কলকাতার দুর্গা পুজো।
এক নবমীর সন্ধ্যায় কলকাতা যখন ভেসে যাচ্ছে আলো আর জনজোয়ারে, আমাদের কানে তখন ঝিঁঝির ডাক আর গাছের পাতার সরসরানি। পাতলা সরের মতো চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে পায়ের পাতায়। মাঝ-অক্টোবরের উত্তর ছুঁয়ে নামা কনকনে হাওয়ায় গায়ে সাপটে নিচ্ছি সোয়েটার, জ্যাকেট। সিলারিগাঁওয়ের সেই হিরণ্ময় নীরবতা আর নিঝুম চরাচরের অংশী হয়ে কলকাতার পুজো-সন্ধ্যার কথা মনে করা এক অভিজ্ঞতা বইকি।
গত কয়েক বছর ধরেই প্রতি পুজোর আগে এক অদ্ভুত দ্বিধায় ভুগি— পুজোর কলকাতা, না কলকাতার বাইরে পুজো কাটানো। তবে, বেশির ভাগ পাল্লা ভারী পুজোর কলকাতার দিকেই থাকে। যাঁরা প্রতি পুজোয় নিয়ম করে কলকাতা ছেড়ে পালাতে চান, তাঁরাও কি রেলস্টেশন বা বিমানবন্দরে ঢোকার আগের প্যান্ডেলটির দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে এক কণা দুঃখ ভরে রাখেন না?
ছোটবেলায় পুজোর ক’টা দিন পার করে তবেই বেড়াতে যাওয়া হত। প্রথম সেই নিয়ম ভাঙে ঠাকুমার মারা যাওয়ার বছরে। ষষ্ঠীর উপোস থেকে দশমীর নাড়ু-নিমকি-ঘুগনিতে যে মানুষটার মাখামাখি উপস্থিতি ছিল, তাঁর শূন্যতা ভুলতে বাড়িসুদ্ধ সকলের ষষ্ঠীর সকালে উত্তর ভারত যাত্রা। প্রথম থামা হল আগরায়। হোটেলের ত্রিসীমানায় বাংলার উৎসবের ছোঁয়া নেই। নাছোড় বেয়াড়া মন তবুও খুঁজতে থাকে সপ্তমীর ঢাকের বাদ্যি, আলোর রোশনাই, বাঁশের কাঠামো। অবশেষে দেখা মেলে। শহরের এক ধারে বড় অবহেলায় দাঁড়িয়ে ছোট একখানি প্যান্ডেল। হলুদ-লাল কাপড়ের অতি সাধারণ সাজ। পুজোর উপচার নেই, পাটভাঙা শাড়ি পরে পুরোহিতকে ফল-ফুলের থালা এগিয়ে দেওয়া নেই, অতি-চেনা ধুনোর গন্ধটুকুও নেই। আসলে, কেউ কোথাও নেই। একলা ঠাকুর নিঃশব্দে অসুরবধ করছেন। দেবী দুর্গার মুখেও যেন বাংলার ঢলঢলে লাবণ্যটি অনুপস্থিত। বড় মন খারাপ হয়েছিল।
পুজোর ছুটিতে বাঙালি যে এমন তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে, তার সবটুকুই কি লম্বা ছুটির মায়া? বোধ হয় না। বর্ষাশেষে প্রায় গোটা দেশখানাই যেন বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে তকতকে হয়ে থাকে। আবহাওয়ার এমন মায়াবী টান উপেক্ষা করে সাধ্য কার? স্বয়ং পরশুরাম তাঁর কচি-সংসদ-এ লিখছেন, “বাংলার নদ-নদী, ঝোপ-ঝাড়, পল্লীকুটীরের ঘুঁটের সুমিষ্ট ধোঁয়া, পানাপুকুর হইতে উত্থিত জুঁই ফুলের গন্ধ— এসব অতি স্নিগ্ধ জিনিস। কিন্তু এই দারুণ শরৎকালে মন চায় ধরিত্রীর বুক বিদীর্ণ করিয়া সগর্জনে ছুটিয়া যাইতে।” আমাদের দাদু-ঠাকুমার ছোটবেলায় ওই পুজোর মাসেই সপরিবারে পশ্চিমে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সেখানে একটা গোটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা হত অন্তত দিন পনেরো। শীত পড়ার আগে পশ্চিমের চমৎকার আবহাওয়া আর হাট থেকে কেনা তাজা আনাজ, ডিম, ফলের কল্যাণে শরীর-স্বাস্থ্য সারিয়ে ধুলোমাখা মহানগরে ফেরা হত।
