সরকারের পক্ষে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা অস্বাভাবিক নয়।
নরেন্দ্র মোদী যখন জার্মানিতে জি-৭ দেশগুলির নেতাদের সঙ্গে গণতন্ত্রকে আরও নমনীয় করার অঙ্গীকারে সই করছেন, সেই সময়েই দিল্লি পুলিশ গ্রেফতার করছে সাংবাদিক মহম্মদ জ়ুবেরকে— এই বৈপরীত্য কাকে না আঘাত করেছে? জ়ুবের ‘অল্ট নিউজ়’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, যে সংস্থা ভুয়ো খবর চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। তবু জ়ুবেরকে ভাগ্যবানই বলতে হবে, হেফাজতে যাওয়ার চব্বিশ দিনের মধ্যে তিনি জামিন পেয়ে গিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে সাংবাদিকের স্বাধীনতার সমর্থনও পেয়েছেন। অনেকেরই অতটা সৌভাগ্য হয়নি। সিদ্দিক কাপ্পানের বাইশ মাস কারাবাস পেরোল। গত ৪ অগস্ট ফের তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করেছে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের লখনউ বেঞ্চ। ভারতীয় ভাষায় যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, ক্ষমতার অলিন্দ যে তাঁদের নাগালের বাইরে, কাপ্পানের দীর্ঘ কারাবাস তারই ইঙ্গিত। কাপ্পান একটি মালয়ালম সংবাদ পোর্টালের সাংবাদিক। হাথরসে উনিশ বছরের একটি দলিত মেয়ের গণধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন ২০২০ সালের অক্টোবরে।
সংবাদের স্বাধীনতার নিরিখে ভারত ইতিমধ্যেই ১৮০টি দেশের মধ্যে পৌঁছেছে ১৫০তম স্থানে। কাউন্সিল ফর প্রোটেকশন অব জার্নালিস্টস বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির মধ্যে রেখেছে ভারতকে। ছ’জন সাংবাদিক দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছেন জেলে— আসিফ সুলতান, সিদ্দিক কাপ্পান, আনন্দ তেলতুম্বডে, গৌতম নওলাখা, মানান ডর, রাজীব শর্মা। কাপ্পানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ওস্কানো, ধর্মবিশ্বাসে আঘাত প্রভৃতি অভিযোগ এনেছে পুলিশ। কাপ্পানকে বন্দি রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যত জোরালো হয়েছে, তত কঠোর আইনি ধারা আরোপ করা হয়েছে তাঁর উপর। অথচ কাপ্পান হাথরস অবধি পৌঁছতেই পারেননি, ঘটনার উপর রিপোর্টও লেখেননি।
জ়ুবেরের জামিনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টই রায় দিয়েছে সাংবাদিক, বা সরকারের কোনও সমালোচকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবমাননার ধারা আনা যাবে না। যে সাংবাদিকদের ধরা হয়েছে, তাঁদের জামিন দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেও একক বিচারপতির বেঞ্চ পুলিশের অভিযোগকেই মান্যতা দিলেন। বিচারপতি কৃষণ পালের পর্যবেক্ষণ: কাপ্পানের “হাথরসে কোনও কাজ ছিল না।” তাঁর সহযাত্রীরা (যাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত) যে সাংবাদিক নন, এটা কাপ্পানের বিরুদ্ধে একটি ‘গুরুতর প্রমাণ’ বলে মনে করেছে আদালত। সাংবাদিকের কাজ সম্পর্কে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ মনোভাব মেলে এখানে। কেবল প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কে নয়, বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গেও যে সাংবাদিকের দূরত্ব, আস্থাহীনতা বাড়ছে, এ যেন তারই অংশ।
অথচ প্রধান বিচারপতি এনভি রমণা সম্প্রতি বলেছেন, “স্বাধীন সাংবাদিকতা হল গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড। সাংবাদিকরা মানুষের চোখ-কান। সংবাদ সংস্থাগুলির দায়িত্ব তথ্য সামনে আনা, বিশেষ করে ভারতের সামাজিক পরিস্থিতিতে।” সেই সঙ্গে সতর্ক করেছেন, মিডিয়াকে তার প্রভাব সৎ সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, ব্যবসায়িক স্বার্থ বাড়ানো চলবে না। মিডিয়ার নয়া প্রযুক্তি যে কোনও বার্তাকে বহুগুণ প্রসারিত করতে পারে, কিন্তু ঠিক-ভুল ভাল-মন্দ, সত্য আর ভ্রান্তির তফাত করতে পারে না।
আজকের প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থায় এমনই একটা অভিভাবকসুলভ মনোভাব দেখা যায়, বিশেষত মিডিয়ার প্রতি। সরকারের পক্ষে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এখন ভারতে মিডিয়াকে যে ভাবে সরকারের লেজুড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তথ্যের অধিকার আইনকে কোণঠাসা করা হচ্ছে, আরও বেশি করে বিষয়কে ‘জনসাধারণের জন্য নয়’ বলে দাবি করা হচ্ছে, তাতে তথ্য নিয়ে সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হয়।
নেহরুর সঙ্গে কার্টুনশিল্পী শংকরের বন্ধুত্ব ছিল, শংকর চার হাজারেরও বেশি কার্টুনে এঁকেছেন নেহরুকে, যার অনেকগুলি ছিল নির্মম ব্যঙ্গচিত্র। তবু তাঁদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট বোঝা যায় নেহরুর সেই বিখ্যাত উক্তি থেকে, “আমাকে রেহাই দেবেন না, শংকর।” তবু নেহরুর সরকারই সংবিধানের প্রথম সংশোধন করে ১৯৫১ সালে, যা বাক্স্বাধীনতাকে (১৯ নং ধারা) খর্ব করতে ঘোষণা করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার করা চলবে না। পাশ হওয়ার সত্তর বছর পরে এই সংশোধন ভারতের প্রশাসনের এক প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যদিও মোদী সরকার, এবং তার বশীভূত মিডিয়ার একাংশ, কেন্দ্রীয় সরকারকে মিডিয়ার ‘শিকার’ বলে দেখাতে চায়, তবু মিডিয়ার উপর মোদী সরকারের পীড়ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিরোধীদের বক্তব্য যে ভাবে দমন করা হচ্ছে, তা দেখে অন্যান্য রাষ্ট্র, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার সংস্থাগুলি সরকারের খোলাখুলি সমালোচনা করেছে। সম্প্রতি ‘টুইটার’ একটি রিপোর্টে বলেছে, সাংবাদিক, বা সংবাদ সংস্থার টুইট সরিয়ে দেওয়ার দাবি করে সবচেয়ে বেশি আইনি নোটিস এসেছে ভারত সরকারের থেকেই।
কেন্দ্র নিজের পক্ষে যে যুক্তিই দিক, বাক্স্বাধীনতা এবং সংবাদ-স্বাধীনতার জন্য যাঁরা লড়াই করছেন, রাজনীতি যে তাঁদের নিশানা করছে ও রাষ্ট্র মুখ ঘুরিয়ে থাকছে, এ সত্য আর চাপা থাকছে না।