হতাশ্বাস: অগ্নিপথ নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রেল অবরোধ, বিক্ষোভ, নৈরাজ্য। সেকেন্দ্রাবাদ, ১৭ জুন। রয়টার্স
দু’হাত মুঠো করে দু’দিকে ছড়িয়ে বীরদর্পে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “আমার সরকার স্থল, আকাশ, মহাকাশ— তিন ক্ষেত্রেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করার সাহস দেখিয়েছে।”
২০১৯-এর ২৮ মার্চ। সে দিন মিরাট থেকে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে লোকসভা নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ময়দানে নেমেই সেনা-র সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে বড়াই করে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। নির্বাচন কমিশন অবশ্য কোনও দোষ খুঁজে পায়নি। কমিশনের অন্দরে তা নিয়ে মতপার্থক্য হয়। সে অন্য কাহিনি। আসল কাহিনি হল, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক থেকে বালাকোট হানার হাতিয়ারে নরেন্দ্র মোদী ভোটে বাজিমাত করেছিলেন।
এই সেনার বীরত্বের দাপটে তার ঠিক এক মাস আগে ফাঁস হয়ে যাওয়া বেকারত্বের পরিসংখ্যানও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। সরকারি সমীক্ষাই জানিয়েছিল, কালো টাকা, দুর্নীতির উপরে নরেন্দ্র মোদীর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নোট বাতিলের ফলে আসলে বেকারত্বের হার তুঙ্গে উঠে ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছিল। লোকসভা ভোটের সেই রিপোর্ট মোদী সরকার প্রকাশ করতে চায়নি। লুকিয়ে রাখার পিছনে যুক্তি ছিল, ওতে গলদ রয়েছে। ভোট মিটে যাওয়ার পরে অবশ্য দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার নিশ্চিন্ত মনে সেই সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, ফাঁস হয়ে যাওয়া পরিসংখ্যানই সত্যি। নোট বাতিলের পরে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বাধিক। মোদী সরকারের শীর্ষব্যক্তি তথা বিজেপির শীর্ষনেতাদের তা নিয়ে তেমন বিচলিত হতে দেখা যায়নি। তাঁরা জানতেন, পাঁচ বছরের পরের ভোট আসতে আসতে মানুষ এই বেকারত্বের রেকর্ডের কথা ভুলে যাবেন।
সেনায় চার বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগের ‘অগ্নিপথ’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে এখন গোটা দেশ উত্তাল। ট্রেন পুড়ছে। চার বছর ধরে সেনার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া তরুণরা মাত্র চার বছর চাকরির সুযোগ মিলবে জেনে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। এ বারও বিজেপি নেতাদের তেমন বিচলিত হতে দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা জানেন, খুব বেশি সমস্যা হলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চেয়ে অগ্নিপথ প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেবেন। হয়তো কৃষি আইন প্রত্যাহারের মতোই বলবেন, তরুণদের অগ্নিপথের উপকারিতা বোঝাতে না পারাটাই তাঁর ব্যর্থতা। তিনি তরুণ প্রজন্মের প্রতি কতখানি সহানুভূতিশীল, বিজেপি প্রচার করতে পারবে। এ সবের মাঝে আসল বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যাবে। তা হল, বেকারত্বের সমস্যা। কারণ চাপের মুখে অগ্নিপথ প্রকল্প প্রত্যাহার হলেই যে বেকারত্বের সমস্যা মিটে যাবে, এমন নয়।
ভারতের রাজনীতির অনেক রহস্যের মধ্যে একটি হল, এ দেশে কোনও দিনই বেকারত্ব ভোটের দান উল্টে দেয় না। বেকারত্ব চরমে উঠেছে বলে এ দেশে কোনও সরকার পড়ে গিয়েছে, এমন হয়নি। তাঁর নোট বাতিলের ফলে বেকারত্ব চরমে উঠলেও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে মোদীকে বিপদে পড়তে হয়নি। ফের ক্ষমতায় এসেছেন। এখন সেনায় নিয়োগের নিয়ম বদলে যাওয়ায় ট্রেনে আগুন ধরানো হচ্ছে। মাস পাঁচেক আগে, জানুয়ারিতে রেলের চাকরির পরীক্ষার নিয়ম বদলে যাওয়ায় বিহার, উত্তরপ্রদেশের যুবকরা ট্রেনে আগুন ধরিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের ভোটে যোগী আদিত্যনাথের দ্বিতীয় বার জিতে আসতে সমস্যা হয়নি।
যাঁরা সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় থাকেন, তাঁরা সাধারণত বিক্ষোভ, মিছিলে যোগ দেন না। কারণ পুলিশের খাতায় এক বার নাম উঠে গেলে সরকারি চাকরি পেতে সমস্যা হয়। এমনিতেই সরকারি চাকরিতে সুযোগ কমছে দেখে রোজগারের সন্ধানে বার হওয়া তরুণদের সিংহভাগ পাকা চাকরির বদলে চুক্তিভিত্তিক কাজের সঙ্গেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তো নিয়মিতই চাকরির বদলে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার পরেও যখন সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা পুলিশের খাতায় নাম ওঠার তোয়াক্কা না করে ট্রেনে আগুন ধরাতে যান, তখন বোঝা যায়, কতখানি হতাশ ও আশাভঙ্গ হলে তরুণ প্রজন্ম এমন মরিয়া হয়ে ওঠে!
রাজনীতিকদের জন্য স্বস্তির কথা হল, বেকারদের এই হতাশার প্রতিফলন ভোটের বাক্সে পড়ে না। নেহরু বা ইন্দিরা গান্ধীর জমানার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মাত্র তিন শতাংশ হারের আর্থিক বৃদ্ধি বা ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ সত্ত্বেও নেহরু-ইন্দিরার জনপ্রিয়তা চোট খায়নি। যে হারে তরুণ-তরুণীরা নতুন চাকরির সন্ধানে বার হচ্ছেন, তার তুলনায় বেশি হারে চাকরির সুযোগ তৈরি না হলেই বেকারত্ব বাড়ে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় নতুন চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় দ্বিগুণ হারে চাকরির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবু বাজপেয়ীকে ২০০৪-এ হারতে হয়েছিল। আবার মনমোহন সরকারের প্রথম জমানায় চাকরির সংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল অনেক কম। তা-ও ২০০৯-এ মনমোহন সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে বরঞ্চ চাকরি বৃদ্ধির হার ছিল যথেষ্ট বেশি। বিশেষত ইউপিএ সরকারের শেষ বছরে চাকরি বৃদ্ধির হার বাজপেয়ী জমানার হারকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাতে ইউপিএ সরকারের পতন ঠেকানো যায়নি।
নোট বাতিলের পরে ছোট ছোট কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। কোভিড ঠেকাতে লকডাউনের ফলেও শহরের প্রায় অর্ধেক শ্রমিককে নিজেদের গ্রামে ফিরতে হয়েছিল। একশো দিনের কাজই ছিল একমাত্র ভরসা। লকডাউনের আগেই, নোট বাতিলের জেরে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছিল। বেকারত্বের সমস্যা বৃদ্ধি তারই ফল। কিন্তু বিজেপির নির্বাচনী জয়যাত্রায় কোনও বাধা পড়েনি। ২০১৪-তে তরুণ প্রজন্ম দু’হাত তুলে নরেন্দ্র মোদীকে সমর্থন করেছিলেন। ২৫ বছরের কমবয়সিদেরই বেকারত্বের সমস্যায় সব থেকে বেশি ভুগতে হয়। চাকরির অভাব বাড়ায় বিরোধী শিবিরের আশা ছিল, ২০১৯-এ মোদীর ভোটে ভাঙন ধরবে। উল্টে আরও বেশি আসনে জিতে তিনি দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কোনও ভোটের সময়ই তিনি কত চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, তা নিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে জবাবদিহি করতে হয়নি। বস্তুত কত চাকরি হয়েছে, তার কোনও হিসাবই তিনি দিতে পারেননি। সংসদে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এত যে রাস্তায় ওলা-উবর নামছে, এত ঋণ দেওয়া হচ্ছে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের তালিকায় এত নতুন নাম যখন যোগ হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই নতুন চাকরি হচ্ছে।
কেন বেকারত্বের সমস্যা, চাকরির অভাব নিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে ভোটে কোনও বিপাকে বা সমস্যায় পড়তে হয় না?
রাহুল গান্ধী অনুযোগ করে থাকেন, সংবাদমাধ্যম এ দিকে নজর দেয় না। কিন্তু বিরোধীরা যে বেকারত্বের সমস্যা নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে পেরেছেন, এমনও নয়। গত আট বছরে এমন বেশ কিছু আন্দোলন হয়েছে, যার মূল কারণ বেকারত্ব। এখন অগ্নিপথের বিরোধিতা বিহারের মতো সেই রাজ্যগুলিতেই বেশি, যেখানে বেকারত্বের হারও বেশি। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নিজের রাজ্য গুজরাতে পাঁচ বছর আগে পাটীদারদের আন্দোলনের মূল কারণও আসলে চাকরির অভাব। যার থেকে চাকরিতে পাটীদারদের জন্য সংরক্ষণের দাবি। মরাঠা সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলনের মূলেও সেই বেকারত্ব। কিন্তু শেষে গিয়ে তা জাতপাতের সমীকরণের বিতর্কে পরিণত হয়েছে। দেখেশুনে মনে হয়, নতুন কেউ সরকারে এলে চাকরির সুযোগ তৈরি হবে, এমন কোনও আশা নিয়ে মানুষ ভোট দিতেই যান না।
যে সেনার বীরত্ব নিয়ে তিনি ভোটের ময়দানে বড়াই করেছিলেন, সেই সেনাতে কেন চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ হবে, তা নিয়েও বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সাহস পান না। কারণ তাঁদের ভয়, ও সব বলতে গেলেই নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, সেনার অপমানের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলবেন। বিজেপি নেতৃত্ব তাই নিশ্চিত থাকতে পারেন। অগ্নিপথ-এর জন্য ২০২৪-এ তাঁদের বিপাকে পড়তে হবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।