একই আকাশ, একই পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা, বাস করি আলাদা আলাদা জগতে। ২৭ ফেব্রুয়ারি, বারো ক্লাসের বোর্ড পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমার বাড়ির পরীক্ষার্থী জেনে গিয়েছে, তার মতো হাজার হাজার অধীর উৎসাহী পরীক্ষার্থী গত কয়েক দিন পড়াশোনা করতে পারেনি, পরীক্ষাও হয়তো দিতে পারবে না। তারাও এই একই শহরের বাসিন্দা। প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে তাদের জগৎ, জীবনযাপন লন্ডভন্ড। দিল্লির উত্তর-পূর্ব জেলা, যমুনার ও পারে। কেন্দ্রীয় বোর্ড সেখানে স্থগিত করে দিয়েছে আজকের পরীক্ষা। বড় হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণে তাদের জীবন-জগতে দাগ কেটে গেল অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা।
২৩ ফেব্রুয়ারি, গত রবিবার। রাজধানী শহরের প্রান্তিক যমুনাপার অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। দূরদূরান্ত থেকে মেসেজ আসছে শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু-পরিজনের। তাঁরা উদ্বিগ্ন— আমরা নিরাপদ তো? টানা তিন দিন চলেছে হিংস্র উচ্ছৃঙ্খল আক্রমণ— মৌজপুর, বাবরপুর, বিজয় পার্ক-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। আমরা ‘অন্য’ দিল্লির বাসিন্দা, ‘প্রিভিলেজড’ শ্রেণি, অনেক সুরক্ষিত জীবনযাপন। ‘গেটেড সোসাইটি’র বহুতল, নয়াদিল্লির সরকারি কলোনি বা প্রাইভেট নিরাপত্তারক্ষী আগলানো রেসিডেনশিয়াল এলাকার বাসিন্দা: সজাগ নাগরিক। গাঁয়ে-গঞ্জে ঝড়, শহরাঞ্চলে অতিবৃষ্টি, পাহাড়-জঙ্গলে ধস বা পৃথিবী নড়ে উঠলে সোশ্যাল মিডিয়াকৃত ‘আই অ্যাম সেফ’ মার্ক করে আমরা নিশ্চিন্ত হই। প্রাকৃতিক অথবা সামাজিক বিপর্যয়ে আমরা উতলা হয়ে এক ক্লিকেই গড়ে তুলি নয়া সামাজিক গোষ্ঠীজীবন। আর এই ২০২০-তেও দিল্লির কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ঘুরেফিরে আসে ১৯৯২-এর মুম্বই অথবা
২০০২-এর গুজরাত। ‘খণ্ডিত’ ভারতে বসবাসের মোটা দাগের যে সামাজিক আর বস্তুগত বিভাজন, তার মধ্যেই রয়েছে এই স্বাভাবিকীকৃত সুরক্ষার গল্প।
আধুনিক ঝাঁ-চকচকে নাগরিক জীবনের পরতে পরতে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, বিদ্বেষের চাষবাস, কিন্তু প্রাণঘাতী হামলাগুলো হয় শহরের সেই সব প্রান্তিক ঘিঞ্জি এলাকায়। নন-এলিট এলাকায়। খেটে-খাওয়া নিম্নমধ্যবিত্ত, দিন-আনা দিন-খাওয়াদের বসবাস দিল্লির সীলমপুর, যমুনা বিহার, মৌজপুর, ভজনপুরা, জাফরাবাদ, উত্তর-পূর্বে ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা। প্রায় ২৬ লাখ মানুষের বসবাস এই অঞ্চলে, জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিমিতে প্রায় ৩৭ হাজার। পাশাপাশি অলিগলিতে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের গা ঘেঁষে থাকা। উজ্জ্বল শহরাঞ্চলের পাশে মলিন সারি সারি লেন, ঘরবাড়ি, পাইকারি বাজার, ছোট ফ্যাক্টরি, দোকানহাট। সচ্ছল, গতিময় নয়াদিল্লির পরিপূরক ‘জুগানদার’ এই সব অঞ্চলের আর্থ-সমাজ।
