—ফাইল চিত্র।
১৯০৩ সালে ইংল্যান্ড-জার্মানির তুলনায় রাশিয়া ছিল নেহাতই অনগ্রসর। কেউ বিশ্বাস করতেন না যে, অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ায় পুঁজিবাদ আসতে পারে। এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য লেনিন একটা বই লিখেছিলেন: ‘ডেভেলপমেন্ট অফ ক্যাপিটালিজম ইন রাশিয়া’। সেই বইয়ে লেনিন পাতার পর পাতায়, সারণির পর সারণিতে দেখান, প্রত্যেকটি ‘ডুমা’য় কোন সামগ্রীর উৎপাদন কতটা হচ্ছে প্রাক্-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, আর কতটা এসেছে পুঁজিবাদের আওতায়। শেষ সারণিতে দেখা যায়, গোটা রাশিয়ায় পুঁজিবাদী উৎপাদন ৪-৫ শতাংশ। পাঠকের মনে হবে, পণ্ডশ্রম। এই যদি হয় ক্যাপিটালিজ়মের চেহারা, তা হলে কেনই বা এত কষ্ট করলেন লেনিন!
কিন্তু না। লেনিন দেখালেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন অনুপাতে নগণ্য হলেও তা দ্রুত বাড়ছে। এই হল অন্তর্দৃষ্টি। কথাটা মনে পড়ে গেল সাম্প্রতিক একটি প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষার ফল দেখে। সেখানে দেখলাম, নির্বাচন কমিশনকে মানুষ যতটা শ্রদ্ধা করত আগে, এখন আর ততটা করে না। যাঁরা ভাবেন, কমিশন একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়, তাঁদের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ন’শতাংশ। এক দিক থেকে দেখলে, অস্বস্তির কারণ নেই। ন’শতাংশ এমন কিছু বড় অনুপাত নয়। কিন্তু বৃদ্ধির হার যথেষ্ট উদ্বেগজনক। আগে দেখা গিয়েছে, ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার কমিশনের কাজের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন। এই অনুপাত নেমে এসেছে ২৮ শতাংশে। ভোটারদের ঘর থেকে বার করে পোলিং বুথে আনার জন্য সক্রিয় কমিশন। ভোটারদের সচেতন করার জন্য নানা চেষ্টা চলছে। কলকাতায় রংচঙে ট্রাম চলছে। কমিশনের ভাবমূর্তি উন্নত করতে না-পারলে কিন্তু কাজ হবে না। নির্বাচনের প্রথম দফাতে দেখা যায় ভোটারের সংখ্যা আশানুরূপ নয়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় তা আরও কমে যায়।
আর কী বলছে সমীক্ষা? ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার ভাবছেন, মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব— এ দুটোই হবে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু। আমাদের মতো যাঁরা মনে করেন, দুটোই সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য বিষয়, তাঁরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বসেছিলেন। দেখা যাচ্ছিল মন্দিরই হয়ে উঠছে প্রধান বিষয়। এখনও বহু ভোটার গুরুত্ব দিচ্ছেন মন্দিরকেই। কিন্তু যাঁরা মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্বকে গুরুত্ব দেন, তাঁদের সংখ্যাও বাড়ছে। ভোট এখনও অনেক দিন চলবে। জনমত তৈরি করার সময় এখনও আছে। দেখা যাক, কোন দল এই সময়টাকে কী ভাবে কাজে লাগায়।
