PM Narendra Modi's Foreign Policy

ভারতকে পাশ্চাত্যের কাছে প্রধানমন্ত্রী মোদী অপরিহার্য করে তুলতে পেরেছেন কি?

স্থায়ী আসন পেলে ভারত কি করবে যা অন্যরা করতে পারেনি? যুদ্ধ থামাতে যদি না-ও পারে, অন্তত তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে একটা বলিষ্ঠ স্বর শোনা যাবে কি ভারতের কণ্ঠে?

Advertisement

অর্ধেন্দু সেন

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৪ ০৮:০০
Share:

নরেন্দ্র মোদী এবং ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এক্স থেকে।

ধরুন আপনি দারোগাবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, তাঁর এলাকায় কোথাও খুন ডাকাতি বা গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়েছে খবর পেলে তিনি কী করবেন? খুব সম্ভবত দারোগাবাবু বলবেন, তিনি আধিকারিক পাঠিয়ে বিশদে খোঁজ নেবেন ঠিক কী ঘটেছে, অপরাধীদের চিহ্নিত করা গিয়েছে কি না, কত দ্রুত তাঁদের গ্রেফতার করে কাঠগড়ায় তোলা যাবে ইত্যাদি। পরিবর্তে তিনি যদি বলেন, স্থানীয় পার্টি অফিসে লোক পাঠিয়ে জেনে নেবেন অভিযুক্তেরা কোন দলের, কোন গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ এবং তার ভিত্তিতে ঠিক করবেন কোনও পদক্ষেপ করা উচিত হবে কি না, আপনি বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট মধ্যবিত্ত বাঙালি হলে আপনার হাড়-পিত্ত জ্বলে যাবে। ভাববেন, এ কোন দেশি কথা? নীতিহীনতার কোন অতল?

Advertisement

বিদেশনীতির বেলায় কিন্তু দারোগাবাবুর কথা অনেকটাই গ্রহণযোগ্য হবে। বিলেতের খ্যাতনামা প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টন বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কোনও স্থায়ী বন্ধু নেই। স্থায়ী শত্রু নেই। আমাদের স্বার্থটাই শুধু স্থায়ী।’’ স্বার্থ দেখতে হলে নীতি বিসর্জন দিতে হয়। এ কথা স্বীকৃত। তাই বিদেশনীতিতে ‘নীতি’র ভূমিকা সীমিত থাকে। কিন্তু সব দেশ নিজের স্বার্থ দেখবে, কোনও নীতির প্রশ্ন উঠবে না, এ ভাবে কি শান্তি বজায় রাখা যায়? দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ থামানো যায়? যায় না যে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সে যুদ্ধ এখনও থামেনি। এ বছর শুরু হয়েছে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ। থামার লক্ষণ নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ রীতি মেনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ করেছে। কাজের কাজ হয়নি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাত কোটিরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার কারণে মৃত্যু হয় দু’লক্ষ মানুষের। এই মর্মান্তিক ঘটনার পরে সব দেশই ঐকমত্য হয় যে, যুদ্ধ থামানোর জন্য একটা কার্যকরী ব্যবস্থা দরকার। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে তৈরি ‘লিগ অফ নেশনস’ ভেঙে দিয়ে তৈরি হয় রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক আদালত। নিরাপত্তা পরিষদকে ক্ষমতা দেওয়া হয়, শৃঙ্খলারক্ষার স্বার্থে প্রয়োজন হলে যে কোনও দেশের বিরুদ্ধে সামরিক বল প্রয়োগ করার। রাষ্ট্রপু়্ঞ্জের সদস্যপদ বাধ্যতামূলক না-হলেও কার্যত সব দেশই যোগ দেয় সেখানে।

Advertisement

রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠনের সময়ে ভারত স্বাধীন হয়নি। জওহরলাল নেহরু কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। প্রশ্ন ওঠে, যুদ্ধের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ কি ঐকমত্য হতে পারবে? ধরে নেওয়া হয়, দেশগুলি নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ না দেখে সমষ্টির স্বার্থ দেখবে। কিছু দিন হলও তাই। কিন্তু সেই পরিবেশ জিইয়ে রাখতে হলে সব দেশকে একই ক্ষমতা ও অধিকার দেওয়া দরকার। গোড়া থেকেই কিন্তু দেখা যায়, সব ক্ষমতা নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের হাতে। রাষ্ট্রপুঞ্জ কোনও দিন এই পাঁচ ক্ষমতাবান দেশের বিরোধিতা করতে পারেনি। এবং যুদ্ধ বন্ধ করতেও শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং সম্প্রতি ইউক্রেনে আমরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেছি।

