‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’ সিরিজ়ে দীপঙ্কর সান্যাল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
‘খবর বিষয়টা খুব বোরিং। একঘেয়ে। আমি খবর নয়, কাহিনি তৈরি করি। খবরটা গুছিয়ে রান্না করে কাহিনি বানাই। তার পরে পরিবেশন করি।’
দীপঙ্কর সান্যালের সংলাপ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ঠিকই তো! ‘খবর’ নয়। ‘কাহিনি’। ‘স্টোরি’।
সিরিজ়ের নাম ‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’। প্রথম সিজ়ন এসেছিল ২০২২ সালে। গত মে মাসে দ্বিতীয় সিজ়ন এসেছে। প্রথম সিজ়নটা কেন কে জানে মিস্ করে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় সিজ়নের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ার পরে খোঁজ-খোঁজ! জ়ি ফাইভে পেয়ে টানা দেখেও ফেললাম। খাতা-কলম নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করতে বসলে খুচখাচ কিছু খুঁত যে বার করা যায় না, তা নয়। কিন্তু ‘দ্য ব্রোকেন নিউজ় পেশাদার সাংবাদিককে এক ধাক্কা মেরে সটান নিউজ় রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। সাংবাদিক-সম্পাদকের জীবনের উত্থান-পতন, বসের ঝাড় বা পিঠ চাপড়ানি, কিছু চেনা দুঃখ, কিছু চেনা সুখ, কিছু চেনা অন্ধকার, কিছু চেনা আলো, সিনিয়রদের মাতব্বরি, অফিসের ছোট ছোট কিউবিক্লে জন্ম-নেওয়া ছোট ছোট রাজনীতি, স্বজনপোষণ, পছন্দের লোকদের নিয়ে ঘুটুবাজি, অফিসের বহির্বিশ্বের ক্ষমতা-অলিন্দে শক্তিধরের স্যাটেলাইট হিসেবে সতত বিচরণ করতে করতে নিজেকেও সত্যিকারের ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করা এবং তার পর একদিন ধপাস করে পড়ে যাওয়া, বুক ধুকপুক করলেও হুমকি-হুঁশিয়ারির সামনে কলার তুলে পাল্টা স্মার্টগিরি দেখিয়ে আসা— ‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’ পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে খবরের কারবারিদের দুনিয়ার অন্ধকার তলপেটের একটার পর একটা পরত খুলেছে।
‘আমরা কি এখানে মসালা মুভি বানাতে বসেছি? আমাদের কাজ সত্যিটা বলা। উই আর ইন দ্য বিজ়নেস অফ ডেলিভারিং ফেয়ার অ্যান্ড আনবায়াস্ড নিউজ় টু দ্য পাবলিক। আমাদের কাজ জনতাকে পক্ষপাতশূন্য খবরটা দেওয়া। জনতা যদিও খবর নয়, তামাশা চায়! কিন্তু আমরা তামাশা দেব না। আমরা খবরই দেব।’
‘তোমার সঙ্গে কী কী অন্যায়-অবিচার হয়েছে, সেটা ভেবে কখনও সাংবাদিকতা কোরো না। বরং এটা ভেবে কোরো যে, তুমি কি সব কিছু ঠিক করে দেবে ভেবে সাংবাদিকতায় এসেছিলে?’
আমিনা কুরেশির সংলাপ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ তো সেই চিরন্তন দ্বন্দ্ব। মান এবং অপ-মানের যুদ্ধ। সাংবাদিকতার ব্যাকরণ মেনে চলব? না কি জনতা যা খেতে চায়, তা-ই দেব? খবরের পিছনে ছুটব? না কি অমুকে আমায় পাত্তা দেয়নি বা তমুকে আমার ফোন ধরেনি অথবা তুসুকে আমার সঙ্গে পেশাদারি শত্রুতা দেখিয়েছে বলে সুযোগ পেলেই তাদের গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করব? নম্বরের তাগিদে বেড়ে খেলব? না কি যা তথ্য রয়েছে, তার ভিত্তিতে খবর করার চেষ্টা করব? ‘খবর’ দেব? না ‘কাহিনি’? বিশেষত যখন সংস্থা লোকসানে চলছে এবং মালিক বলছে, হয় ব্যবসা গোটাতে হবে, নয় লোক ছাঁটতে হবে! তখনও কি সৎ এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধ্বজা উড্ডীন রাখব?