যে বেসরকারি সংস্থা ওই সমীক্ষার কাজ করেছে, তারা নির্বাচন সংক্রান্ত গবেষণা করা। একই সঙ্গে সমীক্ষার কাজও করে তারা। ওই সংস্থা সমীক্ষার কাজে যুক্ত করে দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার অধ্যাপকদের। তাই এই সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বেশি। ওই সমীক্ষায় মতামত দিয়েছেন ১০,০১৯ জন। ১৯টি রাজ্যে ১০০টি লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রের ১০০টি বিধানসভা ক্ষেত্রে চারটি করে বুথে চালানো হয়েছে এই সমীক্ষা। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৬২ শতাংশ ভোটারের মতে চাকরি পাওয়া ক্রমাগত কঠিন হয়েছে। মাত্র ১২ শতাংশ মনে করেন যে, চাকরি পাওয়া সহজ হয়েছে। ৪৮ শতাংশ মনে করেন জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। ৩৫ শতাংশ বলেন, অবনতির কথা। ২২ শতাংশ ভোটার বলেন, তাঁরা পয়সা জমাতে পারছেন। ৩৬ শতাংশ বলেন, তাঁদের প্রয়োজন মিটছে, কিন্তু পয়সা জমানো যাচ্ছে না। ৫৫ শতাংশ মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। এ জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করেন ২৫ শতাংশ। রাজ্যকে দায়ী করেছেন ১৬ শতাংশ।
লেনিনের মতো সারণি তৈরি করে এই সমীক্ষক সংস্থা আমাদের জানাতে পারত, ওই ১০,০১৯ জনের বয়স এবং শিক্ষার বিন্যাস। এ-ও জানাতে পারত, বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে প্রশ্নের জবাবে কী পরিবর্তন দেখা যায়। তা হলে হিসাব করা যেত, কত দ্রুত আমরা পরলোকের চিন্তা ছেড়ে ইহলোকের দিকে নজর দিচ্ছি। শেখানো বুলি বিসর্জন দিয়ে, যুক্তি প্রয়োগ করে বুঝতে চেষ্টা করছি, সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলি ঠিক কী এবং কোন দল তার সমাধানে কী করতে চাইছে।
আমার মতে, ওই সমীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, ভারত দেশটা কি শুধু হিন্দুদের? না কি সব ধর্মের নাগরিকের দেশের উপর সমান অধিকার? জবাবে ৭৯ শতাংশ বলেন, ধর্ম যাঁর যাই হোক, দেশে সব নাগরিকের সমান অধিকার। ১১ শতাংশ বলেন, দেশ একমাত্র হিন্দুদের। ১০ শতাংশ এ বিষয়ে কোনও মতামত দেননি। যাঁরা মনে করেন সব নাগরিকের সমান অধিকার, শহরাঞ্চলে তাঁদের অনুপাত ৮৫ শতাংশ। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এই অনুপাত ৮৩ শতাংশ। তা ছাড়া ৫৬ বছরের বেশি বয়সিদের মধ্যে মাত্র ৭৩ শতাংশ এই কথা বলেছেন। কিন্তু ১৮ থেকে ২৫ বছরের যুবক-যুবতীদের ৮১ শতাংশের এই অভিমত। অর্থাৎ নতুন প্রজন্ম আসুক। শিক্ষার বিস্তার হোক। নগরায়ন হোক। তা হলেই হিন্দু-মুসলমানকে ধর্মের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করা প্রায় অসম্ভব। এই সমীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল, এ বারের নির্বাচনের ফলের অনুমান। সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কোনও বিশেষ পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না ওই সমীক্ষায়।
কিন্তু শিক্ষার বিস্তার কি আশানুরূপ হবে? এখনই কি কলেজে ৪০ শতাংশের মতো আসন খালি থাকছে না? আমার পড়াশোনা শেষ হলে একটা চাকরি তো চাই! শোনা যাচ্ছে আইআইটি-তে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক কোম্পানি আসছে না। এ কথা আগে শোনা যায়নি। আর নগরায়ন? ১০ বছর আগে শাসকদল ‘টার্গেট’ নিয়েছিল এ দেশে ১০০টি স্মার্ট সিটি তৈরি করার। সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলের বিতর্কসভায় সরকার পক্ষের এক ব্যক্তিকে বলা হয়, অন্তত একটা স্মার্ট সিটির নাম বলুন। তিনি কিন্তু বলতে পারেননি।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)