কিন্তু পুজো-আবহাওয়া যে সব সময় একই রকম খোশমেজাজে থাকবে, কে বলল? অক্টোবরের শেষে এক বার গেলাম ভাইজ়াগ-হায়দরাবাদ। যাওয়ার দিন দুই আগেই ঘূর্ণিঝড়ের লাল সঙ্কেত। অন্ধ্র উপকূলেই তার আসার কথা। ট্রেন বিশাখাপত্তনম পৌঁছনোর কিছু আগে থেকেই দামাল হাওয়ার ঝাপ্টা টের পাওয়া যাচ্ছিল। পর দিন বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আরাকু উপত্যকা। গোলমালটা হল ফেরার দিন। আরাকুর পাহাড়ি পথে নামার সময় বালতি উপুড় করা বৃষ্টির জলে আমরাই টলমল। সমতলে নেমেও শান্তি নেই। ঘূর্ণিঝড়ের লেজের ঝাপ্টায় ভাসছে ভাইজ়াগ। উড়ান, ট্রেন বাতিল, অনেক জায়গায় সেতুর উপর দিয়ে বইছে জল। আমাদের হায়দরাবাদ যাওয়া হল না।
যে বার ওড়িশায় সুপার সাইক্লোন হল, ১৯৯৯ সালে, তখন আমরা নেতারহাটের পথে। রাস্তায় বার দশেক ভাড়া গাড়ির ফুটো টায়ার সারিয়ে, মাওবাদী আতঙ্ক পেরিয়ে রাত আটটায় যখন থমথমে গন্তব্যে পৌঁছলাম, তখন ঝিরঝির বৃষ্টি, ঝুলের মতো ঘন কুয়াশা আর জঙ্গলে মোড়া নেতারহাট হরর ফিল্ম-এর সেট সেজে অপেক্ষা করছে। ঘরে ঢুকেই টিভি-তে চোখ। সুপার সাইক্লোনের আঘাতে তত ক্ষণে তছনছ পড়শি ওড়িশা। সে-ও ছিল এক পুজোর ছুটির মাস।
বাঙালি এখন সারা বছরই ঘোরে। ঘোর বর্ষায় দার্জিলিঙে ভেজে, জানুয়ারিতে কাশ্মীরে বরফ নিয়ে খেলে, এপ্রিল-মে’র পুরীতে এসি ঘরে বসে ঘামে। দু’টি বড় বেড়ানোর মাঝে ঢুকে পড়ে লং ড্রাইভ, উইকএন্ড ট্রিপরা। সারা বছর হিসেব কষে টাকা জমিয়ে রেলের টিকিট কাটা, হলিডে হোমে থেকে নিজেরাই রান্না করে কিছু পয়সা বাঁচিয়ে নেওয়ার দৃশ্য মুছেই গিয়েছে প্রায়। ট্রাঙ্ক, হোল্ডঅল বগলে পুরে স্টেশনে ছোটার গল্প বইয়ের পাতায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। অথচ কত কষ্ট, কত ত্যাগের বদলে ছাপোষা কেরানি পরিবারকে ওই ক’দিনের সুখটুকুকে কিনতে হত। সেও তো পুজোর বেড়ানোই। ওই সময়ই হাতে আসত বোনাস, টানাটানির সংসারে সেটুকু পরম প্রাপ্তি। সারা বছর যাঁদের হাঁড়ি, কড়া, খুন্তি আর কয়লার উনুনে আটকে পড়ে জীবন কাটত, ওই সময়টুকুতেই তাঁরা বছরভরের আনন্দটুকু শুষে নিতেন। কত অল্পতেই উথলে উঠত সুখের কড়াই।
সেই অল্পে সুখের দিন পেরিয়েছে। জল-বিদ্যুৎহীন গ্রামেও চলে এসেছে হোমস্টে-র সুবন্দোবস্ত। আজ হেলিকপ্টার নামে এক কালের ঘোর-দুর্গম তীর্থক্ষেত্রে। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে পুজোর ছুটিতে বেড়িয়ে আসার মাহাত্ম্য কমেনি একচুলও। কাশবনে দোলা লাগার ঢের আগে বাঙালি চোখ রাখে কম্পিউটার, মোবাইলের পর্দায়। তাঁদের সকলেই যে সুন্দর আবহাওয়া, বোনাস-যোগ, কিংবা লম্বা ছুটির হাতছানিতে সাড়া দেন, তা তো নয়। কেউ হয়তো কবেকারের স্মৃতিকে ছুঁয়ে দেখতে ঘর ছাড়েন, কেউ আবার স্মৃতির বোঝা ভুলতে।
পুজোর ছুটি কি জীবনস্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে দেওয়াও নয়?