গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারতে কালো টাকা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এর প্রাক্তন অধ্যাপক অরুণ কুমার। তাঁর অনুমান, ১৯৬০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-এর পাঁচ শতাংশ। এই অনুপাত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ৬২ শতাংশ হয়েছে। গত ৬০ বছরে জিডিপি কতটা বেড়েছে তা ভারতের নাগরিকদের বলে দিতে হবে না। তা হলে বুঝে দেখুন, কালো টাকা কত বেড়েছে! অর্থনীতির উপর কালো টাকার প্রভাব বিশ্লেষণ করে অরুণ কুমার দেখিয়েছেন যে, এই পরিমাণ কালো টাকার বোঝা না-থাকলে আর্থিক বৃদ্ধির হার হত পাঁচ শতাংশ বেশি। আজ মাথাপিছু জিডিপি হত ১১ হাজার ডলার। মাথা উঁচু করে আমরা প্রবেশ করতাম ট্রিলিয়ন ডলার ক্লাবে।
সরকারের কি উচিত ছিল না কালো টাকার বৃদ্ধি কঠোর হাতে দমন করা?
নিশ্চয়ই। এবং সরকার চেষ্টাও কম করেনি। ১৯৪৮ সাল থেকে ৪০০-র বেশি কমিটি গঠিত হয়েছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। কমিটিগুলি সরকারের কাছে কয়েক হাজার সুপারিশ জমা দিয়েছে। সরকার তার মধ্যে কয়েকশো সুপারিশ মেনেও নিয়েছে। কালো টাকার অগ্রগতি কিন্তু রুদ্ধ হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাজের মানুষ। উনি বুঝলেন আর একটা কমিটি করে কিছুই হবে না। তাই নিজেই ব্যবস্থা নিলেন। নোটবন্দি। ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বেআইনি ঘোষিত হল। কালো টাকার ব্যাপারীরা জব্দ। পরে অবশ্য বুঝেছিলেন, দুটো ভুল হয়েছে। প্রথমত, কালো ধন আর কালো টাকা এক নয়। মানে কালো সম্পদ শুধু নোটে থাকে না। অন্য ভাবেও রাখা যায়। দ্বিতীয়ত, শুধু গচ্ছিত কালো টাকা নষ্ট করলে হয় না। তার সরবরাহও বন্ধ করতে হয়।
কালো টাকা কিসে কাজে লাগে? আমি লুকিয়ে জমি কিনতে পারি। কলকাতা শহরে আমার পাঁচটা বাড়ি থাকা অসম্ভব নয়। এ ছাড়া সোনা-দানা-হিরে-পান্না তো আছেই। কিন্তু এ ভাবে কত আর খরচ করা যায়! থোক টাকা খরচ করতে হলে নির্বাচন ছাড়া গতি নেই। জিততে তো টাকা লাগেই। হেরে গিয়ে ‘সামাল’ দিতেও লাগে। বিপক্ষের সাংসদ-বিধায়কদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁদের হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেওয়ার খরচকেও বলা যায় নির্বাচনী খরচ।
তা হলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলিকে কালো টাকার প্রভাবমুক্ত করতে পেরেছি?
না পারিনি। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও এ কাজ আমরা করে উঠতে পারিনি। ২০১৭-১৮ সালের বাজেট পেশ করার সময় এই স্বীকারোক্তি করে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এক নতুন ‘স্কিম’-এর জন্য লোকসভার অনুমোদন চেয়েছিলেন— ইলেকটোরাল বা নির্বাচনী বন্ড স্কিম। এই স্কিমের উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক দলগুলির হাতে কিছু সাদা টাকা তুলে দেওয়া যাতে তাদের কালো টাকার উপর নির্ভরতা কমে। ধরে নেওয়া হয়, টাকাটা নির্বাচনেই খরচ হবে। কিন্তু কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দেখুন। যে দু’টি দল সবচেয়ে বেশি টাকা পেল তাদেরই দুই প্রথম সারির নেত্রী টাকার অভাবে নির্বাচনে লড়তে পারছেন না।
একাধিক কারণে আমি এই বন্ডের কৃতিত্ব দিই জেটলি সাহেবকে। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নয়। মোদী ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে নোটবন্দি করেছিলেন। যার ফলে কালো টাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাঁর পক্ষে ২০১৭ সালে কালো টাকার বিরুদ্ধে এক নতুন অভিযানে নামা সম্ভব? সে হত নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। তা ছাড়া কালো টাকা সম্বন্ধে মোদীর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার: না নিজে খাব, না কাউকে খেতে দেব। নির্বাচনী বন্ড স্কিম এর থেকে ৩২ হাত দূরে। স্কিমের বক্তব্য: নিজে খাব। অন্যদের খেতে দেব না। সরকার বাহাদুরের কাছে সবই আছে— পুলিশ, অ্যানটি-করাপশন, সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স। কী নেই! কিন্তু কে কোন দলকে ব্ল্যাকে কত দিল তার হিসাব রাখা সরকারের সাধ্যের বাইরে।
