ছবি পিটিআই।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বিমল জালান কমিটির সুপারিশ কার্যকর করামাত্র দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় নামক বাড়িটির ন্যায় ধসিয়া পড়িবে, তেমন আশঙ্কা করিবার কারণ নাই। হাতে থাকা সম্পদের উপর বিভিন্ন গোত্রের ধাক্কা সামলাইতে ব্যাঙ্কের তহবিলে ঠিক কত টাকা থাকা প্রয়োজন, সেই তর্ক পৃথক— কিন্তু, বর্তমানে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিলে ব্যাঙ্কের হাত একেবারে খালি হইয়া যাইবে না। তাহা হইলে, এই হস্তান্তরে আপত্তি কোথায়? প্রথম এবং প্রধান আপত্তি— এই হস্তান্তরের নীতিতে। আজ সরকারকে টাকা দেওয়ার ফলে যদি বিপদ না-ও হয়, পরশু দিনও যে হইবে না, সেই নিশ্চয়তা নাই। এবং, সম্ভাব্য বিপদ দেখিলে ব্যাঙ্ক সরকারের দাবিকে প্রতিহত করিতে পারিবে, তেমন আশা ক্রমেই ক্ষীণ হইতেছে। একটিমাত্র ব্যতিক্রম বাদে উর্জিত পটেলকে প্রবল সরকারবিরোধী ভাবিবার কোনও কারণ তাঁহার মেয়াদে ঘটে নাই। ব্যতিক্রমটি ঘটিয়াছিল ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্তে সরকারের হাত বসানো লইয়াই। অর্থাৎ, শুধু সরকারের সমালোচকদের চক্ষুতেই নহে, উর্জিত পটেলদের চক্ষুতেও এই সিদ্ধান্তটি বিপজ্জনক। ব্যাঙ্কের স্বশাসনের অধিকার ইতিমধ্যেই বহুলাংশে খর্ব হইয়াছে। অর্থনীতির উপর যৌথ নিয়ন্ত্রণের ধারণাটি কার্যত বিলুপ্ত— এখন শুধু সরকারের ইচ্ছায় কর্ম। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কের তোশাখানার দরজা খুলিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ভয়ানক রকম বিপজ্জনক হইতে পারে। বিমল জালান কমিটি যে ভঙ্গিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছে, তাহাও বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। বিপদগুলি উপস্থিত হওয়ার পূর্বে সাবধান হওয়াই বিধেয়।
এই টাকায় রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমানো হউক বা সরকারি খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো হউক, উভয় সিদ্ধান্ত লইয়াই প্রশ্ন উঠিবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে টাকা তুলিয়া সরকার দেদার খরচ করিতেছে, এমন একটি পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রতিক্রিয়া কী হইবে, তাহা এখনও অজ্ঞাত, কারণ পরিস্থিতিটি অভূতপূর্ব। অবশ্য, ভারতের ভাগ্যাকাশে যে মন্দার ঘনঘটা দেখা দিয়াছে, তাহা হইতে নিস্তার পাইতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র পন্থা— অন্তত জন মেনার্ড কেন্স তেমন পরামর্শই দিতেন। তবে, ব্যাঙ্ক হইতে এই হস্তান্তরের একটি অংশের হিসাব ইতিমধ্যেই বাজেটে ধরা আছে। বাড়তি মাত্র ষাট হাজার কোটি টাকায় অর্থনীতির হাল কতখানি ফিরিবে, তাহা লইয়া সংশয় থাকা স্বাভাবিক। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ব্যয়ের নামে সরকার শুধুই বিশেষ কিছু শিল্পগোষ্ঠীকে সুবিধা করিয়া দিবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। অন্য দিকে, কর-রাজস্ব আদায়ের হার ধাক্কা খাওয়ায় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত দিয়া রাজকোষ ঘাটতির হার ঘোষিত সীমায় বজায় রাখা হইলে আর্থিক মন্দার উপর তাহার কোনও প্রভাবই পড়িবে না। প্রশ্ন উঠিবে, তাহা হইলে এ হেন প্রথাভঙ্গ কেন?
রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখিবার পক্ষে প্রধানতম যুক্তি হইল, অন্যথায় মূল্যস্ফীতির হার বাড়িতে থাকে। কিন্তু, অর্থনীতি যখন অপ্রতুল চাহিদার সমস্যায় জর্জরিত, তখন রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়া বাজারে নগদের জোগান বাড়ার ফলে যদি চাহিদা বাড়ে, তাহা পূরণ করিবার ন্যায় উৎপাদন ক্ষমতা— এবং, বর্তমান ক্ষেত্রে, গুদামে জমিয়া থাকা উৎপন্ন পণ্য— ভারতে আছে। ফলে, ঘাটতি কমাইবার দিকে নজর না দিয়া সরকারি ব্যয় বৃদ্ধিই এক্ষণে উচিততর কাজ। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন করিবেন, তাহার জন্য রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে হাত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? ম্যাক্রো-ইকনমিক হিসাবে দেখিলে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত লওয়া আর বাজার হইতে ধার করিবার মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। অর্থনীতির উপর তাহার প্রভাব সমান। তাহা হইলে প্রশ্ন, ব্যাঙ্কের তহবিলে হাত দেওয়ার এই অ-পূর্ব ব্যবস্থাটিকে কার্যত প্রথায় পরিণত করিবার যৌক্তিকতা থাকিল কোথায়?