খেটে-খাওয়া, মধ্য-নিম্নবিত্ত রোজগারের যে শহরাঞ্চল, সেখানেই উর্বর জমি পেয়ে যায় মারমুখী হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি। হতে পারে তা সীমিত সংস্থানের উপর জীবিকা ধারণের চাপ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল। কিন্তু, মধ্যবয়সি শাহবাজ কারামান নগরের এক গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন ছোট্ট মাদ্রাসার ভগ্নদশা, তার পাশেই আক্রান্ত মসজিদের পোড়া ধর্মগ্রন্থ। এ অঞ্চলে প্রতিবেশীরা অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের। শাহবাজ বলছিলেন, এই ধ্বংসলীলায় তাঁদের কোনও হাত নেই। শ’দেড়েক উন্মত্ত জনতাকে এঁরা সামাল দিতে পারেননি। বারো মাস এঁদের একসঙ্গে, একই জীবন সংগ্রামে জুড়ে জুড়ে থাকা। নগরের দলিত অধ্যুষিত বসতি, বাল্মীকি সম্প্রদায় এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। একই রকম বসতি বিন্যাস সীলমপুর এলাকায়। দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষগুলোই এলাকার প্রবেশ মুখের গলিতে গলিতে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ করেছেন দাঙ্গাবাজদের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বয়ান, দাঙ্গাবাজেরা মূলত বহিরাগত। কোনও বিশেষ সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করার বদলে স্থানীয় মানুষ এদের বহিরাগত হিসেবেই দেখতে চান। তার মানে এই নয় যে স্থানীয় স্তরে কোনও রকম সাম্প্রদায়িক অংশগ্রহণ ছিল না। নির্দিষ্ট ভাবেই আমরা জানি, কারা নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী অহিংস শৈল্পিক প্রতিবাদ ধর্নায় হুমকি দিয়ে এসেছিল। আন্দাজ করা গিয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষ এই প্রতিরোধকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ হিসেবে দেখানোর একটা শেষ চেষ্টা করা হবে।
মুস্তফাবাদ উত্তর-পূর্ব দিল্লির এমন এক অঞ্চল যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের বসতি অনেক বেশি। মাজার, মসজিদ সেখানেও আগুনে পুড়ে খাক। বেশ কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকানপাট, বাড়িও ভাঙচুর হয়েছে। আগুন জ্বালানোর ছবি-প্রতিচ্ছবি, রাজনৈতিক দল বা নেতাদের উস্কানিমূলক বয়ানে বা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তার আলোচনায় আমরা এই মুহূর্তে আগ্রহী কম। আল-হিন্দ হাসপাতাল এই অঞ্চলেই অবস্থিত। বেশির ভাগ আক্রান্ত মানুষ প্রাথমিক ভাবে এখানেই আশ্রয় আর চিকিৎসা পেয়েছেন। সেখান থেকেই মুজিব রহমানের ভিডিয়ো ইন্টারভিউতে আমরা শুনেছি, কী ভাবে তাঁদের পরিবারকে আতঙ্কের রাতে আগলে রেখেছেন আকাশ আর সঞ্জীবভাই। পড়শি মহিলারা রাস্তায় নেমে আক্রমণকারীদের কাছে হাত জোড় করে প্রাণরক্ষা করেছেন তাঁদের মুসলিম প্রতিবেশীদের।
ঘটনার পরম্পরায় ‘টোপিওয়ালা’ আর ‘ভাগওয়াধারী’ (স্থানীয় বয়ানে) দু’দলই হিংসায় শান দিয়েছে। ভুক্তভোগী স্থানীয় মানুষ জানাচ্ছেন, এরা অধিকাংশই জড়ো হয়েছে বাইরে থেকে এসে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই মনে করছেন, পুলিশি সক্রিয়তার অভাবে বা প্রচ্ছন্ন মদতে প্রাথমিক ভাবে হিংসা ছড়ায়। চোখের সামনে গোকুলপুরীর টায়ার মার্কেট দাউদাউ করে জ্বলতে দেখে ভেসে উঠেছে সমান্তরাল ১৯৮৪’র ১-২ নভেম্বরের ভয়াবহ ইতিহাস। তাৎক্ষণিক অকাল তখ্ত উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিল্লির সব গুরুদ্বারকে নির্দেশ দিয়েছে হিংসা কবলিত মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে। মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে এই ভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছে সৌভ্রাতৃত্ব। ১৯৮৪’তে বেশ কিছু এলাকায় উন্মত্ত দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে শিখ সম্প্রদায়কে সুরক্ষা দিতে দেখা গিয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায়কে।
চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে বিশপ রেভারেন্ড ওয়ারিস মাসিহ নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের সকল অধিকর্তাকে। সকলে যেন এগিয়ে আসেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে, আশ্রয় যেন পান ঘরছাড়া মানুষ। এই ভাবেই দিল্লির নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তার পরিপূরক হয়ে এগিয়ে এসেছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি যন্তর মন্তরে জড়ো হয়েছিলেন স্বাধীন উদ্যোগে বেশ কিছু মানুষ। যাঁরা কালক্ষেপ না করেই হিংসা ছড়ানোর এক দিনের মাথায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ছুটে গিয়েছিলেন। সিভিল সোসাইটির বেশ কিছু অগ্রণীমুখ— আইনজ্ঞ, ফিল্মমেকার, সমাজকর্মীদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে রেসকিউ টিম। শারীরিক আর মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের যাঁরা চিকিৎসা বা শুশ্রূষা করতে পারবেন, তাঁরা থাকছেন প্রথম টিমে। যাঁরা আশ্রয় দিতে পারবেন, যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, তাঁরা দ্বিতীয় টিমে। আর, তৃতীয় টিমে থাকছেন যাঁরা যোগাযোগমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। এই ভাবেই একটা সঙ্কট মুহূর্তে সমান্তরাল সামাজিক সক্রিয়তা খণ্ডিত ভারতবর্ষে আশার আলো জ্বালাতে চাইছে।
অন্য দিকে, বিভাজনবিষ আর অনিশ্চয়তা মিলে যে অস্থির সমাজের জন্ম দেয়, সেখান থেকে রেহাই পাওয়াও কি খুব সহজ? সুরক্ষার খোঁজে আমরা নিরাপদ অবস্থান বেছে নিচ্ছি। কিন্তু ইনফো-হাইওয়ে বেয়ে আমাদের মুঠোয় প্রতি মুহূর্তে হাজির হচ্ছে হাড়হিম করা দৃশ্য। মেট্রোপলিটান কেন্দ্র প্রতি দিন চব্বিশ ঘণ্টা জোগান দাবি করছে তার প্রান্তবাসী সম্পদভুবন থেকে। ছয়-আট লেনের সড়ক তো শুধু হাইওয়ে নয়। এক একটা মেট্রো রেললাইন দিয়ে তারা জুড়ে দিচ্ছে প্রান্ত ও কেন্দ্রকে। দিনের শেষে রুজিরোজগারের সংস্থান করে যে মানুষগুলো ফিরে যাচ্ছেন ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরের জগতে, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন কিছু অধরা মায়াবী মেট্রো ইমেজ আর তার হাতছানি। এই হাতছানি সহজ কথা নয়। এক নয়া সামাজিক অস্থিরতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছে এই দুই জগতের বাসিন্দাদের। আর এর মাঝে খেলা খেলে যাচ্ছে কিছু ধর্মের ব্যবসায়ী।
আক্রান্ত এলাকার কাছে গুরু তেগ বাহাদুর হাসপাতালের মর্গের বাইরের ছবি: তাহিরা বেগম মুস্তাফাবাদ থেকে এসেছেন ছোট বোন মেহতাবের মৃতদেহ নিয়ে যাবেন বলে। মার্কেটিং কোম্পানির চাকুরে ছাব্বিশ বছরের রাহুল সোলাঙ্কির ছোট ভাইও অপেক্ষায় দাদার মৃতদেহ ফিরে পেতে। বন্ধু সহকর্মীরা ঘিরে রয়েছেন। শাহবাজ আলম, বিকাশ খন্না একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মর্গের বাইরে দ্বেষ নেই, মৃত্যুর ও-পারে ধর্ম নেই। হানাহানির অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে বিহ্বল বিপন্ন শোক।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়