বায়ুদূষণ।
নেভিল কার্ডাস এ যুগে কলকাতায় জন্ম নিলে নিশ্চয়ই লিখতেন না যে, স্কোরবোর্ড নিতান্তই একটি গাধা! অন্তত কলকাতার বায়ুদূষণের স্কোরকার্ড সামনে থাকলে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, বিশ্ব জুড়ে ১০০টির উপর জনবহুল শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের নিরিখে বেজিং, ঢাকা, করাচিকে পিছনে ফেলে কলকাতা রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে; দিল্লির ঠিক পরেই।
বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক দূষক পিএম ২.৫, অর্থাৎ আড়াই মাইক্রন বা তার চেয়ে ছোট আয়তনের ধূলিকণা, যা আমাদের ফুসফুসের অন্তঃস্থল অবধি অবাধে পৌঁছতে পারে এবং সাধারণ সর্দিকাশি, হাঁপানি থেকে শুরু করে ক্যানসার অবধি ঘটাতে পারে। ফলে এ তথ্যে আশ্চর্য লাগে না যে, গত এক দশকে কলকাতায় এই দূষকের কারণে এক লক্ষ পঁচাশি হাজারের বেশি মানুষ অকালে মারা গিয়েছেন; অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় দু’জন। এই মাপকাঠিতে জনবহুল শহরগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে কলকাতা— দিল্লি ও দুই চিনা শহর শাংহাই ও বেজিঙের পরেই। অসুস্থতার হিসাব ধরলে সংখ্যা অবলীলায় লক্ষ ছাড়িয়ে কোটিতে পৌঁছবে। এই বিশ্লেষণের ভিত্তি সরকারি তথ্য, ফলে এগুলিকে অস্বীকারের উপায় নেই। প্রশ্ন হল, এত বড় একটি জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও, সরকার বা সমাজ কী করছে? কিছু পরিবেশকর্মী ও চিকিৎসক বাদে কেউই তেমন বিচলিত বলে মনে হয় না।
২০১৯ সালের সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে তৈরি সাম্প্রতিক রিপোর্টটি জানাচ্ছে যে, ওই বছর কলকাতায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫-এর গড় পরিমাণ ছিল ৮৪ মাইক্রোগ্রাম; ১১০ মাইক্রোগ্রাম নিয়ে সবার উপরে ছিল দিল্লি। ভারতে এই দূষকের অনুমোদিত সীমা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৪০ মাইক্রোগ্রাম; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে তা ৫ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ, কলকাতায় পিএম ২.৫ দূষণের গড় মাত্রা দেশের অনুমোদিত সীমার দ্বিগুণের বেশি, ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার প্রায় ১৭ গুণ ছিল। গত প্রায় দু’দশক ধরেই কলকাতায় বায়ুদূষণের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি, ও সাধারণ ভাবে অনুমোদিত দূষণসীমার দেড় থেকে দ্বিগুণের মধ্যে থেকেছে, বা তারও বেশি।
আক্ষরিক অর্থেই মারাত্মক এই পরিস্থিতি সামলাতে কী ব্যবস্থা করা হয়েছে বা হচ্ছে? কলকাতা হাই কোর্ট ও ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়, বস্তুত ২০০৮ সাল থেকেই, নানা নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, শহর থেকে ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি— বিশেষত বাণিজ্যিক গাড়ি— বাতিল করার নির্দেশ। এই নির্দেশের বয়স ১৪ বছর পেরোলেও তার এখনও বনবাস পর্ব শেষ হয়নি; নির্দেশের প্রয়োগ বাস্তবে যে বেশ কম, তা আদালতেই প্রমাণিত। সম্প্রতি ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল আবার ১৫ বছরের পুরনো যাবতীয় বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত গাড়ি ছ’মাসের মধ্যে বাতিলের রায় দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেছে সরকার। এটা মানতেই হবে যে, রাজ্যে ২০১১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও দূষণের ছবিটি পাল্টায়নি। বাম জমানায় যে ভাবে বায়ুদূষণের মতো বিষয়গুলির জন্য বরাদ্দ ছিল শুধু অবজ্ঞা, তৃণমূল জমানায় যেন প্রায় তারই প্রতিচ্ছবি।
যদিও ইতিমধ্যে পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই অস্তিত্বের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। আরও আশ্চর্যের সমাপতন হল, দুই জমানাতেই বিপক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলিও এ বিষয়ে চুপ। অন্য যাবতীয় বিষয়ে সরকারের অজস্র সমালোচনা করলেও, দূষণে দেশের মধ্যে কলকাতার দ্বিতীয় সেরা হওয়ার খবর নিয়ে বিরোধীরা কেউ রা কাড়েননি! স্রেফ অজ্ঞানতা? না। আসলে ভোটে জেতা থেকে মিছিলে ভিড় তৈরি, হরেক কারণে সমাজের যে অংশটির উপর রাজনৈতিক দলগুলি প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল, তাদের অনেকগুলিই বায়ুদূষণের জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী। দূষিত বাণিজ্যিক গাড়ি থেকে কাটা তেলে চলা অটো, নিয়মভাঙা নির্মাণকার্য থেকে যত্রতত্র আবর্জনা পোড়ানো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই দূষণে প্রশ্রয় দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলির কাছে লাভজনক। রাজনৈতিক স্বার্থ থাকলে তবেই বিরোধী দলগুলি পরিবেশের প্রশ্নে সরব হয়। নয়াচর থেকে ডেউচা পাঁচামি, উদাহরণ প্রচুর।
দূষণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি কতখানি দায়ী, সে প্রশ্নের জবাবও খুব স্পষ্ট নয়— তিনটি বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে এ বিষয়ে তিন রকম উত্তর মিলেছে। ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়রিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে দিয়ে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে রিপোর্ট তৈরি করিয়েছে, তাতে পিএম ২.৫ বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে গাড়ির ভূমিকা খানিকটা পিছনে চলে গেলেও অন্য রিপোর্টগুলিতে যত্রতত্র জঞ্জাল পোড়ানো এবং নির্মাণকার্যের পাশাপাশি গাড়ির দূষণের দিকেই প্রধানত আঙুল উঠছে।
কিন্তু, সরকার এখনও অবধি ধুলো সামলাতে জল ছিটানো এবং রাস্তার ধারের দোকানদারদের কয়লার পরিবর্তে গ্যাস ব্যবহারের জন্য সাহায্য করার মতো লোকদেখানো কাজের মধ্যেই আটকে রয়েছে। শহরে বিদ্যুৎচালিত যানবাহন, অর্থাৎ ই-ভেহিকল প্রচলনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও এখনও তা প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য; বরং শহরের আদি বৈদ্যুতিক পরিবহণ ট্রামকে ক্রমেই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনার পাহাড়ে আগুন লাগানো নিয়মিত ঘটনা; যেমন নিয়মিত নির্মাণসামগ্রী রাস্তা জুড়ে খোলা অবস্থায় যত্রতত্র পড়ে থাকা। প্রসঙ্গত, কলকাতা পুরসভা ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম ও পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের আওতায় গত তিন বছরে বায়ুদূষণ কমানোর জন্যে প্রায় ৫৩৫ কোটি টাকা পেলেও তা যে কতটা প্রকৃত কাজে লাগানো হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আশঙ্কা যে, ২০২৪ সালের মধ্যে বায়ুদূষণ কমানোর নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো কঠিন।
যাঁরা নিজেদের কোনও দোষ না থাকা সত্ত্বেও মারণ বায়ুদূষণে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, আমার আপনার পরিবার যে প্রিয়জনদের হারাচ্ছে; তাঁদের দায়িত্ব কে নেবে, ক্ষতিপূরণই বা কী? দূষণের কারণে মৃত্যুমিছিল থামাতে কবে সরকার এগিয়ে আসবে? আর কত জনের মৃত্যু হলে বৃহত্তর সমাজ এই বিষয়ে সরব হবে? না কি মারণদূষণে নিয়মিত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাওয়াটাই ভবিতব্য বলে আমরা ধরে নিয়েছি?