ছবি: সংগৃহীত
চলছে প্রেমের মাস। আকাশ-বাতাসের মাদকতা সেই প্রেমকে আরও মদিরাসক্ত করেছে। সরস্বতী পুজো থেকে শুরু হয়েছি বাঙালির প্রেমপর্ব। সেই পর্ব চলছে ইংরেজি ভ্যালেন্টাইন্স সপ্তাহ পর্যন্ত। শুধু স্কুলকলেজের চৌহদ্দিতেই আটকে নেই প্রেম। রঙ্গমঞ্চেও সমান ভাবে জাঁকিয়ে বসেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ দিনাজপুরে আয়োজিত নাট্য উৎসবে এই প্রেমের উপাখ্যান নিয়েই মঞ্চস্থ হল গ্রিক ট্র্যাজেডির বাংলা রূপ ‘হিপোলিটাস’। প্রেমের নানান ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে মঞ্চস্থ হওয়া এই নাটকে এই সময়ের নারী-পুরুষের সম্পর্কের বাস্তবিক প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু সম্পর্কই নয়, বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্রকেও তুলে ধরেছে এই নাটক।
জিশুর জন্মের প্রায় ৪২৮ বছর আগের ঘটনা আজও যে সমান প্রাসঙ্গিক, তা এই নাটকের মুখ্য চরিত্র হিপোলিটাসের জীবনই প্রমাণ করে। হিপোলিটাসের জন্মবৃত্তান্তের মতো তার জীবনের প্রেমের সম্পর্কও অত্যন্ত জটিল। যা বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষ, প্রেমিক-প্রেমিকার জটিল সম্পর্কে উপস্থাপন করছে। কী হয়েছিল হিপোলিটাসের জীবনে? এথেন্সের রাজা থিসিয়াসের অবৈধ সম্পর্কের জেরে জন্ম হয়েছিল হিপোলিটাসের। সেই অর্থে রাজা থিসিয়াসের জারজ সন্তান হিপোলিটাস। সৌম্যকান্তি, সাহসী, আদর্শবান যুবক। তাঁকে সবাই প্রার্থনা করেন। গ্রিক দেবতা জিয়াসের দুই কন্যা আফ্রোদিতে ও আর্তেমিস। আফ্রোদিতে প্রেমের দেবী। দেহজ ভালবাসার প্রতিরূপ। তাঁর কাছে প্রেম মানেই শরীর, শারীরিক সম্পর্ক যেখানে মুখ্য। অন্যদিকে আর্তেমিস প্লেটনিক প্রেমের দেবী। যিনি প্রেমকে কামের সঙ্গে মেশান না। তাঁর কাছে প্রেম মানে দু’টি মনের, হৃদয়ের আত্মার আত্তীকরণ। তাঁর কাছে কাম মুখ্য নয়। আফ্রোদিতে ভালবাসে হিপোলিটাসকে। কিন্তু হিপোলিটাস পুজো করেন আর্তেমিসকে। এইভাবেই ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়।
আফ্রোদিতের প্রেমকে প্রত্যাখান করায় ক্ষুব্ধ আফ্রোদিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। হিপোলিটাসকে শাস্তি দিতে তাই কূট চাল চালেন আফ্রোদিতে। রাজা থিসিয়াস পাশের একটি রাজ্য জয় করলে সেই পরাজিত রাজা থিসিয়াসকে তাঁর অপরূপ সুন্দরী রানি ফেড্রাকে উপঢৌকন দিয়ে মুক্তি পান। আফ্রোদিতে জানতেন, রানি ফেড্রা হিপোলিটাসকে পছন্দ করেন। তাই আফ্রোদিতে নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পরিকল্পনা করে ফেড্রাকে উৎসাহ দেন হিপোলিটাসের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে। আফ্রোদিতের ফাঁদে পড়ে ফেড্রা তাঁর সৎ ছেলে হিপোলিটাসকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু মায়ের সেই প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় হিপোলিটাস। ছেলের কাছে প্রত্যাখাত হয়ে হিপোলিটাসকে রানি শপথ করান, যাতে তাঁদের এই কথোপকথন তাঁর বাবা জানতে না পারেন। হিপোলিটাস সেই শপথ করেন। তারপরে অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে জর্জরিত রানি ফেড্রা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে আফ্রোদিতে লিখে যান— ‘আমার পুত্র আমার বিছানা কলঙ্কিত করেছে’। রাজা থিসিয়াস সেই চিঠি পড়ে হিপোলিটাসকে নির্বাসনে পাঠান। কিন্তু নির্বাসনে পাঠালেও হিপোলিটাস সৎমায়ের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভেঙে সত্যি ঘটনা বলেননি। এমনকি, আর্তেমিস সত্যি ঘটনা বলার জন্য হিপোলিটাসকে অনুরোধ করলেও তাতে সায় না দিয়ে হিপোলিটাস বলেন, ‘বিপদ গ্রাহ্য, কিন্তু শপথ ভাঙার মতো গর্হিত অপরাধ করতে পারব না।’ এই ভাবেই নির্দোষ হিপোলিটাস মায়ের সম্মান রক্ষার্থে জীবন বলি দেন।
