সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে কানে এল শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে এ বারের খ্রিস্টোৎসবের গান— “আরো আরো প্রভু আরো আরো,/ এমনি করে আমায় মারো।” এ তো ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর গান, স্বৈরাচারী রাজা যাঁর ‘কণ্ঠীশুদ্ধ কণ্ঠটিকে’ চেপে ধরবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। ওই নাটকেই ধনঞ্জয় বৈরাগী বলেন সবার ভিতরে এক পরম শক্তিময় অস্তিত্বের কথা, যেখানে কারও অপমান পৌঁছয় না।
এই সব কিছুই ভেসে এল শান্তিনিকেতন আশ্রম এবং বিশ্বভারতীতে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনার আবহে। আমরা দেখেছি, আশ্রমের প্রাঙ্গণে স্পর্ধার মতো গেঁথে ফেলা হয়েছে প্রাচীরের পর প্রাচীর। যার স্রষ্টা এক অখণ্ড বিশ্বনীড়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই পরিসর খণ্ড, ক্ষুদ্র করে ফেলা হয়েছে অসংখ্য সৌকর্যহীন বিভাজনরেখায়। বিশেষত বিপরীত মতপ্রকাশের স্বরগুলিকে রাখা হচ্ছে এক অভূতপূর্ব ত্রাসের শাসনে। অধ্যাপক-কর্মীদের ক্রমাগত অপমানকর বয়ানে জবাবদিহি চাওয়া, সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা, পড়ুয়াদের গৃহবন্দি করা, সবই ঘটতে থাকে কর্তৃপক্ষের প্রায় একক অভিপ্রায়ে।
৮ শ্রাবণ ১৩৪৭ তারিখে উপাসনা মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণে বলেছিলেন যে, বিশ্বভারতীর সব আয়োজনের এক নিবিড় যোগ থাকা চাই ‘আশ্রমের কেন্দ্রস্থলবর্তী শ্রদ্ধার একটি মূল উৎসের সঙ্গে’। নয়তো তা হবে ‘অন্ধ-অনুষ্ঠান’। আবার সেই শ্রাবণের মন্দিরেই উৎকণ্ঠিত রবীন্দ্রনাথকে বলতে শুনছি যে, পড়ুয়ারা যেন ‘শ্রদ্ধাহীন স্পর্ধা’ দ্বারা আশ্রমের মূল সাধনাকে প্রত্যাখ্যান না করেন।
যে শ্রদ্ধাকে রবীন্দ্রনাথ রাখছেন আশ্রমের কেন্দ্রস্থলে, তা ব্যক্তির স্বতন্ত্র চিন্তা, বাক্স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা। আজ তা নিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বভারতীর একটি কর্মী-সংগঠন বিশ্বভারতীর উপাচার্যের এক বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিল। তার নিরিখে কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক অধ্যাপক-কর্মীর সংগঠন-সংলগ্নতা লিখিত ভাবে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যেন ‘রক্তকরবী’ নাটকে যক্ষপুরীর কুৎসিত নজরদারির ছবি।
আশ্রমের আদর্শের সর্বাঙ্গে সাম্প্রতিক আঘাতগুলি দেখেও আশ্রমিক-অধ্যাপকরা নীরব। তাঁরা অনেকেই এক কালে এখানে পড়ুয়া ছিলেন, পুরনো আশ্রমিক পরিবারের অংশী। অনেকেই হয়তো গোপন গ্লানি নিয়ে কর্তৃপক্ষের আদেশে আচারে-উৎসবে অংশ নেন, পড়ুয়াদের প্রস্তুত করে দেন নৃত্যগীতের জন্যে। আশ্রমিক সংঘ, আলাপিনী সমিতিকে আশ্রমের মধ্যে স্থান দেওয়ার প্রাচীন অঙ্গীকার কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এখানকার আবহাওয়ার মধ্যে একটি আহ্বান আছে, আয়ন্তু সর্বতঃ স্বাহা’ (৮ পৌষ, ১৩৪৫, বিশ্বভারতী), সেখানে আশ্রমকে সঙ্কীর্ণ করে তোলার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ কি অভিপ্রেত ছিল না? অধ্যাপকদের মধ্যে যাঁরা প্রাক্তনী, তাঁদের পথ দেখাবার দায় কি রবীন্দ্রনাথই দিয়ে যাননি?
১৩৩৯ সালের ৮ পৌষ রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আমার এই দীর্ঘ জীবনের প্রয়াস সার্থক হবে যদি তোমরা এর অন্তর্নিহিত সত্যটিকে উপলব্ধি করো। শুধু বিধিবিধানের মধ্য দিয়ে নয়, কিন্তু তোমরা জীবনের যে ছাপ এখান থেকে পেলে, তার চিহ্ন দিয়ে, তোমাদের শুদ্ধ প্রীতি, নিষ্ঠা ও ত্যাগের দ্বারা একে রক্ষা করতে হবে। অন্য বিদ্যালয় শুধু মাইনের দাবী রাখে, কিন্তু এই আশ্রম এখানকার ছাত্রদের কাছে ত্যাগের দাবী রাখে। তোমাদের সেই কল্যাণ কামনা ও ত্যাগের দ্বারা এর সত্যটিকে পরিপুষ্ট করতে হবে। দূরে নিকটে যে অবস্থায় থাকো, মনে রেখো, তোমাদের আত্মদানের উপর এই আশ্রমের আদর্শ নির্ভর করছে।” (প্রাক্তনী/৩)
এই যে ত্যাগ এবং আত্মদানের কথা বারে বারে উচ্চারণ করেন রবীন্দ্রনাথ, তা কোনও মামুলি বস্তু নয়। এই ত্যাগ ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধিকে ত্যাগ, আপস করার আরামটুকুকে ত্যাগ, সঙ্কটকালে স্বাচ্ছন্দ্যসুখকে ত্যাগ, এবং সর্বোপরি ভীতিকে ত্যাগ। নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। আজ রবীন্দ্রনাথের কাছে আমাদের ঋণশোধের সময়। মানুষের অধিকার, সম্মান আর সৌন্দর্যকে সর্বপরিসরে রক্ষা করার প্রত্যয় তাঁর থেকেই খুঁজে নিতে হবে। যদি অনশনরত ভিন্ভাষী কৃষক হাতে তুলে নিতে পারেন রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস, তবে কেন আশ্রমিকরা তাঁর উত্তরসূরি হয়েও তাঁর আশ্রয় নিতে পারবেন না?
আমাদের কিশোরবেলায় এক বার রাজনীতির তুমুল উগ্রতায় কোনও একটি উৎসব প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম, হয়তো সে দিন মন্দিরে উপাসনাও স্থগিত হতে পারে। কিন্তু দেখলাম, সেই থমথমে আবহে হলুদ বসন পরা প্রবীণ শান্তিদেব ঘোষ অবিচলিত প্রত্যয়ে মন্দিরে তাঁর আসনে বসলেন। দূরে ছাতিমতলার দিকে গভীর প্রত্যয়ী দৃষ্টিতে তাঁর উঁচু তারে বাঁধা কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, “তুমি আমাদের পিতা...।” বাঁশির মতো তীব্র সংবেদী অর্থময় সেই স্বরে চার পাশ কী জাদুমন্ত্রে সংবৃত হয়েছিল, এখনও স্মরণ করলে ভিতরটা ভিজে আসে।