(বাঁ দিক থেকে) রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, হার্দিক পাণ্ড্য, মহম্মদ সিরাজ। ছবি: এএফপি, পিটিআই এবং আইসিসি।
এই প্রথম এত জন প্রাপ্তবয়স্ককে একসঙ্গে কাঁদতে দেখলাম। আনন্দাশ্রু। কিন্তু অশ্রু তো! ২৯ জুনের রাত গড়িয়ে যাচ্ছে মধ্যরাতের দিকে। কিন্তু ১৪০ কোটির চোখে ঘুম নেই। সেই ১৪০ কোটির চোখেও কি আনন্দাশ্রু?
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কান্নার মতো বিশুদ্ধ আবেগ সম্ভবত আর কিছু হয় না। আবেগতাড়িত হয়ে পড়া নাকি পেশাদারদের মানায় না। সমাজের উচ্চকোটির মানুষ এবং তথাকথিত ভদ্রলোকেরা চেষ্টা-টেষ্টা করে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। যাতে জনসমক্ষে আবেগতাড়িত হয়ে না পড়েন। সেটা নাকি ভেঙে পড়া। অতএব মধ্যবিত্ততা। অতএব অনুচিত। আবেগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত নাকি ভুল হতে বাধ্য। হতে পারে। কিন্তু এই মধ্যবয়সে পৌঁছে মনে হয়, ভাগ্যিস আবেগ ছিল! ভাগ্যিস আবেগের কোনও অভিধান নেই!
আবেগ আমাদের দিয়ে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করিয়ে নেয়, যা আপাত ভাবে মনে হয় অসাধ্য, অসম্ভব। আবেগে মানুষ নিজের সীমা নিজে অতিক্রম করে যায়। আবেগ মানুষকে বাড়তি প্যাশন দেয়। ‘চাকরি’ থেকে ‘কাজ’ করায় উত্তরণ ঘটায়। নিছক ‘চাকুরিজীবী’ থেকে ‘কর্মী’ তৈরি করে। আবেগ পেশাদারদের আপাত-নির্মোহ খোলস টান মেরে ছিঁড়ে ফেলতে শেখায়। সমস্ত বাধাবন্ধ চুলোর দুয়ারে দিয়ে আত্মাকে উন্মুক্ত করতে শেখায়। তখন চরাচরকে পবিত্র মনে হয়। সর্বসমক্ষে কান্নায় ভেঙে পড়তে আর কোনও আটবাঁধ থাকে না।
মানুষ কখন কাঁদে? যখন হারে। যখন বাধা টপকায়। যখন আশায় বুক বাঁধে। যখন ভেঙে পড়ে। যখন চেষ্টা করে। যখন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যখন আবার চেষ্টা করে। আর কাঁদে তখন, যখন সে জিতে যায়।
চোখের জল মুছছেন চিরকাল নিজের আবেগকে নিখুঁত ফরওয়ার্ড ডিফেন্স করতে অভ্যস্ত রাহুল দ্রাবিড়। যিনি নাকি ক্রিকেট সার্কিটে একেবারে পালিশ-করা ‘ভদ্রলোক’। শিশুর মতো কাঁদছেন হার্দিক পাণ্ড্য। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বখাটে যুবক’ বিশ্বকাপ ফাইনালে নেমেছিলেন ঝাঁকড়া চুলে প্রায় ক্রু-কাট করে। বিজ্ঞাপনদাতাদের সাধের দাড়িটি কামিয়ে। সফল ক্রিকেটীয় মহাতারকা নয়, তাঁকে লাগছিল কোচিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত জানকবুল ক্রিকেট শিক্ষার্থীর মতো। শেষ ডেলিভারিটা করার পর হাঁটু ভেঙে ধপাস করে মাঠের মধ্যে বসে পড়লেন তিনি। ওঠার পরে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন সতীর্থেরা। সহযোদ্ধাদের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলেন হার্দিক। কে যেন তাঁর হাতে দিয়ে গেল একটা জাতীয় পতাকা। সেটা গায়ে জড়িয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে হার্দিক বলছিলেন, ‘‘গত ছ’টা মাস আমার কী গিয়েছে, আমি নিজেই শুধু জানি! কিন্তু আমি কখনও কারও সামনে চোখে জল আনিনি। কারণ, তা হলে যারা আমার নামে কথাগুলো বলে বেড়াচ্ছিল, তারা বুঝত, আমি ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছি।’’
মোবাইল হাতে বাউন্ডারির পাশে উবু হয়ে বসে আছেন বিরাট কোহলি। হাতের পিঠে মুছে নিচ্ছেন অশ্রুবিন্দু। তার আগে যিনি হেড কোচের বুকে মাথা গুঁজে দিয়েছেন চোখের জল আটকাতে না-পেরে। একটু পরে নিজেকে খানিক সামলে স্নেহশীল পিতা হয়ে মোবাইলটা মুখের একটু দূরে ধরে রেখে যিনি সন্তানকে হাসাতে কখনও মুখ ভ্যাংচাবেন, কখনও ট্যারা হবেন, কখনও ছুড়ে দেবেন চুম্বন। তারও খানিক পরে মাঠের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে ক্যামেরার সামনে বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচের সেরা বলবেন, ‘‘আমি আমার যাবতীয় অহং দূরে সরিয়ে রেখে ঈশ্বরকে বলেছিলাম, কোনও কিছুর উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি ক্রিকেট খেলাটাকে সম্মান জানিয়ে মাথা নিচু করে আমার কর্ম করব। বাকিটা তোমার হাতে। ঈশ্বর আমায় আমার কাজের ফলটা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি আবার মাথা নিচু করে তা গ্রহণ করতে চাই।’’ আরও পরে আরবসাগরের ঢেউয়ের মতো ধেয়ে আসা সমবেত জনগর্জনে ডুবে যেতে যেতে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বলবেন, ‘‘পনেরো বছর ধরে রোহিতের সঙ্গে খেলছি। মাঠে ওকে এত আবেগতাড়িত কখনও দেখিনি। যখন সিঁড়ি বেয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছি, আমাদের দু’জনের চোখেই জল। কারণ, এই ট্রফিটা আমরা দু’জনেই প্রাণপণে দেশকে দিতে চেয়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতেই আমরা দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরলাম। ওই স্মৃতিটা আজীবন সঙ্গে থেকে যাবে।’’ মনে হচ্ছিল, আবেগ আমাদের অন্যের প্রশংসায় অকৃপণ করে। উদার করে। বিনয়ী করে। নম্র করে। অপরের প্রতি দয়ালু করে। আবেগ আমাদের নিজেকে ভেঙে ফেলে আবার গড়তে শেখায়।
ওই দাঁড়িয়ে মহম্মদ সিরাজ। হায়দরাবাদের অটোচালকের সন্তান। বাবার মৃত্যুর পরেও যিনি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ় মাঝপথে ফেলে রেখে দেশে ফিরে আসেননি। প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েননি। এখন তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে চোখের জল।
টিভি সঞ্চালক স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কাঁদছেন ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট যশপ্রীত বুমরা। যিনি বলবেন, ‘‘আমি সাধারণত এতটা আবেগ দেখাই না। কোনও ম্যাচের পর সাধারণত কান্না পায় না। কিন্তু সে দিন আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। ইট ওয়াজ় সো সো আনরিয়্যাল!’’
এবং রোহিত গুরুনাথ শর্মা। বার্বাডোজ়ের কেনসিংটন ওভালে দমচাপা ম্যাচের পর তিনি যা যা করলেন, শুধু সেগুলো নিয়েই একটা অণুগল্প লিখে ফেলা যায়। সেই কাহিনির ছত্রে ছত্রে প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অক্ষরে লেখা থাকবে আবেগ, আবেগ এবং আবেগ।
প্রথমে ঘাসের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। তার পরে ডান হাতে চারটে চাপড় মারলেন মাঠে। ধীরে ধীরে উঠে একটু হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে কিছু ক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। একলা। সম্ভবত তখন নিজেকে বিশ্বাস করাচ্ছিলেন, ট্রফিটা সত্যিই জিতেছি! ভারত সত্যিই আবার বিশ্বসেরা! তার পরে দৌড়ে গিয়ে ইন্টারভিউ-রত হার্দিকের গালে চকাস করে একটু চুমো দিলেন। কৃতী ভাইয়ের গালে যেমন স্নেহচুম্বন আঁকেন বড়দা। এর পরে যখন ভারতীয় অধিনায়ককে ক্যামেরা ধরল, তখন তিনি ড্রেসিংরুমের সামনে। তিন বার হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। হয়তো ভরা নীল রঙের গ্যালারিকে। হয়তো ক্রিকেটদেবতাকে। হয়তো নিজের ভাগ্যকে।
তখন কোহলি উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। দুই স্বপ্নদ্রষ্টার দেখা হল সেই সোপানে, যে সিঁড়ি তাঁরা একত্রে চড়তে শুরু করেছিলেন। মহা-আলিঙ্গনে দুই বুভুক্ষুর আকাঙ্ক্ষার অশ্রুবিন্দু মিলে গেল সাফল্যের সিঁড়ির শেষ ধাপে। শিখরে। শৃঙ্গে।
দেখতে দেখতে নিজেকেই আবার প্রশ্ন করছিলাম, মানুষ কখন কাঁদে? মানুষ কাঁদে, যখন সে হারে। যখন বাধা টপকায়। যখন আশায় বুক বাঁধে। যখন ভেঙে পড়ে। যখন চেষ্টা করে। যখন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যখন আবার চেষ্টা করে। আর কাঁদে তখন, যখন সে জিতে যায়। তখন চুলোর দোরে যায় প্রাপ্তবয়স্কতার চোখরাঙানি। উচ্ছন্নে যায় যাবতীয় অহং।
প্রাপ্তবয়স্কেরা কখনও কাঁদে না। বিশ্বচ্যাম্পিয়নেরা কাঁদেন। ভাগ্যিস আবেগ ছিল! ভাগ্যিস আবেগের কোনও অভিধান নেই!