যত্রতত্র ছড়িয়ে খাবারের থালা-গ্লাস। ছবি: লেখক
পরিবেশ শব্দটির সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের বিষয়টিও আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই মূহূর্তে পরিবেশ দূষণ নিয়ে চিন্তিত সবাই। এই ভয়ঙ্কর দূষণ আমাদের প্রতিদিন ভাবাচ্ছে। ঠিক এই সময়ে একদিকে দূষণ অন্যদিকে জলসঙ্কট নিয়ে চিন্তিত আমরা। এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার নানা পন্থার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আরও বেশি করে গাছ লাগানোর কথা। বলা হচ্ছে জল অপচয় না করার কথা। প্লাস্টিক, থার্মোকোলের অত্যধিক ব্যবহারও দূষণের কারণ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্লাস্টিক এবং থার্মোকোল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা বা সতর্কতা জারি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কার্যক্ষেত্রে তা কতখানি মান্য হচ্ছে? আসলে আইন করা হচ্ছে কিন্তু আইন মান্য করার কড়াকড়ি নেই। তাই যথারীতি জলের অপচয় হচ্ছে। প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে।
সম্প্রতি আগামীতে জলের সঙ্কট নিয়ে যে বার্তা ঘোষিত হয়েছে তা ভয়াবহ। জল ছিল সহজলভ্য। কিন্তু সেই জল হয়ে যেতে পারে দুষ্প্রাপ্য। আর সত্যিই যদি তা হয় তাহলে মানুষের জীবন যে বিপন্ন হয়ে উঠবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সতর্কতা জারি হয়েছে জলের অপচয় নিয়ে। কিন্তু মানুষ কি তা নিয়ে সচেতন? এখনও জলের অপচয় হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ জল এতদিন মানুষের কাছে অফুরন্ত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আজ যে জলসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে মানুষের অসচেতনতাই তো তার জন্য দায়ী। সাবমার্সিবল পাম্পের অপরিমিত ব্যবহার, রাস্তার ধারের কল থেকে সারাদিন জল পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা নিত্যদিনের। একটার পর একটা জলাশয় বুজিয়ে গড়ে উঠেছে বহুতল বাড়ি। কেউ নিয়ম মানেনি। আইন মানেনি। চাষের কাজে জলের প্রয়োজন অনিবার্য। কিন্তু সেখানেও জলের যে অপব্যবহার হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। পাশাপাশি মনে করা হচ্ছে, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে গাছ লাগানো দরকার। এখন এসব নিয়ে বিভিন্ন পুরসভা পঞ্চায়েতে পথনাটক, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু মানুষ কতখানি সচেতন? জলের অপচয় কি বন্ধ হয়েছে? দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক থার্মোকল ব্যবহার কি সত্যিই নিষিদ্ধ হয়েছে? আসলে মানুষ বড়ই অসচেতন।
প্লাস্টিক, থার্মোকল পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। এটা প্রমাণিত। মাটিকে দূষিত করে প্লাস্টিক। কিন্তু এত সতর্কতার পরেও প্লাস্টিক এবং থার্মোকলের ব্যবহার কমেনি। কারণ কথার কথা হিসাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে কিন্তু কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
প্লাস্টিক নিষেধ নিয়ে অনেক সতর্কতা জারি করা হয়েছে। কিন্তু প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার যথারীতি চলছেই। হাটে বাজারে দোকানে প্লাস্টিকের প্যাকেটে করেই জিনিসপত্র দেওয়া হচ্ছে। থলে হাতে বাজার যেতে অভ্যস্ত মানুষ আর কিছুতেই পুরনো অভ্যাসে ফিরতে পারছে না। মাছ আসছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে। নানা খাদ্যদ্রব্য যথারীতি প্লাস্টিক মোড়কে বাজারে ঘুরছে। আসলে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করতে হলে প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানাগুলো আগে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে ব্যাপারে হেলদোল নেই প্রশাসনের। তাই প্লাস্টিক, থার্মোকল চলছেই। বিভিন্ন পুজোর মণ্ডপ তৈরিতে থার্মোকলের অবাধ ব্যবহার হচ্ছে। বিয়েবাড়িতে থার্মোকলের থালা, বাটি ব্যবহার চলছেই। নিমন্ত্রিত মানুষেরা বিয়েবাড়ি, ভোজবাড়িতে যথারীতি থার্মোকলের থালা বাটিতে দেওয়া খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরছে। আর সেই সব ব্যবহৃত থার্মোকল ডাঁই হয়ে পড়ে থাকছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছিলেন, ‘‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’’। আমরা শুনিনি তঁার কথা। অবাধে বন ধ্বংস করা হয়েছে। গাছ কাটা হয়েছে। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই এসব হয়েছে। কলকাতা-সহ বড় বড় শহরের বুকে বহুতল বাড়ি গড়ে উঠেছে বহু জলাশয় আর বহু বৃক্ষ ধ্বংস করেই। আজ সেই কলকাতায় জলসঙ্কটের আগাম বার্তা প্রচার করা হচ্ছে, গাছ লাগান, গাছ বাঁচান।
কিন্তু আজকের দিনে মানুষের ফ্ল্যাটবাড়িতে গাছ লাগানোর জায়গা কোথায়?
তাই ভয়ংকর এক সঙ্কটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ। বিভিন্ন শহরে রাস্তার পাশে গাছ লাগানো হচ্ছে। আবার সেই শহরেই দূষণের কালো ধোঁয়া উড়িয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে গাড়ি। এই গাড়ির ব্যবহার আজ গ্রামগঞ্জে ব্যাপকহারে বেড়েছে। অনেক পরিমাণে মাল বহনে সক্ষম এই গাড়ি ব্যবহারে আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু এই গাড়ি যখন স্টার্ট নেয় তখন যে পরিমাণ কালো বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দেয় তা কি খুব স্বাস্থ্যকর? কিন্তু কে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে এই গাড়ির প্রতি? আইন মানাতে হলে প্রশাসনকে কড়া মনোভাব নিতে হবে। এ রাজ্যে আইন হয় কিন্তু আইন মানতে মানুষকে বাধ্য করা হয় না। তাই ভয়াবহ দূষণ থেকে পুরোপুরি মুক্তি কি সত্যিই সম্ভব!
দূষিত হচ্ছে নদীর জল। দূষিত হচ্ছে বাতাস। ধ্বংস হচ্ছে বন। বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে জলাশয়। খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কীটনাশক। এইরকম একটা ভয়ঙ্কর সময়ে মানুষের বেঁচে থাকা। বাজারে যে সব ফল বিক্রি হচ্ছে তাকে নানাভাবে কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হচ্ছে। বাজারে আনাজে রং করে লোভনীয় চেহারায় রূপ দেওয়া হচ্ছে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো হচ্ছে কলা। আর মানুষ রোজ এইসব কিনে আনছে। কিন্তু সবই তো আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। যঁাদের হাতে আইন তঁারা কিন্তু আশ্চর্য রকমের নির্বিকার। একটু কড়া পদক্ষেপ নিলেই এগুলো আটকানো যায়। পথেঘাটে চলা ট্রাক বাস প্রাইভেট গাড়ি চলছে বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে। এভাবে মানুষ যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল চালাচ্ছে।
কোন সর্বনাশের দিকে এগোচ্ছে মানুষ? বাতাসে বিষ। খাবারে বিষ। আকাশ আচ্ছন্ন কালো ধোঁয়ায়। মাটি দূষিত কীটনাশক আর প্লাস্টিকে। শুধু আইন করলেই হবে না। আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। জলের অপব্যবহার আটকানো যাবে না। অথচ জলসঙ্কট হবে বলে মানুষকে সচেতন করা হবে - কী লাভ তাতে? মানুষই তো আজ দূষণের পৃষ্ঠপোষক। এক অনিবার্য ঘাতক। তাদের অসচেতনতা, উদাসীনতা, আইন না মানার প্রবণতা সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করছে।
আরও অরণ্য চাই। দূষণমুক্ত নদী চাই। কল কারখানার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বাতাস চাই না। কালো বিষাক্ত ধোঁয়া ওড়ানো যানবাহন চাই না। কৃত্রিম রঙে রঙ করা আনাজ চাই না। এর জন্য কড়া আইন দরকার। দরকার মানুষের শুভবুদ্ধি। তা না হলে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।
লেখক প্রাক্তন কলেজ গ্রন্থাগারিক ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব