জওহরলাল নেহরু।
খর্বাকৃতি টিলা ঈষৎ দূরবর্তী হইলেই চোখের আড়াল হয়। সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গের মহিমা দূর হইতেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়। চিনিয়া লওয়া যায় তাহার স্বাতন্ত্র্যকে। জওহরলাল নেহরুর জন্মদিবস আরও এক বার অতিক্রান্ত হইল। তিনি আরও দূরবর্তী হইলেন। নেহরুকে মহামানব বলিবার কোনও কারণ নাই। তাঁহার বহুবিধ ত্রুটি ছিল, তাঁহাকে লইয়া অনেক প্রশ্ন আছে। পর্বতশিখরও নিটোল নিখুঁত কোনও বস্তু নহে, তাহার সর্বাঙ্গে বিস্তর অপূর্ণতা, বহু ক্ষয়ক্ষতি। কিন্তু সেই কারণে তাহার মহিমা মিথ্যা হইয়া যায় না। বড় মাপের মানুষের গুরুত্বও বিবিধ অপূর্ণতাকে অতিক্রম করিয়া ভাস্বর হইয়া উঠে, দর্শকেরা এক নজরে তাঁহার স্বাতন্ত্র্যকে চিনিতে পারেন, বুঝিয়া লইতে পারেন তাঁহার ব্যক্তিত্বের মূল ধর্মটিকে। জীবন স্বভাবত দ্বন্দ্বময়, দ্বন্দ্বের আলোকে চেতনা প্রখর হয়। খর্বাকার টিলার প্রেক্ষাপটে যেমন বৃহৎ শৃঙ্গের রূপ স্পষ্টতর দেখাইয়া থাকে, তেমনই সমকাল ক্ষুদ্র হইলে সহজতর হয় অতীতের বৃহৎ ব্যক্তিত্বকে চিনিয়া লওয়া। সমকালীন ভারতের রাজনীতির পরিসরটি টিলায় পরিপূর্ণ। জওহরলাল নেহরুর মতো বৃহৎ ব্যক্তিত্ব আজ, নিতান্ত দুর্লভ বলিয়াই দ্বিগুণ সমাদরণীয়।
নেহরুর রাজনৈতিক চরিত্রের যে ধর্মটির কথা বহুচর্চিত, তাহার নাম গণতান্ত্রিকতা। ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সক্রিয় দায়বদ্ধতা সেই গণতান্ত্রিকতার শর্ত। নেহরু অনেক দূর অবধি সেই শর্ত রক্ষা করিয়া চলিয়াছিলেন। স্বাধীন ভারত আপন জীবনের প্রথম পর্বে কতটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়া তাহার গণতন্ত্রের সার্থক অনুশীলন করিয়াছিল— বহু ঘাটতি এবং বিকৃতি সত্ত্বেও যে সার্থকতা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যই ছিল অনন্য— এবং সেই সার্থকতার পিছনে তাহার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সকলকে লইয়া চলিবার স্বাভাবিক আগ্রহ কত বড় ভূমিকা পালন করিয়াছিল, আজ, ছয়-সাত দশকের দূরত্ব হইতে তাহার মর্ম হয়তো কিছুটা অনুধাবন করা যায়। এই প্রসঙ্গে একটি কথা সযত্নে লক্ষ করা দরকার। নেহরু গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বিপন্নতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি জানিতেন, গণতন্ত্রকে রক্ষা করিতে হয়, রক্ষা করিবার জন্য সতত সচেতন এবং তৎপর থাকিতে হয়, নচেৎ তাহা বিপন্ন হইতে পারে। এই বোধ তিনি সমকাল হইতেই আহরণ করিয়াছিলেন। বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট ও সর্বনাশের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি ভারতের নিজস্ব রাজনৈতিক বিবর্তনও এই সত্যের স্বরূপ উন্মোচনে সহায়ক ছিল। বিশেষ করিয়া দেশের সমাজ ও রাজনীতির অন্দরমহলেই যে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিকতার বিবিধ দুর্বলতার আকর নিহিত রহিয়াছে, অভিজ্ঞতা তাঁহাকে সেই বিষয়ে দ্রুত নূতন নূতন শিক্ষা দান করিয়াছিল। এক দিকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা এবং অন্য দিকে রাজনীতিক ও প্রশাসকদের গণতান্ত্রিকতার মানসিকতা, এই দুই বিষয়েই তিনি উত্তরোত্তর গুরুত্ব দিয়াছিলেন। রাষ্ট্রনীতির পরিচালনায় তিনি নিজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই ভূমিকাকে সম্পূর্ণ রক্ষা করিতে পারেন নাই, এমনকি স্বয়ং তাহার শিকার হইয়াছিলেন। সেই কারণে তাঁহার সমালোচনাও অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু ব্যাধির লক্ষণ চিনিতে তাঁহার ভুল হয় নাই।
আজ সেই ব্যাধি সর্বাঙ্গে ছড়াইয়াছে। বিপন্ন গণতন্ত্রের উদ্বেগজনক, ভয়ঙ্কর উদাহরণ হিসাবে নানা দেশের পাশাপাশি ভারতের নামও এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হইতেছে। লক্ষ করিবার বিষয়, এই বিপদ বাহির হইতে আসে নাই, আসিয়াছে ভিতর হইতেই। এবং তাহা আক্রমণ করিয়াছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। যে প্রতিষ্ঠানগুলি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের প্রধান রক্ষাকবচ, তাহাদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ব্যাধিগ্রস্ত, দুর্বল, ক্ষমতাবানের অন্যায়ের নীরব দর্শক অথবা সক্রিয় সহায়ক। বিচারবিভাগের উপর সম্পূর্ণ ভরসা হারাইবার মতো পরিস্থিতি হয়তো এখনও হয় নাই, কিন্তু তাহা খুব বড় আশ্বাস হইতে পারে না। বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় আদালতের ভূমিকা লইয়া নানা উদ্বেগের কারণ ঘটিয়াছে, ঘটিয়া চলিয়াছে। তদুপরি বলিতেই হয়— দুর্ভাগা সেই গণতন্ত্র, যাহার সমস্ত ভরসা আদালতের উপর সমর্পিত হয়। তেমন দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে একমাত্র লড়াই করিতে পারে জনসমাজ। সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক প্রতিবাদ এবং মানবাধিকার রক্ষায় ব্রতী বিবিধ সংগঠনের কর্মকাণ্ডে তেমন লড়াইয়ের কিছু কিছু নমুনা দেখা যাইতেছে। সকল প্রদীপ এখনও নির্বাপিত হয় নাই। শেষরক্ষার জন্য নেহরু হয়তো সাধারণ মানুষের চেতনা এবং উদ্যমের উপরেই আস্থা রাখিতেন।
যৎকিঞ্চিৎ
আজ শেখা যাক ‘বিহার মডেল’ রান্নার পদ্ধতি। প্রথমে অন্তত তিন দফার শরিক একটি দলকে নিন, তাতে ভাল করে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি মাখিয়ে ম্যারিনেট করুন। আজন্ম সুবিধাবাদী অন্য একটি দলকে কাঁচির মতো ব্যবহার করে শরিকের ডানা ছাঁটুন। তার পর, ‘উনিই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী’ বলে অল্প আঁচে সাঁতলাতে থাকুন। নিজেদের মেজো-সেজো নেতাকে দিয়ে ‘আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই আমাদের মুখ্যমন্ত্রী চাই’ বলানোর ফোড়ন দিন। এই রান্নায় আর বিধায়ক কেনাবেচার মশলা দিতে হয় না।