২০১৮ সালে ‘প্রেস’ নামের ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ়ের ভারতীয় ‘রিমেক’ই হল ‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’। ‘প্রেস’-এর উপজীব্য ছিল দু’টি বিলিতি কাগজের রেষারেষি এবং তার সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদেরও জড়িয়ে পড়া। ছ’টি এপিসোড সম্বলিত সেই সিরিজ় এতটাই বিতর্ক তৈরি করেছিল যে, দ্বিতীয় সিজ়ন আর দিনের আলো দেখেনি। ঘটনাচক্রে, ইংরেজি সিরিজ়ের সেই প্রযোজনা সংস্থাই হিন্দি সিরিজ়েরও প্রযোজনা করেছে। ইংরেজির মতো হিন্দি নির্মাণেও জড়িত রয়েছেন মূল ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ়ের নির্মাতা মাইক বার্টলেট।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কী প্রায়-নিখুঁত গবেষণা করেছেন নির্মাতারা! খবরের কারবারিদের গল্প শেষ পর্যন্ত যে একটি ক্রাইম থ্রিলারে পর্যবসিত হল, সেটা সম্ভবত সিরিজ়ের টান টান নাটকীয়তা তৈরি এবং বজায় রাখার খাতিরে। কিন্তু নির্মাতারা সার সত্যটি বুঝেছেন— এই পেশা ভিতর থেকে সমস্ত সুকুমার বৃত্তি শুষে নেয়। সবচেয়ে আগে শুষে নেয় ‘এমপ্যাথি’। সহমর্মিতা। আমাদের ভিতরে যে প্রশংসা করার, ভাল লাগার, কারও কাজ দেখে ভাল লাগার প্রবণতা সাধারণত থাকে, তাকে তো বটেই, এমনকি, প্রকাশ্যে তো দূরস্থান, মনে মনেও কারও প্রশংসা করার এমপ্যাথিটুকু গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। নইলে কি আর অগ্রজ সাংবাদিক শিক্ষা দেওয়ার ঢঙে বলেন, ‘‘সব সময়ে নোংরাটা দেখবে। ১০টার মধ্যে ১০টাই নোংরা দেখার চেষ্টা করবে। তাতে শেষ পর্যন্ত দেখবে, আটটাই নোংরা ছিল।’’ শিক্ষানবিশ প্রশ্ন করেছিল, বাকি দুটো? নির্লিপ্ত এবং নির্বিকার জবাব এসেছিল, ‘‘ওহ্, ওগুলো কোল্যাটেরাল ড্যামেজ।’’ সমান্তরাল ক্ষতি।
‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’ সিরিজ়ের ‘কাহিনি’ সাংবাদিক-সম্পাদকদের রেষারেষির। পেশাগত আকচাআকচির। কচ্ছপ আর খরগোশের চিরন্তন দৌড়ের। যে কাহিনি সেই গোল্লাছুটের দুনিয়ায় একে অপরকে জমি ধরানোর এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বড় করে দেখানোর অন্তহীন প্রয়াসের। নিরন্তর সেল্ফ প্রমোশনের। আত্মপ্রেমের হদ্দমুদ্দ সেই স্বসৃষ্ট দুনিয়া, যেখানে মূল চরিত্র অহরহ নিজেকে বলতে থাকে, আসল ব্র্যান্ড আমি। আমিই।
যখন দীপঙ্করের চরিত্র সম্পাদকীয় বৈঠকে সহকর্মীদের দাবড়ে বলে, ‘‘আমাদের ক্ষমতা আছে! অর্থ আছে! যোগাযোগ আছে! সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের আমি আছি— দীপঙ্কর সান্যাল!’’ বলে, ‘‘দীপঙ্কর সান্যাল যখন বলে, তখন সারা দেশ শোনে!’’ তখন তার মধ্যে প্রতিষ্ঠানকে পাপোশের মতো ব্যবহার করার দম্ভ, আত্মম্ভরিতা আর বহ্বাস্ফোট শুনি। চারপাশে তাকালে উদাহরণও যে মনে পড়ে না, তা-ও নয়। যখন বলে, ‘‘দীপঙ্কর সান্যাল কখনও মাফ চায় না। অন ক্যামেরা নয়। অফ ক্যামেরাও নয়।’’ তখনও তার মধ্যে কোথাও বাস্তবের প্রতিধ্বনি শুনি। যখন সেই চরিত্র বলে, ‘‘হোয়াই অ্যাম আই মেকিং দ্য নিউজ়? ফর টিআরপি!’’ খবর কেন বানাচ্ছি? টিআরপি’র জন্য। তখন মনে হয়, দীপঙ্কর তার নিজের অফিসের দেওয়ালে ঝোলানো লাইনটাই ভুলে গিয়েছে, ‘হোয়েন ইউ স্পিক ফর দ্য পিপ্ল, দ্য নাম্বার্স স্পিক ফর দেমসেল্ভস’। যখন তুমি জনতার কথা বলবে, তখন নম্বরও কথা বলবে।
যখন মার্কেটিং হেড এসে বলে, তার শোয়ে বিরোধী দলনেতাকে ডাকা উচিত হবে না, কারণ লোকটা তাদের চ্যানেলকে প্রকাশ্যে গাল দিচ্ছে, তখন দীপঙ্কর চেয়ারে বসেই সামান্য বাঁয়ে ঝুঁকে একটা ভিজ়িটিং কার্ড বার করে টেবিলের ও পার থেকে দু’আঙুলে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘‘পড়ো! কী লেখা আছে?’’