এ ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কী মত? তাঁর সুস্পষ্ট মত, ভারত এখন শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য। ভারতীয় অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিছু দিনের মধ্যেই আমাদের জিডিপি পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে ফেলবে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী আসন পাওয়া উচিত। স্থায়ী আসন পেলে ভারত কি করবে যা অন্যরা করতে পারেনি? যুদ্ধ থামাতে যদি না-ও পারে, অন্তত তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে একটা বলিষ্ঠ স্বর শোনা যাবে কি ভারতের কণ্ঠে? ইউক্রেন এবং বিশেষ করে প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রে ভারত দ্বিধাহীন হয়ে রাশিয়া এবং ইজ়রায়েলের পক্ষ নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, তার কাছে তার জাতীয় স্বার্থই সব। অন্য দেশের কথা ভাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার নেই। মজার কথা এই যে, নেহরু বা ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা যদি আমাদের থাকতও তার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদের কোনও প্রয়োজন ছিল না। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি ‘ন্যাম’-এ ভারতের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল কোনও শংসাপত্রের ভিত্তিতে নয়, বরং এই বিশ্বাসে যে, ভারত নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নীতিনিষ্ঠ অবস্থান নিতে পারবে।

সেই যুগের অবসান হয়েছে। নেহরু-নাসের-টিটোর স্থান গ্রহণ করেছেন মোদী-নেতানিয়াহু-এর্দোয়ান-বলসোনারো। কিন্তু ভারতের কদর কি বাড়েনি? বিশ্বের দরবারে আমরা কি এখন উঁচু টেবিলে বসছি না? নিশ্চয়ই বেড়েছে। কিন্তু অনেকে তার কৃতিত্ব পুরোটাই দিতে চান মোদীকে। সেটা ঠিক নয়। প্রথম কারণ হল, মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে অর্থনীতির উদারীকরণ। বৃদ্ধির হার ৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয় ৮-১০ শতাংশ। আমদানি-রফতানি-বিদেশি বিনিয়োগ সবই বেড়ে যায় দ্রুত। দ্বিতীয়ত, নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আক্রমণের পরে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলি আমেরিকার রোষে পড়ে। প্রায় একই সঙ্গে চিন তার পাশ্চাত্য বিরোধিতা বৃদ্ধি করতে থাকে। মোদীর কৃতিত্ব, এই পরিস্থিতিতে তিনি পাশ্চাত্যের কাছে ভারতকে অপরিহার্য করে তুলতে পেরেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পরে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আমেরিকা। রাশিয়া থেকে আমরা অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম কিনি। সেই সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের, বিশেষ করে তৈল শোধনাগারের মালিকদের প্রচুর ক্ষতি হয়ে যেত। আমরা নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে রাশিয়া থেকে তেল কেনা চালিয়ে গিয়েছি। তার জন্য মোদীকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। মোদীর শক্তির আর এক উৎস হল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক। এত দিন আমরা নিরুপায় হয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি করেছি। এখন চাইছি, অন্যদের সুযোগ করে দিতে। আমাদের কদর বাড়তে বাধ্য।

যুদ্ধ থামানো রাষ্ট্রপুঞ্জের একমাত্র কাজ নয়। আরও কাজ আছে। যেমন, বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলা। সেখানেও রাষ্ট্রপুঞ্জ একই রকম ভাবে অপদার্থতার নিদর্শন রেখেছে। তার মধ্যে আর যাচ্ছি না। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের কথাটা এখনও শেষ হয়নি। পরিষদের প্রথম পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে ছিল চিয়াং কাই-শেকের জাতীয়তাবাদী চিন। তার লীলা সাঙ্গ হয় ১৯৪৯ সালে। তার পর সেই স্থান পাওয়ার কথা মাও জে দংয়ের। আমেরিকার তাতে ঘোর আপত্তি। একটা কমিউনিস্টে হচ্ছে না আর একটা! তার চেয়ে দেখো না ভারতকে বসিয়ে দেওয়া যায় কি না! নেহরু লোক সুবিধার নয়। কিন্তু মন্দের ভাল। এই প্রস্তাব আজকে এলে কী হত? আমাদের আবার বেরোতে হত মিছিল করে। থালা-বাসন-ঘটি-বাটি হাতে, শঙ্খধ্বনি সহকারে। নেহরু কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এক বার নয় দু’বার। সেই ভুলের জন্য আজও হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় সকাল-সন্ধ্যা দু’বেলা তাঁর মুণ্ডপাত করে থাকে।

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement