শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বদলি প্রসঙ্গে সম্প্রতি এ রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘‘...শিক্ষিকারা এত বেশি স্ত্রীরোগে ভুগছেন যে, আমি নিজেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। এটা কী হচ্ছে? জেনুইন কিছু থাকলে নিশ্চয়ই বদলি হবে।’’ প্রশ্ন হল, ঠিক কতটা অসুস্থ হলে তবে ‘জেনুইন’ বলা যায়! ধরা যাক, এক জন শিক্ষিকা কিডনির অসুখে ভুগছেন। একটি কিডনি নষ্ট হয়েছে আগেই। অন্যটির অবস্থাও ভাল নয়। অসহায় শিক্ষিকা নিজেই নিজের ‘বন্ড’ সই করে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করছেন। তাঁর বদলির আবেদনে সাড়া দিল না শিক্ষা দফতর। এই ঘটনাকে কি ‘জেনুইন’ বলা যায়?
আর এক জন শিক্ষিকা প্রায় এক বছর থেকে ব্রেস্ট ক্যান্সারে ভুগছেন। কেমোর কারণে মাথার চুল উঠে গিয়েছে। সেই গৃহবন্দি শিক্ষিকার বদলির আবেদনও ফাইলের লাল ফাঁসে ধুঁকছে। কেউ কেউ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘স্বয়ং মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন।’ আচ্ছা, এই ঘটনাকে কি তা হলে ‘জেনুইন’ বলা যেতে পারে?
আবার দেখা গেল, কোনও অসুখ ছাড়াই আইনের ফাঁক গলে এক শিক্ষিকা বাড়ির পাশের স্কুলে বদলি হয়ে এলেন। অভিধান থেকে তখন ‘জেনুইন’ শব্দটা বুঝি কিছুক্ষণের জন্য গায়েব হয়ে যায়! রাজনীতির বাজারে কখন যে কী ‘জেনুইন’ হয়ে যায়!
এ বঙ্গে আজকাল অবাক হতেও অবাক লাগে। তবুও কখনও কখনও অবাক হতেই হয়। যেমন হতে হল সংবাদমাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য পড়ার পরে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। তাঁর দফতরের এক মন্ত্রীর মুখে শালীনতার লাগাম থাকবে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু রোগকে এক লহমায় তিনি স্ত্রীরোগের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন। তার পরে এমন এক অবজ্ঞা ও সন্দেহের পর্যায়ে বিষয়টি নামিয়ে এনে হাস্যস্পদ করে তোলা হল যা শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, অত্যন্ত অপমানজনকও। এ সব জানার পরে রাগ নয়, আফসোস হয়। আমরা আদৌ এগোচ্ছি নাকি পিছনের দিকে ছুটছি? নাকি মেয়েদের অগ্রাধিকারের বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ে থাকছে আসল সত্যি? ভাবনাচিন্তায় এখনও সেই মধ্যযুগ পেরোনো গেল না! মেয়েদের জন্য রেনেসাঁও আর এল না।
মন্ত্রীমশাই ‘আতঙ্কিত’ হয়ে পড়েছেন। কী আশ্চর্য! সুব্যবস্থার কথা ভাববেন না আবার আতঙ্কিত হবেন, তা কী করে হয়? কারণে-অকারণে আতঙ্কিত হওয়াটাও তো এক ধরনের অসুখ। শিক্ষিকাদের চাকরিতে নিয়োগের সময় বাড়ির কাছের বিদ্যালয়ে অগ্রাধিকার দেবেন না। অথচ নানা বাহানায় তাঁদের ‘বায়োলজিক্যালি’ হেনস্থা করবেন? দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নিয়মিত যাতায়াতের ফলে নানা শারীরিক সমস্যা বাসা বাঁধে দেহে। যার সবটা ‘স্ত্রীরোগ’ বলে চালানো অপব্যাখ্যা। মহিলাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের স্বাস্থ্য-সচেতনতার অভাব। নিজের জন্য সময় বের করার আলস্য। আবার এটাও ঠিক যে, কিছু ক্ষেত্রে সময় বের করাও সত্যিই কঠিন।
চাকুরিজীবী মেয়েদের দু’টি কর্মক্ষেত্র। একটিতে অবসর না নেওয়া পর্যন্ত মাস মাইনে পাওয়া যায়। অন্য কর্মক্ষেত্রের নাম সংসার। সেখানে কাজ করে যেতে হয় জীবনভর। দু’জায়গাতেই চরম চাপ, উদ্বেগ। পুরুষেরা অফিস যায়। বাড়িটা রেখে আসে দরজায় লেখা ঠিকানার জিম্মায়। মহিলারা স্কুলে যায়। কিন্তু সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ায় সংসারের হাজারও ঝক্কি— ‘বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরল তো?’, ‘স্নান-খাওয়া হয়েছে?’, ‘এই রে! আলমারির চাবিটা যেন কোথায় রাখলাম।’ ‘এই যাঃ, ফ্যানটা কি বন্ধ করে এসেছি?’ ‘কেবল লাইন কি খুলেছি?’, ‘ছেলেটা কি না ঘুমিয়ে টিভি দেখছে?’ মাথার মধ্যে এই গেরস্তালি-গুঞ্জন চলতেই থাকে। এগুলো বোঝার জন্য মহামানব হওয়ার দরকার হয় না। একটু সহজ ভাবে ভাবলেই বোঝা যায়।
মেয়েদের নিয়ে যা বলা যায় তাতেই এক মজা আর হাততালির আয়োজন। বলা হল, মেয়েদের সাধারণ জ্ঞান কম। বহু সহকর্মীর সে কী হাসি! কেন মেয়েদের সাধারণ জ্ঞান কম? ব্যাখ্যা মেলে না। তবুও হা...হা। তবুও হি...হি। বলা হল, মেয়েরা রান্না করে বিদ্যালয়ে আসে। বাড়ি ফিরে আবার রান্না করে। এ বারে হাসি নয়। চোয়াল শক্ত করে কেউ কেউ বলেন, ‘তো কী করবে? মেয়ে হয়ে জন্মেছে। রান্না করবে না?’
সত্যিই তো! মেয়েরা রান্না করবে না তো কে করবে? তাই পান থেকে চুন খসলে ঘরে অভিযুক্ত, বাইরে পীড়িত এবং চাকরি করতে এসেও অসুখ নিয়ে অপমানিত হতে হয়। কিন্তু এর বাইরে এক গভীর অপ্রকাশিত কথা এই যে, মেয়েরা মর্মাহত ও বিরক্ত। এক জাঁতায় এক সত্তাকে কত বার কত ভাবে পেষা চলছে দেখে তারা ক্লান্ত ও বীতশ্রদ্ধ। এই সমগ্র বিদ্রুপ আর অপমান করার ‘সিস্টেম’কে তারা হাসি মুখে মেনে নিচ্ছে মানে এই নয় যে, তারা বদল চায় না কিংবা পরিবর্তনের সামর্থ্য তাদের নেই। তবুও সেই অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি— এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই স্বপ্ন ঠাকুমা দেখিয়েছিলেন ছোট্ট নাতনিকে, নাতনি বড় হয়ে সেই একই স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাঁর কন্যাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক বিশ্বাসের সাকার হওয়ার অপেক্ষায় আছে মেয়েরা। এই বিশ্বাসের ফসলই দিয়েছে সহন ক্ষমতা। কিন্ত্ু্ অনেকেই ভুল করে ভেবে বসেন যে, সহ্য করছে মানেই তো ওরা দুর্বল! ভুলটা হয়ে যায় ঠিক এখানেই!
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল