ফাইল ছবি।
দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনে এসেছি এই নাকি রাজধর্ম। কিন্তু দুষ্টের দমনের মূলে যদি থাকে বিভেদের রাজনীতি? তাকে কি রাজধর্ম হিসাবে মেনে নেব না অধর্মের শাসন মনে করব? এ নিয়ে সত্যি কোনও তর্ক থাকতে পারে? এ প্রসঙ্গ এখন বিশ্বজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে। তবে তথ্য যা বলছে তা হল বিভেদ ও বিবাদ যেমন সংসারে ঘুণ ধরায়, ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নের পথেও কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আবার উল্টোদিকে নাগরিকের স্বার্থে সামাজিক ভাবে সুস্থির রাষ্ট্র পাশে থাকলে উন্নয়নের ফল ভোগ করে সে দেশের প্রতিটি মানুষ।
আমরা বলতেই পারি, এ আবার নতুন করে জানার কী আছে? এ তো সাধারণ বুদ্ধিই বলে দেয়। হয়ত। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিকে তথ্য দিয়ে যাচাই করে নেওয়াই তো গবেষকের কাজ। কারণ, অনেক সময় স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে বা আপাত দৃষ্টিতে যা ঠিক মনে হয়, তা আসলে হানিকরও হয়ে উঠতে পারে। আজকের আলোচনায় এই শেষ প্রসঙ্গটি তোলা থাক। কিন্তু যা প্রাসঙ্গিক তা হল আমাদের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে হইচইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামাজিক প্রায় প্রতিটি সূচকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া অবনমন। ক্রমবর্ধমান সামাজিক হিংসার সঙ্গে পা মিলিয়ে বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য।
এটা যে শুধু আমাদের দেশের সমস্যা তা নয়। তথাকথিত উন্নত দুনিয়াতেও এই সামাজিক হিংসা ও বৈষম্য কোভিডের মতোই অতিমারির আকার নিয়েছে। একদিকে ব্যতিক্রম হয়ে এখনও বাঁচছে সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডের মতো নর্ডিক দেশগুলি আর মেরুর অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে লাতিন আমেরিকায় কলম্বিয়ার মতো দেশগুলি ক্রমাগত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চলেছে সামাজিক হিংসা উন্নয়নের পথকে ঠিক কতটা পিচ্ছিল করে তুলতে পারে।
এ শুধু মুখের কথা বা শুধুই বিরোধী রাজনীতির স্লোগান কি না তাও খতিয়ে দেখেছেন অনেকেই। সামাজিক ও রাজনৈতিক হিংসা উন্নয়নের রাস্তাকে কী ভাবে পিচ্ছিল করে তোলে ও ঠিক কতটা, তার অনুসন্ধানও অনেকেই করেছেন। যেমন, ২০১৯ সালে ইউরোপিয়ান রিসার্চ স্টাডিজ জার্নালে প্রকাশিত আলেকজান্ডার কোতে প্রভাডা ও হর্জে মার্টিনেজ় কার্ভাজেলের কলম্বিয়ার উন্নয়নের উপর রাজনৈতিক ও সামাজিক হিংসার প্রভাব নিয়ে গবেষণাটি।
তাঁরা বলছেন, যে কোনও দেশেই রাজনৈতিক ও সামাজিক হিংসা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। কলম্বিয়াকে ধরে আর্থিক তথ্য যাচাই করে তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক হিংসা লগ্নির পথে অন্তরায়, এবং তা সামাজিক ও আর্থিক পরিকাঠামো পঙ্গু করে দেয়। ২০০০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কলম্বিয়ার আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন রাজনৈতিক পরিসরে অহিংসা, সাধারণের যোগদান এবং স্বচ্ছ সরকারি পরিচালন ব্যবস্থা যা নাগরিকের স্বার্থরক্ষায় অক্লান্ত তা কী ভাবে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এইখানেই নর্ডিক মডেল প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কিন্তু আগে সেরে নেওয়া যাক কলম্বিয়া প্রসঙ্গ।
৬০-এর দশকে বেকার দেখিয়েছিলেন, হানাহানির রাজনীতিতেও আর্থিক লাভ রয়েছে। শুধুই ক্ষোভ হিংসার রাজনীতির মূলে নয়। ক্ষোভ তৈরি করে, তারপর তার উপর ভর করে তৈরি করা হিংসা আর্থিক লাভ এবং ক্ষমতার উৎস হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, তিনি দেখিয়েছিলেন সঠিক ভাবে পরিচালিত আর্থিক নীতি কী ভাবে হিংসায় বিনিয়োগ করাকে অলাভজনক করে তুলত পারে।
আলেকজান্ডারদের গবেষণা দেখাচ্ছে কী ভাবে কলম্বিয়ায় হিংসার রাজনীতি শুধু অসহনীয় বৈষম্যই তৈরি করেনি, পাশাপাশি রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছের মানুষদের অকল্পনীয় বিত্তের অধিকার করে তুলেছে। ভারতেও এই আলোচনা চলছে। আমাদের দৈনন্দিন আলোচনাতেও ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ এই শব্দবন্ধ নিয়মিত ব্যবহার হতে শুরু করেছে। গবেষণা দেখাচ্ছে, বিভেদের রাজনীতি যেমন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায় একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে, ঠিক একই ভাবে এই রাজনৈতিক বলয় তৈরি করে এক বিশেষ ব্যবসায়ী শ্রেণি। রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতা তখন এই দুই শ্রেণির মধ্যে এমন এক নির্ভরশীলতা তৈরি করে যে তা ভাঙা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।
চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এই হিংসার রাজনীতি বিভিন্ন স্তরে শুধু বৈষম্যই তৈরি করে না, রাষ্ট্রযন্ত্রকেও সাধারণের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়, আইনের পথে শাসনের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করে যা পরবর্তী কালে দমননীতির রাস্তা মসৃণ করে।
এর থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা হল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রসার। কিন্তু এই গবেষণার প্রতিপাদ্যই স্পষ্ট করে দেয় যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পরিপন্থী। তবে যে দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক হিংসার রমরমা সে দেশে নাগরিকমুখী এ ব্যবস্থা কার হাত ধরে বা কী ভাবে আসবে সে আলোচনা আলেকজান্ডাররা করেননি, কারণ তা তাঁদের প্রতিপাদ্যের বিষয়ও ছিল না।
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে যদি গণতন্ত্রকে সম্মতির শাসনব্যবস্থা বলে মেনে নিই তা হলে কিন্তু আমাদের আইসল্যান্ড বা ফিনল্যান্ডের মতো দেশের দিকে তাকাতে হবে। নাগরিকের পাশে রাষ্ট্র যে কী ভাবে থাকতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে মানতেই হবে এই নর্ডিক দেশগুলিকে। সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে আর আইসল্যান্ডকে নর্ডিক দেশ বলি আমরা। আর্থিক উন্নয়নের আলোচনায় এদের উদাহরণ সব সময় উঠে আসে। তার কারণ নাগরিকদের উন্নত জীবনযাত্রার মান এবং নাগরিকদের মধ্যে অধিকারের এবং সেই অধিকার কার্যকর করার মধ্যে কোনও বৈষম্য না থাকা। এই দেশগুলিতে সামাজিক অবস্থান অধিকার ভোগের নির্ধারক নয়। সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভেদে রাজনীতি কন্টকিত না হওয়ায়, রাষ্ট্রীয় নেতাদের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে গণপরিবহণে যাতায়াতের ছবি তাই আমাদের মতো দেশের সংবাদপত্রে বিরাট জায়গা পায়।
এই জায়গাটা কিন্তু তৈরি হয়েছে অবাধ বাজার এবং কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের এক দক্ষ মিশ্রণে। এ দেশগুলিতে মালিকের চাকরি খাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকার নিয়ে খুব একটা ক্ষোভ নেই ,কারণ, রাষ্ট্র সব সময় নাগরিকের সঙ্গে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বার্ধক্যের সহায়ও রাষ্ট্র। কমবেশি মাথাপিছু ৫০ শতাংশ করের বোঝা তাই মেনে নিয়েছেন নাগরিকেরা।
মাথায় রাখতে হবে যে এই ব্যবস্থার বিরোধীও আছেন। তাঁদের আপত্তি নাগরিক জীবনে রাষ্ট্রের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে। কিন্তু এটাও ঠিক যে গড়ে ২৫ শতাংশ নাগরিকের বিশ্ববিদ্যালেয়ের উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি আছে এবং সেই শিক্ষার খরচ রাষ্ট্রই বহন করে। নাগরিকের বাক্ স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও এ দেশগুলি কিন্তু বিশ্বের সব রাষ্ট্রের শীর্ষে।
উন্নয়নের আলোচনায় কলম্বিয়ার সঙ্গে নর্ডিক দেশগুলির উদাহরণ পাশাপাশি রাখলে যা স্পষ্ট হয়ে যায় তা হল রাজধর্ম যদি হয় নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা তা হলে তা একমাত্র হতে পারে বিভেদ এড়িয়ে আইনের শাসনেই। শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণকে শাসনের একমাত্র অভিমুখ করে তুলে। আর তার প্রাথমিক পদক্ষেপই কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক হিংসাকে অস্ত্র নয়, শত্রু মেনেই এগিয়ে যাওয়ায়। আর তার পথ হল যথাযথ সম্মতির শাসন। উন্নয়ন যদি সবার জন্য হয়, তা হলে তা করার এটাই ইতিহাসের পাঠ মেনে একমাত্র রাস্তা।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।