খানিক বিহ্বল কিন্তু ওপরচালাক চরিত্রটি জোরে জোরে রিডিং পড়ে, ‘‘দীপঙ্কর সান্যাল, এডিটর-ইন-চিফ।’’
সামনে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপর দু’কনুইয়ে ভর দিয়ে ভরাট গলায় দীপঙ্কর বলে, ‘‘পড়েছ? তা হলে শোনো, আমার শোয়ে আমি বিরোধী দলনেতাকে ডাকব না পাগলা কুকুরকে, সেটা আমি বুঝে নেব! তোমার কাজ অপারেশন্স দেখা। সেটা ভাল করে দ্যাখো। আর যাওয়ার সময় একটা আইস্ড কফি পাঠিয়ে দিয়ো। চিনি-ছাড়া।’’ তখন মনে হয়, আরে! এই তো মস্তান।
আবার যখন আমিনার চরিত্র বলে, ‘‘টিআরপি-র জন্য সত্যি আর মিথ্যেকে এমন ভাবে সাজিয়ে দাও, যাতে দুটোর ফারাক দর্শকের নজরে না-পড়ে? এটাই করতে হবে? তাই তো? আরে একটা কোনও চ্যানেল তো থাকবে, যারা সত্যিটা বলবে!’’ মনে হয়, এই তো! যখন বলে, ‘‘রিপোর্টার্স বিলিভ ওনলি ইন ফ্যাক্টস। গেট দ্য ব্লাডি ফ্যাক্টস! নট ইয়োর ফিলিংস!’’ তখন মনে হয়, এই-ই তো!
যখন দীপঙ্কর তার প্রতিটি শোয়ের শেষে চ্যানেলের অমোঘ ট্যাগলাইন উচ্চারণ করে ‘কিঁউ কি সওয়াল হ্যায় দেশ কা’, তখন তার মধ্যে হালফিলের বিখ্যাত নিউজ় অ্যাঙ্করের কণ্ঠ অবিকল শুনতে পাই। মনে হয়, চিত্রনাট্যের দীপঙ্করের মতোই তিনি ‘বিখ্যাত’ বটে। কিন্তু ‘সফল’ কি? সফল হওয়াটা তো একটা প্রক্রিয়া। আর বিখ্যাত হওয়া একটা ইভেন্ট। প্রথমটা চলতে থাকে। যে কোনও প্রক্রিয়ার মতো। দ্বিতীয়টা শেষ হয়ে যায়। যে কোনও ইভেন্টের মতো। কখনও দ্রুত। কখনও ধীরে। কিন্তু শেষ হয়। খ্যাতির আলোর আয়ু চিরস্থায়ী নয়। কালের নিয়মে সেই আলো নিভে যায়।
‘দ্য ব্রোকেন নিউজ়’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আলো তোমার নয়। আলোটা অন্য কারও। তার উৎস অন্য। তোমার কাজ হল প্রিজ়মের মতো সঠিক জায়গায় দাঁড়ানো। যাতে খবরের আলোটা তোমার উপর পড়ে। তা হলেই সেটা বিচ্ছুরিত হয়ে রামধনু তৈরি হবে। কাহিনির রামধনু। তাতে তোমার নিজের চোখেই ঝিলমিল লেগে যাবে। কিন্তু ওই রামধনুটাও তোমার নয়। তুমি শুধু একটা মাধ্যম। একটা সাফসুতরো প্রিজ়মের মতো।
‘খবর’ না ‘কাহিনি’? ‘মান’ না ‘অপ-মান’? এই দ্বন্দ্বমূলক সংবাদ-বাদের দুনিয়ায় ওই প্রিজ়মটাই শাশ্বত। চিরন্তন।