এই ভাবেই নাটকে হিপোলিটাসের জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাত উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে কেন এই নাটক এত প্রাসঙ্গিক? নাটকের নির্দেশক তথা হিপোলিটাসের চরিত্রে অভিনয় করা সুরজিৎ ঘোষের কথায়, ‘‘এই যুগে সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়। এখন অধিকাংশ মানুষের কাছেই সম্পর্কের কোনও গুরুত্ব নেই। নিজের নিজের স্বার্থে আঘাত এলেই সেই সম্পর্ক নষ্ট করে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশই। এখন পবিত্র ভালবাসার স্থান নেই, মর্যাদা নেই। তাই যাঁরা সত্যিকারের ভালবাসতে যান, তাঁরাই প্রতারিত হন। দুঃখই তাঁদের প্রাপ্য হয়। বাস্তবের এই বিষয়টিই এই নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। আর এটাই নাটকের প্রাসঙ্গিকতা।’’
এই অতি-আধুনিক যুগে টেকনোলজির যেমন উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছেন মূল্যবোধ ততটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনকার সমাজের অধিকাংশ মানুষই স্বার্থলোভী। নিজের স্বার্থ মেটাতে অন্যকে নির্বাসনে পাঠাতেও পিছপা হয় না। তাই অধিকাংশ প্রেমই পূর্ণতা পায় না। অঙ্কুরেই নষ্ট হয়। ভালবাসা হৃদয় থেকে নয়, শরীরসর্বস্ব হয়ে পড়ছে। শরীর ক্ষণস্থায়ী, তাই এখনকার প্রেমও ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু মনের কোনও বয়স নেই। সমাজের এই দিককেই প্রতিফলিত করছে আফ্রোদিতে। আফ্রোদিতের দেহজ ভালোবাসা বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটকে উপস্থাপিত করছে। পাশাপাশি সমাজে যে অবৈধ সম্পর্ক উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, তারই প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ফেড্রা, যিনি নিজের সৎ ছেলেকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। তবে কি বর্তমান যুগে প্রকৃত ভালবাসার স্থান নেই? যেখানে প্রেম নিছক কামের উপরে উঠে দু’টি মনের মিলনকে বড় করে দেখাবে? নিশ্চয় আছে। সেই প্রেমেরই প্রতীক হিপোলিটাস। যিনি শত প্রলোভনেও না গিয়েছেন আফ্রোদিতের কাছে, না দিয়েছেন সৎ মায়ের প্রস্তাবে সাড়া। ভালবাসার পূজারি হিপোলিটাসকে তাই দিনের শেষে সুখ নয়, দুঃখকেই বরণ করে নিতে হয়েছে। হিপোলিটাসের এই চারিত্রিক গুণ, যিনি কখনওই আর্দশবিচ্যুত হননি, নিজের জন্মের সঙ্গে অন্য কাহিনি জড়িত থাকলেও যিনি নিজে কখনওই ব্যভিচারের পথে যাননি। এমন চরিত্র এই যুগে আমাদের সমাজের আদর্শহীনতা এবং সামাজিক ব্যভিচারকে চ্যালঞ্জ ছুড়ে দেয়।
নাটকের এই বিষয়ই বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপনা করেছে। সেই সঙ্গে আফ্রোদিতে ও আর্তেমিসের মতো দু’টি চরিত্রে অভিনয় করা সানিয়া প্রসাদ, ফেড্রার চরিত্রে পারমিতা চক্রবর্তী, থিসিয়াসের চরিত্রে প্রসেনজিৎ ঘোষ এবং মূল চরিত্র হিপোলিটাসের চরিত্রে সুরজিতের অভিনয় বিষয়বস্তুকে আরও বাস্তবোচিত করেছে। নাটকের মঞ্চ করেছে দিনাজপুর কৃষ্টি, আলো দিয়েছেন সৌমেন চক্রবর্তী, সঙ্গীত দিয়েছেন তামসরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নৃত্য ও নির্দেশনা করেছেন সুরজিৎ ঘোষ।
এ নাটকের শেষ দৃশ্যে সমস্ত কলঙ্কের অভিযোগ নিয়ে হিপোলিটাস যখন পিতার নির্দেশে রাজ্য ছেড়ে নির্বাসনে যাচ্ছেন, তখন রাজদূত হিমন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলছেন— ‘পূতচরিত্রের হিপোলিটাস যুগ যুগ ধরে তোমরা দেবতাদের কামনা ও বাসনার শিকার। জয় তোমাদের ভাগ্যে নেই।’ যা সমানভাবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও তুলে ধরেছে, যেখানে দেবতা হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা এবং প্রত্যেক সাধারণ মানুষ হচ্ছেন এক একজন হিপোলিটাস। যাঁরা প্রতিনিয়ত জীবনের জটিলতার পাঁকে পড়ে পরাজিত হচ্ছেন হতভাগ্য হিপোলিটাসের মতোই। এখানেই এই নাটক বাস্তবকে ছুঁয়ে গিয়েছে।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)