কিন্তু যদি সাদা টাকা হয়? তা তো যাবে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। সে হিসাব বিরোধীরা পাবে না। কিন্তু সরকারের পেতে অসুবিধা নেই। তাই বন্ডে একটা নম্বর রাখা হল যা শুধু অতিবেগনি আলোতে পড়া যায়। এই নম্বরের মাহাত্ম্য বোঝা কঠিন নয়। স্টেট ব্যাঙ্ক শেষ পর্যন্ত রাজি ছিল না এই নম্বর প্রকাশ করতে। মনে হচ্ছিল, প্রয়োজনে তারা তৈরি আছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করতে! লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ যাঁরা পড়েছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রকে ভেঙে চুরমার করতে হবে। কিন্তু তাদের ব্যাঙ্ক রেখে দিতে হবে। এবং নতুন রাষ্ট্রের কাজে লাগাতে হবে। ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে সরকারের কথায় কান ধরে ওঠ-বস করতে দেখলে তিনি যে কী ভাবতেন!
নিজের রাজনৈতিক দলকে কিছু টাকা পাইয়ে দিতে কত দূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন জেটলি? এই ‘স্কিম’ আসার আগে ২০,০০০ টাকার বেশি চাঁদা দিলে দাতার নাম জানানো বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু নির্বাচনী বন্ডে কোনও সীমা রইল না। তাতে স্বচ্ছতা বাড়ল কী করে? আগে বিদেশি কোম্পানি দেশের রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে পারত না। সেই রক্ষাকবচও আর রইল না। কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একমাত্র লাভজনক কোম্পানি পারত রাজনৈতিক দলকে অনুদান দিতে। তা-ও বিগত তিন বছরের লাভের সাড়ে সাত শতাংশের বেশি নয়। নির্বাচনী বন্ড স্কিম বলল, যে কোম্পানি যত চায় দেবে। কোনও শর্ত মানতে হবে না। ফলে ফাঁপা কোম্পানির মাধ্যমে টাকা চালান দেওয়ার সুবিধা হল। প্রসঙ্গত, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং নির্বাচন কমিশন দুই প্রতিষ্ঠানই প্রথমে এই স্কিমের বিরোধিতা করে। পরে তাদের রাজি হতে বাধ্য করা হয়।
ভেবে অবাক হতে হয় যে, এতগুলি পরিবর্তন একসঙ্গে আনা হল, তা-ও স্বচ্ছতার নামে। খুব সম্ভব সেই কারণেই ব্যর্থ হল এই ‘স্কিম’। শীর্ষ আদালত ‘স্কিম’কে অসাংবিধানিক বলার আগেই দেখা গেল, ভারতের কর্পোরেট সেক্টর ‘স্কিম’টিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কোম্পানিগুলো কিছু ব্যবসা পাওয়ার জন্য বা নিজেদের হয়রানি থেকে বাঁচাবার জন্য যেটুকু না দিলেই নয় তা দিয়ে খালাস। কে জানে বাবা, যদি সত্যিই স্বচ্ছতা বাড়ে তা হলে আমাদের বাঁচাবে কে! ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী এবং তাঁদের দল কত খরচ করেছে? সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ-এর অনুমান, প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। সেই জায়গায় পাঁচ বছরে বন্ডের মোট কেনা-বেচা হয়েছে ১০-১২ হাজার কোটি! জেটলি সাহেব থাকলে দুঃখ পেতেন।
জেটলির অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল ‘ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কমিশন’। বিচারপতিদের তিনি ভাল চোখে দেখতেন না। কারণ, নির্বাচনে না-জিতেই তাঁরা প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন। অর্থাৎ নির্বাচনে লড়াই করলে যে দায়িত্ববোধ জন্মায় তা ছাড়াই তাঁরা ক্ষমতায় আসীন হন। এটা ঠিক নয়। মোদীর সুহৃদ ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি পাঠান, মোদীই বা তা পারবেন না কেন? হয়তো এক দিন পারবেন। তবে আপাতত বিচারপতিদের দলই যে এগিয়ে তাতে কোনও সন্দেহ রইল না।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)