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে দর্শকের মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তোলে। কাশ্মীরি পণ্ডিতের নিরাপত্তাহীনতা কাশ্মীরের বুকে সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে দর্শককে সহানুভূতিশীল করে তোলার পরিবর্তে গোটা দেশ জুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মনে ভয় ও বিপন্নতাবোধের সঞ্চার করে। এই হিন্দু বিপন্নতাবোধকে কাজে লাগিয়েই যতি নরসিংহানন্দ বা বজরং মুনির মতো ব্যক্তি সাধুর বেশে সামনে চলে আসেন। ধর্ম সংসদ থেকে গণহত্যার আহ্বান উচ্চারিত হয়, পুলিশের উপস্থিতিতে মুসলমান মহিলাদের দেওয়া হয় ধর্ষণের ধমক। রামনবমী উৎসব উদ্‌যাপনের নামে মসজিদ বা মুসলমান নাগরিকদের দোকান বা বাড়ির উপর কোথাও অগ্নিসংযোগ ঘটে, কোথাও বুলডোজ়ার দিয়ে সব গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে রামনবমী উৎসবের দীর্ঘ সামাজিক ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু রামের নামে মুসলমানবিদ্বেষ ও মুসলমান নাগরিক ও প্রতীকের উপর ঘৃণাবর্ষণ ও হিংসাত্মক আক্রমণের ইতিহাস সাম্প্রতিক। রাম মন্দির আন্দোলনের সময় থেকে এই প্রবণতা আমরা বাড়তে দেখছি। এ বছর দেখা গেল বিপুল মাত্রায়। উৎসবের নামে এই উন্মাদনা ও হিংসা শুধু মুসলমান সমাজের জন্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলছে না, বৃহত্তর হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনের শান্তি, নিরাপত্তা এবং ধর্মাচরণের অর্থ ও আবহ ইত্যাদিও সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ধর্মের নামে ধ্বংসের এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে সরব হওয়া আজ সময়ের দাবি।

আমরা-ওরা’র কোনও বাঁধাধরা ছক হয় না। এখানে যারা আমরা, ওখানে তারাই হয়ে যেতে পারি ওরা। গণপিটুনি যখন অভ্যাসে, উৎসবে পরিণত হয়, তখন সাংবাদিক সৌরভ শর্মা, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের সন্তানেরা খুব সহজেই নয়ডার বহুতল আবাসনে আক্রান্ত হয়ে যান। নিছক মাঝরাতে আবাসনের মধ্যে ধর্মপালনের নামে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করার ‘অপরাধ’-এ। রাহত ইন্দৌরির সতর্কবাণী মনে পড়ে যাচ্ছে— লগেগি আগ তো আয়েঙ্গে ঘর কঈ জদ মেঁ, য়হাঁ পে সির্ফ হমারা মকান থোড়ি হ্যায় (আগুন লাগলে তাতে অনেক ঘরই জ্বলবে, এখানে বাড়ি তো শুধু আমার একার নয়)। আমরা-ওরা’র বেড়া ভেঙে বেরিয়ে আসুক আমাদের সকলের ভারত।

সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement