নিয়ত পরিবর্তনশীল সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে এই শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণ কোনও স্থায়ী অবস্থান নয়।
পশ্চিমবঙ্গের আগামী বিধানসভায় একজনও বামপন্থী বিধায়ক নেই। এ তথ্য শুধু উদ্বেগজনকই নয়, একই সঙ্গে তা এ রাজ্যে সংসদীয় বামপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে একাধিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে একটা কথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল কোনও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নয়, সে বেঁচে থাকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে, রণনীতি ও রণকৌশলের ফলিত প্রয়োগে। জনগণ আমাদের প্রত্যাখান করলেও আমরা লোকের জন্য অক্সিজেন পৌঁছব, শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালাব, কেউ আবার এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলবেন, কারণ জনগণ এর যোগ্য নয়— এই কথাগুলিতে আবেগ থাকলেও তা এক অরাজনৈতিক অবস্থান।
যেহেতু সংসদীয় বামপন্থী দলগুলির, বিশেষ করে সিপিএমের অতি বড় সমর্থকও এ কথা বিশ্বাস করেন না যে, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করাই পার্টির লক্ষ্য, তাই আলোচনা করতে হবে সংসদীয় রাজনীতির অনুষঙ্গে। সে ক্ষেত্রে বামদলগুলির মধ্যে সিপিএমের ভূমিকাটাই আজ মুখ্য। তাই তাদের বক্তব্য, মতামত, প্রচারপত্র, দলীয় কাগজে প্রকাশিত বয়ান ঘিরেই এ আলোচনা। যে দল নিজেকে ‘মার্কসবাদী’ বলে দাবি করে সে যখন রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে, তখন বাকি রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে মূল্যায়ন করাটা জরুরি। আর নিয়ত পরিবর্তনশীল সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে এই শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণ কোনও স্থায়ী অবস্থান নয়।
সিপিএমের অভিধানে ‘সমালোচনা’ শব্দটি থাকলেও ‘আত্মসমালোচনা’ শব্দটির অস্তিত্ব নেই।
আমরা দেখার চেষ্টা করব, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণে সিপিএম কোন মানদণ্ড নির্ধারণ করছে। পুরনো লোকেদের স্মরণে আছে যে, একটা সময়ে সিপিএমের রাজনীতির ভরকেন্দ্র ছিল এককাট্টা কংগ্রেস বিরোধিতা। কেরলে প্রথম বামপন্থী সরকারের অপসারণ থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা, সেই সময়ের সন্ত্রাস, বুর্জোয়াদের সেবাদাস, গ্যাট চুক্তি, বোফর্স কেলেঙ্কারি— যে কোনও সিপিএম ন্যারেটিভে জাতীয় কংগ্রেস তখন এনিমি নাম্বার ওয়ান। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তনটাও সবার জানা। বিজেপির সর্বভারতীয় উত্থানের পর কেন্দ্রীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে মিত্রতা, আবার পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে মারকাটারি লড়াই, ২০১১ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পর কংগ্রেস আবার এ রাজ্যে তাদের স্বাভাবিক মিত্র। একটা এ কথা শিশুও বুঝবে যে, এই বদল কোনও আদর্শগত অবস্থান নয়, নেহাৎই রাজনীতিতে অস্তিত্ব বজায় রাখার বা ক্ষমতা পুনর্দখল করার কৌশল মাত্র। বিশেষ করে উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়নের নীতির বিরুদ্ধে সতত সরব একটা দল নয়া অর্থনীতির ভগীরথদের স্বাভাবিক মিত্র হয়ে ওঠে, এটা তারই পরিচায় বহন করে।
সেই জোট করে সিপিএম এ বার সবচেয়ে বেশি ন্যাজে-গোবরে হয়েছে এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার রাজ্যে। তারা এক অদ্ভুত তত্ত্ব বাজারে ছাড়ে যার মূল কথা হল, বিজেপি-কে পরাজিত করতে হলে তৃণমূলকে পরাজিত করতে হবে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বিজেপি ও তৃণমূল একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ মাত্র। ক্যাডারকুলের সুবিধার জন্য নতুন এক শব্দ আমদানি করা হল যার নাম 'বিজেমূল'। এই তাত্ত্বিক ভাবনা আগাগোড়া ভুলে ভরা। তৃণমূল কংগ্রেস সব বিচারেই একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক, আঞ্চলিক, পরিবারকেন্দ্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত দল। এই ধরনের বহু দলের সঙ্গে (লালুপ্রসাদের আরজেডি, করুণানিধির ডিএমকে, মূলায়মের সমাজবাদী, মায়াবতীর বিএসপি) সিপিএমের মতো সংসদসর্বস্ব দল নির্বাচনী জোট পর্যন্ত করেছে। কিন্তু বিজেপি একটি আলাদা গোত্রের সর্বভারতীয় দল, যারা ঘোষিত ভাবে সংবিধান বদলে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে চায়, যাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র স্পষ্ট। তাই বিজেপি ও তৃণমূলকে এক বন্ধনীতে ফেলা চরম বিভ্রান্তি। তাদের যুক্তির স্বপক্ষে আলিমুদ্দিনের কর্তারা যে বিষয়গুলির অবতারণা করেন, যেমন— গণতান্ত্রিক পরিসরের উপর আঘাত, বিরোধীশূন্য করার মানসিকতা, দলীয় সন্ত্রাস— এ সবের যথেষ্ট সারবত্তা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও সত্য, দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামশাসনে তাঁদের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার ফলে তৃণমূল বা সিপিএম, কেউই ফ্যাসিস্ট হয়ে যায়নি। এই ভ্রান্ত তত্ত্বের আমদানি হয় ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয়ের পরে। নেতৃত্বের একটা অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেন, নিজেদের তাগিদে নয়, বিজেপিকে দিয়ে তৃণমূলের কাঁটা ওপড়াতে হবে। তাই কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি বিরোধিতার চড়া সুর থাকলেও রাজ্য স্তরে তৃণমূল বিরোধিতার প্রশ্নে সিপিএম ও বিজেপি প্রায় এক সুরে কথা বলতে শুরু করে। যার ফল ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বাম ভোটের সরাসরি বিজেপির বাক্সে জমা হওয়া। এর পর থেকেই ‘২০২১ সালে রাম, ২০২৬ সালে বাম’ নামক এক প্রতিক্রিয়াশীল শ্লোগান তৈরি হল এবং অনেক বামপন্থী মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন।
এই বিপর্যয় পথভ্রষ্ট বামপন্থীদের, বামপন্থার নয়।
এই অন্ধ নীতির ফলে যাঁরা বিজেপির ফ্যাসিবাদী চরিত্রকে উন্মোচিত করতে চেয়েছেন তাঁদেরই সিপিএম ‘তৃণমূলের স্তাবক’ বলে দেগে দিয়েছে। সেই জঘন্য কুৎসা থেকে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ কর্মী হোক বা সিপিআইএমএল ( লিবারেশন) সম্পাদক বা দিল্লির সংগ্রামী কৃষক নেতৃত্ব— কেউই রেহাই পাননি। এই সময় ভারত কাঁপিয়ে দেওয়া কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব (যার মধ্যে অন্যতম কৃষক সভা ও সিপিএমের প্রবীণ নেতা হান্নান মোল্লাও রয়েছেন) স্থির করেন, নির্বাচন হচ্ছে, এমন রাজ্যগুলিতে তাঁরা বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানাবেন। এটা কারোর নজর এড়ায় নি যে, রাজ্যের সিপিএম ও তার গণসংগঠনের কেউই এই প্রচারে অংশ নেননি বরং দিল্লির আন্দোলনে সাংগঠনিক অস্তিত্ব না থাকলেও তৃণমূল এই কর্মসূচিকে সফল করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন আইএসএফের সঙ্গে জোট প্রতীয়মান হয়েছে তৃণমূলকে দুর্বল করে বিজেপি-কে শক্তিশালী করার নীল নকশা হিসাবে। মুসলমানরা এক দিকে এই পরিকল্পনাকে সজোরে প্রত্যাখান করেছেন আর বামপন্থীদের একটা অংশ বিজেপির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। এর পরিণতি বামপন্থীদের প্রাপ্ত ভোট ৫ শতাংশের নীচে।
শুধু বিজেপিকে মূল্যায়নের প্রশ্নই নয়, সিপিএমের আরেকটা পর্বত প্রমাণ ভ্রান্তি হল তৃণমূল সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পগুলি সম্পর্কে ধারাবাহিক বিষোদ্গার, যা এই বারের নির্বাচনী প্রচারে চরমে উঠেছিল। একটা আদ্যন্ত নয়া অর্থনীতির জমানায় যখন রাষ্ট্র বাজারের চাপে তার জনকল্যাণমূলক দায়বদ্ধতা ক্রমশ ত্যাগ করছে তখন দুনিয়াজুড়ে জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের দাবি জোরদার হচ্ছে। সিপিএমের কর্মকর্তাদের এ কথা অজানা নয়, ১০০ দিনের রোজগার যোজনাই হোক বা মিড ডে মিল— সবটাই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সবুজ সাথী, ২ টাকার চাল, স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, ব্যাগ বা ল্যাপটপ দেওয়াকে ধারাবাহিক ভাবে ভিক্ষার রাজনীতি (এমনকি নির্বাচনে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার পর জনগণকে ভিক্ষার যোগ্য বলা) আখ্যা তারাই দিতে পারে, যারা গরিব মানুষের ভাবনা থেকে আলোকবর্ষ দূরে থাকে। অথচ এই করোনাকালেই সিপিএমের একটা দাবি হল প্রত্যেক পরিবারকে নগদ টাকা দেওয়া, সেটাও কিন্তু অনুদানের রাজনীতিরই উদাহরণ।
সমস্যাটা হল, সিপিএমের অভিধানে ‘সমালোচনা’ শব্দটি থাকলেও ‘আত্মসমালোচনা’ শব্দটির অস্তিত্ব নেই। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে সিপিএমের যে বিপর্যয় শুরু হয়, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন। প্রশ্নটা ছিল, একটি ঔপনিবেশিক অধিগ্রহণ আইনকে কাজে লাগিয়ে কৃষকের সম্মতির বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শিল্পায়ন করা যায় কি না। একই সঙ্গে তা ছিল ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ নামক একটি কেন্দ্রীয় আইনের প্রয়োগের বিরুদ্ধে। সিপিএম কেন্দ্রীয় স্তরে এই আইনের বিরোধিতা করেছিল, উড়িষ্যায় পস্কো কারখানা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল। কিন্তু এ রাজ্যে তারা অন্য অবস্থান নিয়েছিল। সে সময় বিরোধীরা ছাড়াও বামফ্রন্টের অন্য সমস্ত শরিক দল, বামপন্থী চিন্তাবিদদের একটা বড় অংশ প্রকাশ্যে সিপিএমের এই উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। দেশজোড়া আন্দোলনের চাপে সেই জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আইনটি বাতিল হয়। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে আজ তারা বুক বাজিয়ে তাদের সেই সময়ের কাজের সাফাই গাইছে। একই সঙ্গে সে সময় দলীয় সন্ত্রাস ও দলদাস প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের যে প্রতিবাদ, তাকেও তারা মনে রাখেনি। একই ভাবে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার অজস্র ইস্যু থাকলেও এ রাজ্যে তারা সেই অর্থে কোনও গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মনে রাখতে হবে, ভারত বনধ, নবান্ন অভিযানের মতো সময় নির্দিষ্ট কর্মসূচি পালনকে গণ আন্দোলন বলে না। বরং সিপিএমের সাংগঠনিক সক্রিয়তা আজ মূলত নেটমাধ্যম নির্ভর। তাই জমিতে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আশার কথা হল— এই বিপর্যয় পথভ্রষ্ট বামপন্থীদের, বামপন্থার নয়। এখন প্রয়োজন বৃহত্তর বাম ঐক্যের লক্ষ্যে নিরন্তর সংলাপ, সময়ের দাবি সেটাই।